আমি বাঙালি, আমি ভারতীয়

যে দ্রুততায় এসআইআর শুরু হয়েছে বাংলায়, তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের (এসআইআর) কাজ নিয়ে রাজ্যবাসীর একাংশের মনে আতঙ্ক দানা বাঁধছে। এসআইআর-এর ‘আতঙ্কে’ মৃত্যু এবং আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটে চলেছে একের পর এক। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কী হতে চলেছে, ব্যাখ্যায় রাহুল চক্রবর্তী

Must read

একা রামে রক্ষে নেই, সুগ্রীব দোসর, মা-ঠাকুমার মুখের এই প্রবাদবাক্য আজ যেন পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি ঘরে বিদ্যমান। এক বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার আগেই আর এক নতুন বিপদ এসে হাজির হয়েছে বাঙালির জীবনে। গত প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে ভিনরাজ্যে সরাসরি বাঙালি নিধনের যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ গেরুয়াধারীরা শুরু করেছিল, আজ পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন (SIR)-এর মধ্যে দিয়ে সেই গেরুয়াধারী নরপিশাচের দল বাঁকা পথে বাংলার আপামর জনসাধারণকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়ে রক্তপিপাসু নরখাদকের ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছে।

আরও পড়ুন-আমি বাঙালি, আমি ভারতীয়

খেলা একটা হচ্ছে। পর্যবেক্ষণ করলেই মানুষ বুঝতে পারবে, যে কী ভয়ঙ্কর খেলা এই দাঙ্গাবাজের দল শুরু করেছে। জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য ইতিমধ্যে মা-মাটি-মানুষকে সঙ্গে নিয়ে রণহুঙ্কার দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তোমরা যে খেলা শুরু করেছ, সেই খেলা আমরা শেষ করব।
স্পষ্ট হচ্ছে রাম আর বামের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। ওরা সবাই রামরেড। আমরা প্রত্যেকেই এই বিষয়ে অবগত যে ৩৪টা বছর ধরে একটা রাজনৈতিক দল শুধুমাত্র নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে বাংলার মানুষকে কীভাবে বিপথগামী করেছে, শুধু তাই নয় নিজেদের আখের গোছাতে কত যে মায়ের কোল এরা খালি করেছে, কত যে স্ত্রীর সিঁথির সিঁদুর মুছে দিয়েছে, কত সন্তানকে পিতৃহারা করেছে। ঠিক এই একইভাবে আজ দাড়িভাই আর মোটাভাইয়ের দলের জন্য গত কয়েকদিন ধরে বাংলার ঘরে ঘরে মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছে।
একবার ভাবুন তো কী কারণে এই SIR। অনেকে বলছেন ২০০২ সালেও তো SIR হয়েছিল, তাহলে আজ কীসের অসুবিধা। আরে ২০০২ সালে প্রায় দু-বছর ধরে এই প্রক্রিয়া চলেছিল, কিন্তু আজ মাত্র ২ মাসে দাড়িভাই আর মোটাভাইয়ের তোষামোদকারী দেশের অপদার্থ নির্বাচন কমিশন এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চাইছে। বছরের পর বছর ধরে বংশ-পরম্পরায় বসবাস করা দেশের নাগরিকদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এ কোন ভারতবর্ষে বাস করছি আমরা, ভাবতেই আজ লজ্জা লাগছে।
প্রশ্ন করবেন না আপনারা আজ, যে ভোটার তালিকাকে নির্বাচন কমিশন ভুল প্রমাণিত করতে চাইছে, তাহলে গত দেড় বছর আগে ২০২৪ সালে ভারতবর্ষের লোকসভা নির্বাচন কীভাবে এই ভুল ভোটার তালিকা নিয়ে হল! দেশের ৫৪৩ জন সাংসদ কীভাবে এই ভুল ভোটার তালিকার উপর দাঁড়িয়ে নির্বাচিত হলেন, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দেশের সকল কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা কীভাবে নির্বাচিত হলেন। তাহলে সকল সাংসদের উচিত ইস্তফা দিয়ে পদত্যাগ করে নতুন ভোটার তালিকা নিয়ে পুনরায় নির্বাচনে অবতীর্ণ হওয়া। একথা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিক বৈঠকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করেছেন। সত্যি তো আজকে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ এবং মায়ানমারকে ঘিরে যে ন’টি রাজ্য রয়েছে, তাদের মধ্যে শুধুমাত্র বাংলায় SIR করতে হবে। কেন? প্রশ্ন করবেন না। বাংলাকে এত ভয়? বাংলায় কথা বললে বাংলাদেশি, মাছ খাওয়া যাবে না। আমি কী পড়ব, আমি কী খাব এটা তুমি ঠিক করে দেবে দাড়িচাচা? এত আস্পর্ধা ভাল নয়, জেনে রেখো দুর্বৃত্তের দল। বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সিংহভাগ বিপ্লবীর জন্মগ্রহণের মাটি।
ভাবতে পারেন এই অপদার্থ নির্বাচন কমিশনের অবস্থা। গত ৩০ অক্টোবর এই খবর সামনে এসেছে, যে বিএলও-দের দিয়ে হাতে কলমে নির্বাচন কমিশন এই SIR-এর কাজ করাবেন, নদিয়ার চাকদহ ব্লকে সেইরকম ১৩ জন বিএলও-র নামই ২০০২-এর ভোটার তালিকায় নেই! যা তা ব্যাপার।\

আরও পড়ুন-ডেরেকের কটাক্ষ

আসলে যে দেশের একজন স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী ১৫ অগাস্ট দেশের স্বাধীনতা দিবসের দিন লালকেল্লায় দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন-পরবর্তীতে কবিগুরুর লেখা বাংলায় জাতীয় সঙ্গীত গাইতে পারেন, অথচ একটি রাজ্যে বাংলা ভাষায় কথা বললে সেই রাজ্যেরই তাঁর দলেরই ডবল ইঞ্জিন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশি বলে পুশব্যাক করার কথা বলেন। তাঁর দলেরই এক নেতা, যিনি নিজেকে আইটি সেলের প্রধান বলে দাবি করেন, তিনি একধাপ এগিয়ে বলেই ফেললেন বাংলা বলে নাকি কোনও ভাষাই নেই! আরে মূর্খের দল সংবিধান-স্বীকৃত ২২টি ভাষার মধ্যে অন্যতম হল এই বাংলা ভাষা, যা কিনা ধ্রুপদী ভাষার তকমা পেয়েছে। সেটা আপনারা জানেন না। জানবেনই বা কী করে। যেখানে বাংলার সাধারণ মানুষ নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার চিন্তায় সর্বক্ষণ আতঙ্কিত, ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে রয়েছে, দিকে দিকে মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন, তখন সেইসব মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে আপনাদের দুই বিধায়ক কল্যাণী এইমসে পিছন দরজা দিয়ে দুনম্বরি ভাবে লোক নিয়োগের নোংরা কাজে লিপ্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে ব্যস্ত। ছিঃ, আপনারা বুঝবেন বাংলার মানুষের দুঃখ? কোনওদিনই না। বাংলার মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, কষ্ট যদি কোনও রাজনৈতিক দল বুঝে থাকে, সেটা হল একমাত্র তৃণমূল কংগ্রেস। অভিষেকদা কালবিলম্ব না করে নিমেষে ছুটে গিয়েছেন পানিহাটিতে। অসহায় পরিবারের সহায়সম্বলহীন মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে মা-মাটি-মানুষকে সঙ্গে নিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে স্লোগান তুলেছেন— ‘সারা বাংলার একটাই স্বর, জাস্টিস ফর প্রদীপ কর’ এটাই হল বাংলার ঐতিহ্য, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার কৃষ্টি। উৎসবের দিনে যেমন সকলে সকলের পাশে থেকে আনন্দে মেতে উঠি, ঠিক তেমনভাবেই বিপদের দিনে একজন আর একজনের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে সান্ত্বনা দিই, ভরসা জোগাই। আর ওই অপদার্থ গদ্দারটা শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ৪ তারিখ নাকি মিছিল করবে! অসভ্য, বর্বর দু-কান কাটা নির্লজ্জ বেহায়ার দল সব। ৪ তারিখ আমরাও মমতাদি আর অভিষেকদার নির্দেশে রাজপথে নামছি। দেখি কত ধানে কত চাল! গদ্দারটাকে বুঝিয়ে দেব।
সামনে SIR, আর পিছনের দরজা দিয়ে NRC। এটাই কেন্দ্রীয় সরকারের আজকের ব্লু প্রিন্ট। এই কথা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে বলে এসেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, এই হৃদয়হীন খেলা চিরতরে বন্ধ করুন। বাংলা NRC বরদাস্ত করবে না। আমরা কাউকে জনগণের মর্যাদা কেড়ে নিতে দেব না। দিল্লির জমিদাররা শুনে নিন, বাংলা প্রতিরোধ করবে, বাংলা রক্ষা করবে, বাংলা জয়ী হবে।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

জয়ী তো আমরা হবই। মাথার উপর যেখানে মমতাদি এবং অভিষেকদা-র মতো দুজন মানুষের আশীর্বাদের হাত আছে সেখানে আমাদের জয় আটকায় কার সাধ্যি—
প্রয়োজন হলে দেব একনদী রক্ত।
হোক না পথের বাধা প্রস্তর শক্ত,
অবিরাম যাত্রার চির সংঘর্ষে
একদিন সে-পাহাড় টলবেই।
জনতার সংগ্রাম চলবেই,
আমাদের সংগ্রাম চলবেই।
আর এই সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই মা-মাটি-মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ২০২৬-এ গণতান্ত্রিক উপায়ে এই অপদার্থ রামরেডদের নিক্ষেপ করে ঘাষফুল-খচিত জয়ের তেরঙ্গা আকাশে বাতাসে উড়িয়ে দৃপ্তকণ্ঠে গেয়ে উঠব— বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান॥
জয় বাংলা, খেলা হবে।

Latest article