মদন মিত্র: আমি তৃণমূল কংগ্রেসের একজন সৈনিক। তিন দশক পেরিয়ে গিয়েছে সেই রক্তে রাঙা দিন। কিন্তু আজও সেই ২১-এর ক্ষত দগদগে। যেন মনে হয় গতকাল। মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগে। চোখ বুজলে পুরো দৃশ্যটা চোখে ভাসে। কেমন করে তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেসের সহযোগিতায় কমিউনিস্ট পার্টি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রত্যেকটি আন্দোলনকে ‘থ্রিলার হ্যাপি’ এবং রক্তঝরা আন্দোলন রূপে তারা ব্র্যান্ডেড করতে চেয়েছিল। দিকে দিকে সেই বার্তা রটে গেল ক্রমে…যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মিছিল মানেই লাশ। গুলি আর রক্ত। এই কাজে হাত মেলালেন তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেসের নেতৃত্ব। রাজনৈতিক হিসাবে অবশ্যই দিল্লির নেতৃত্বেরও নিঃসন্দেহে বন্ধুত্ব ছিল।
আরও পড়ুন-সংবিধান ভেঙে পড়েছে, কড়া নিন্দায় সুপ্রিম কোর্ট
২১ জুলাই একেবারে দিঘির টলমল করা জলের মতো শান্ত স্থির যুব কংগ্রেস কর্মীরা ছিল লক্ষ লক্ষ। কত লক্ষ? আকাশের তারা যেমন গোনা যায় না সেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে প্রদেশ যুব কংগ্রেসের কর্মীদেরও সংখ্যা গোনা যায়নি। মন দিয়ে নেতৃত্বের বক্তব্য শুনছেন কর্মীরা। হঠাৎ রটে গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাইটার্স বিল্ডিং দখল করেছেন। মহাকরণ দখল হয়ে গিয়েছে। এবং সমস্ত পুলিশের কাছে খবর চলে গেল, যেখানে দেখবে, গুলি করবে। গন্ডগোল হয়েছে মেয়ো রোডে অথচ গুলি চলেছে শ্যামবাজারে, ডানলপে, বালিগঞ্জে। এক হাজারের ওপর সহকর্মীদের গুলি, বন্দুক, ব্যাটন, বেয়নেট দিয়ে, লাঠি দিয়ে নির্বিচারে আঘাত করা হয়েছে।
আরও পড়ুন-‘হৃদয় পুড়ে যাচ্ছে, হৃদয় কাঁদছে’, ২১ জুলাইয়ের সভাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে মণিপুর নিয়ে বললেন মুখ্যমন্ত্রী
এদিকে, ততক্ষণে সকলেই জেনে গিয়েছি জ্যোতি বসুকে পিছনের দরজা দিয়ে বের করা হয়েছে, আর মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মানে এটা রটানো হয়েছিল, গায়ের জোরে লক্ষ লক্ষ কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে চেয়ার দখল করে নিয়েছেন। ‘সত্য সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ…’ যখন বলা হচ্ছে মমতা মহাকরণ দখল করেছেন, তখন তিনি একজন রক্তাক্ত জখম সহকর্মীকে নিয়ে লুটিয়ে পড়ে রয়েছেন। একদিকে পোস্ট অফিস, একদিকে ব্যাঙ্কশাল কোর্ট আর একদিনে টেলিফোন ভবন। সেখানকারই পুলিশ বিটে গুরুতর জখম অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একমাত্র জিপসি নিয়ে সঙ্গে একজন মাত্র সহকর্মী।
আরও পড়ুন-বিশ্বকাপ ২০২৩, শাহরুখ আইসিসির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘুরছিলেন ব্রেবোর্ন রোড, স্ট্র্যান্ড রোড, ধর্মতলা, মেয়ো রোড। কথা ছিল কেউ কোথাও যাবে না, শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একা প্রতিটি জায়গায় ঘুরবেন। কিন্তু তার আগেই রটে গেল মিথ্যা রটনা। আমরা বলি বিজেপির মিথ্যা প্রচার। বিজেপির ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু সিপিএমের কাছে এরা শিশু। চুরি, জোচ্চুরি, লুঠ, নির্যাতন, ব্যালট ছিনতাই, নির্বাচন, বুথ দখল, ফলস ভোট, বুথ জ্যাম, এখনও এদের ৫০ বছর সময় লাগবে সিপিএমের কাছে শিখতে। ‘স্পেশালি ট্রেন্ড’ ক্ষমতা দখল করার একটা ‘ফ্যাসিস্ট শক্তি’। রটিয়ে দিল চারিদিকে উন্মত্ত হিংস্র পৃথিবী। গোটা কলকাতা জুড়ে নেমে এল উন্মত্ততা।
আরও পড়ুন-১১টি জেলাকে ‘ভূমি সম্মান’ রাষ্ট্রপতির, গর্বিত মুখ্যমন্ত্রী
মানুষজন কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে প্রাণভয়ে দৌড়চ্ছে। যে যেখানে পারে শেল্টার নিচ্ছে। চারিদিকে কাঁদানে গ্যাস। গুলি। একটা বোমাও কিন্তু পড়েনি। বলা হয়েছিল যে, আমাদের সহকর্মীরা বোমা ছুঁড়েছে। কিন্তু পরে যখন কমিশন হয়, পুলিশ হাসপাতালে যখন চিকিৎসার রিপোর্ট যখন পেশ করা হয় বিধানসভায়, কমিশনে দেখা যায় কোনও পুলিশের গায়ে কোনও বুলেটের চিহ্ন ছিল না। এমনকী কোনও লাঠির আঘাতও ছিল না পুলিশের শরীরে। তাই বিস্তারিত না গিয়ে শুধু এইটুকু বলব, ১৯৮৪-র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে, তারপর ৯১-এ যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী, ৯০-এ বাদশা আলমের হাতে প্রায় মৃত্যু ঘোষিত— সেই অবস্থা থেকে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, নেতাই, মেটিয়াবুরুজে ভাঙচুর করে গুলি, আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া, তারপর থেকে ২১ জুলাই, আর ২১ জুলাই থেকে ২০১১ থেকে ২০২৩।
আরও পড়ুন-ধানের সহায়কমূল্য বাড়াল রাজ্য সরকার
আজ কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামের সঙ্গে জ্বলজ্বল করছে একটা শব্দ। খুব শক্তিশালী শব্দ। পাঁচ অক্ষরের। তার নাম হচ্ছে ‘ইন্ডিয়া’। আমাদের সকলের মনে রাখতে হবে এই পঞ্চায়েতটা নিঃসন্দেহে একটা বড় লড়াই ছিল। কিন্তু আসল লড়াই ২০২৪-এর লড়াই। রাজনৈতিক লড়াই, ব্যক্তিগত কুৎসার লড়াই নয়। কারও নামে কুৎসা, কটাক্ষ করে নয়। কোনও ব্যক্তি, কোনও নেতাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়। কিন্তু ভারতবর্ষের কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পৌঁছে দিতে হবে একটা নাম— ‘এম ফর মা, এম ফর মাটি, এম ফর মানুষ, এম ফর মমতা’। আর এই এমকে সামনে রেখে, ‘পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাত, মারাঠা, দ্রাবিড়, উৎকল, বঙ্গ’। তাই ২১ জুলাই হবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে হিংস্রবাহিনী হাত ওঠাও, এই স্লোগান নয়, এবারের ২১ জুলাইয়ের স্লোগান— দেশমাতৃকার শৃঙ্খল ঘোচাতে বন্দে মাতরম, সুজলাং সুফলাং মলয়জশীতলম শস্যশ্যামলম মাতরম, বন্দে মাতরম। আসুন, আমরা দেশমাতার পায়ে যে লোহার শিকল তার থেকে মুক্তি ঘটাই।
আরও পড়ুন-আজ মিডিয়া সেন্টার উদ্বোধনে বিজয়ন, মোহনবাগান দিবসে সংবর্ধনা সুনীলকে
আমার মনে আছে বিজয়গড়ে একটা পুজো হত— দেশমাতার পুজো। তেমনই এবারে ২১ জুলাই আমাদের ভারতমাতার পুজো হবে। যে পুজোর প্রধান পুরোহিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে ভারতবর্ষ সারা বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেবে সেই কণ্ঠ, ‘বল বল বল সবে শত বীণা বেণু রবে/ ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।’ ২১ জুলাইয়ের শহিদের আমি সম্মান, শ্রদ্ধা, প্রণাম জানাই। ‘এ মেরে বতন কে লোগো, জারা আঁখ মে ভর লো পানি, জো শহিদ হুয়ে হ্যায় উনকি, জারা ইয়াদ করো কুরবানি’। সেই শহিদদের কুরবানিকে সামনে রেখেই আমরা এই গান গাইতে চলেছি ২১ জুলাই। তাই, ‘মুক্তির মন্দির সোপালতলে কত প্রাণ হল বলিদান, লেখা আছে অশ্রু জলে।’ মমতাকে সামনে রেখে আমাদের বলতে হবে,“আমরা চলি সমুখপানে, কে আমাদের বাঁধবে। রইল যারা পিছুর টানে, কাঁদবে তারা কাঁদবে।’’