আসুন, কিছু সত্যি কথা বলি।
আসুন, দাঙ্গা কারা ছড়ায়, নিই বুঝে।
আসুন, ফি বছর রামনবমী এলেই কাদের মনটা দাঙ্গা বাধানোর জন্য উসখুস করে, নিই চিনে।
প্রথমেই জানানো যাক, নির্দ্বিধ চিত্তে, মর্যাদা পুরুষোত্তম রামচন্দ্রকে হিন্দুত্বের অস্মিতার সঙ্গে অন্বয়ের কাজটি সুচারুভাবে করেছেন গেরুয়াবাদীরা।
১৯২৫-এর ২৭ সেপ্টেম্বর ছিল বিজয়া দশমী। রামচন্দ্রের রাবণবধের দিন। অন্য কথায়, শ্রীরামচন্দ্রের বিজয় দিবস। রাম কেন্দ্রিক সেই গুরুত্বপূর্ণ তিথিটিকে কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার নির্বাচন করেছিলেন হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের ‘সংঘ’ প্রতিষ্ঠার জন্য। পরের বছর ১৭ এপ্রিল পড়েছিল রামনবমী। সেদিনই প্রতিষ্ঠা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের। অস্যার্থ, রামনবমী কেবল শ্রীরামচন্দ্রের জন্মতিথি নয়, আরএসএস- এরও জন্মতিথি।
রামনবমীর শোভাযাত্রা ঘিরে অশান্তির সংবাদ প্রথম পাচ্ছি ১৮৭১-এ। ঘটনাস্থল উত্তরপ্রদেশের বেরিলি। সেদিন শোভাযাত্রা মুসলমান অধ্যুষিত এলাকার ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় আক্রান্ত হয়। আক্রমণের নীলনকশা আগেই তৈরি করা হয়। আক্রমণের জেরে এক হিন্দু পুরোহিত নিহত হন। তখনও এদেশে কারও কোনও ধারণা ছিল না, এক শতাব্দীর মধ্যে এই রামনবমীর হিংসা কী আকার নেবে।
সন ১৯৬৭। এপ্রিল মাসে রামনবমী। নাগপুরে রামনবমীর শোভাযাত্রায় অস্ত্র প্রদর্শিত হল, হুংকার ও আস্ফালন সমেত। এই খবর পাচ্ছি, ‘হিন্দুত্ব’ কাগজের পাতা থেকে। স্মর্তব্য, নাগপুরেই আরএসএস-এর প্রধান দফতর।
আরও পড়ুন-বাংলাকে বদনাম করাই লক্ষ্য, বিজেপির হাতিয়ার ভুয়ো ছবি
১৯৭৯। আরএসএস-এর প্রধান তখন বালাসাহেব দেওরস। জামশেদপুরে একটি সভায় আগুন ঝরানো বক্তৃতায় তিনি বলেন, রামনবমীর দিনে হিন্দুদের নিজ শক্তি প্রদর্শন করা উচিত। ফলস্বরূপ সেবারেই প্রথম রাম নামে দাঙ্গা দেখল ভারতবর্ষ। অন্তত ৭৯ জন মুসলমান ধর্মাবলম্বী প্রাণ হারালেন। নিহতদের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা ২৫। জিতেন্দ্র নারায়ণ কমিশন তদন্ত করে জানায়, এই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের কারণ আরএসএস, দায়ী স্থানীয় বিধায়ক দীননাথ পাণ্ডে। তিনি আরএসএস-এর মদতপুষ্ট।
১৯৮০-র দশকে এই দাঙ্গা বাধানোর ভার আরএসএস দিয়ে দিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে। মেরুকরণের মাধ্যমে হিন্দু ভোট একীভূত করার প্রকরণ করে তোলা হল এই সংগঠনটিকে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ধর্ম সংসদেই আওয়াজ উঠল, রাম জন্মভুমি পুনরুদ্ধারের। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৩, টানা এক দশক রামনামে সন্ত্রস্ত থাকল ভারতের আত্মা। রামনবমীতে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ক্রমে স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়াল। একই ভাবে স্বাভাবিক হয়ে উঠল, রামনবমীর শোভাযাত্রায় অস্ত্র নিয়ে লম্ফঝম্প, মুখব্যাদান, রণহুংকার ইত্যাদি। বদলে যেতে থাকা সেই আবহেই সংঘটিত হল মুম্বই বিস্ফোরণের মতো ঘটনা। ১৯৯৩-এর সেই হিংসার তাণ্ডবের বলি হলেন ২৫৭টি নিরীহ প্রাণ, আহত হলেন ৭০০-রও বেশি মানুষ।
২০১৭ থেকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঘিরে হিংসাত্মক ঘটনার সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৮-তে সারা দেশে এ রকম দাঙ্গার সংখ্যা ছিল ১৭টি। চার বছর পর, ২০২২-এ, দেখা গেল দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে ছটি রাজ্যে, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত, গোয়া ও দিল্লিতে। পরের বছর রামনবমীর দাঙ্গার মানচিত্রে রইল, পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত এবং বিহার। গত বছরেও দাঙ্গার ভূগোলে দেখা গিয়েছে মোটামুটি এই রাজ্যগুলোকেই।
এত কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই। রাম নবমীকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তিথি করে তোলার কৃতিত্ব আরএসএস-এরই, অন্য কারও নয়। এবং এই রাজ্যে রামনবমীর অশান্তি ২০১৭-২০১৮-র আগে ছিল না। ২০১৪-তে লোকসভা নির্বাচন এবং ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে পর্যুদস্ত হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের রাজনৈতিক জমি গড়ে তোলার জন্যই হিন্দুত্ববাদী বিজেপি এ-রাজ্যে রামনবমীর সাম্প্রদায়িক অশান্তির বীজ উপ্ত করে।
তৎপূর্বে হিন্দু বাঙালি চৈত্র মাসে শ্রীকৃষ্ণের পঞ্চম দোল থেকে শুরু করে শীতলা অষ্টমী, অন্নপূর্ণা পুজো থেকে শুরু করে দরিদ্রের মহোৎসব চড়ক, গাজন, ইত্যাদি অনেক কিছুই পালন করত, এমনকী এই মাসে বাসন্তী পুজোর ষষ্ঠী তিথিতে অশোক ষষ্ঠীর ব্রত, অষ্টমী তিথিতে অশোক অষ্টমী, অন্নপূর্ণা পূজা— এসব উদযাপনে উৎসাহিত ছিল বহুকাল ধরে, কিন্তু রামনবমী নিয়ে তার আলাদা কোনও মাথাব্যথার কথা শোনা যায়নি।
এবারেও রামনবমীতে তারা প্রচুর চেষ্টা করেছিল। পারেনি।
পারল, দুর্ভাগ্যবশত, হনুমান জয়ন্তীতে। পারল, এক শ্রেণির সংখ্যালঘু মানুষের বিভ্রান্তির কারণে।
আরও পড়ুন-বৈধ অভিবাসীদেরও জেলে পাঠানোর হুমকি ট্রাম্পের
তার পর কী হল?
পুলিশ তৎপরতা বাড়াল। জঙ্গিপুর পুলিশ জেলায় পৌঁছোনোর পর জেলা পুলিশের শীর্ষ আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন ডিজি রাজীব কুমার। ওই বৈঠকের পরেই বিভিন্ন জেলার বাছাই করা পুলিশকর্তা ও কর্মীদের ‘স্পেশ্যাল অন ডিউটি’তে দ্রুত জঙ্গিপুরে পৌঁছে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। চার দিনের জন্য তাঁদের মুর্শিদাবাদে ‘বিশেষ দায়িত্ব’ দেওয়া হয়েছে। রবিবার মুর্শিদাবাদে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম সরকার।
এর মধ্যেই মুর্শিদাবাদে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি দিয়েছেন রানাঘাটের বিজেপি সাংসদ জগন্নাথ সরকার। একধাপ এগিয়ে মুর্শিদাবাদে ‘আফস্পা’ দাবি করেছেন পুরুলিয়ার বিজেপি সাংসদ জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতো। আর ফেসবুকে ফেসবুকে একদল দালাল দাবি করছে, পুলিশ নিষ্ক্রিয় বলেই মুর্শিদাবাদে দুষ্কৃতী সক্রিয়তা বাড়ছে। আর উত্তরপ্রদেশের এবং পুরোনো ছবি পোস্ট করে অপপ্রচার চলছে, গুজব ছড়াচ্ছে।
এদের চিনে নিন।
অবিলম্বে ওদের জনবিচ্ছিন্ন করুন।
আর দেরি করলে চলবে না।
আমাদের শান্তিতে থাকতেই হবে।
শান্তিভঙ্গকারী শকুনদের তাড়াতেই হবে বাংলার আকাশ থেকে।