২০২৪এ প্রবল প্রয়াস চলেছে। ২০২৫-এও প্রয়াস অব্যাহত থাকবে। বিজেপির সংবিধান বদলানোর প্রয়াস। আর সেই অপচেষ্টা প্রতিহত করার জন্য আমাদের প্রাণান্তকর সংগ্রাম। জীবন থাকতে আমরা তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকেরা সংবিধান পরিবর্তন করে দেশটাকে সর্বাত্মক আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হতে দিইনি, দেব না।
সন্দেহ নেই বিজেপির নেতৃত্বে এবার যে সরকার তৈরি হয়েছে সেটি ‘সংখ্যালঘু’। ভাবা হয়েছিল যে মোদিজি সংসদের প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হবেন। কিন্তু শীতকালীন অধিবেশন দিল বিপরীত সাক্ষ্য। স্পষ্টতই, মোদিজির নির্দেশে মন্ত্রী এবং শাসক গোষ্ঠীর সাংসদদের স্বাভাবিক আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতেই সংসদে পাওয়া গেল। সংসদীয় নিয়ম এবং প্রথার প্রতি তাঁরা বিশেষ সম্মান দেখাননি। বস্তুত, সংসদে বিরোধীদের উপর রুক্ষ ব্যবহারই করেছে শাসক পক্ষ। রাজনাথ সিং সাধারণভাবে একজন ভদ্র বিনয়ী মানুষ। এস জয়শঙ্কর এবং কিরেন রিজিজুকেও সংযত মেজাজে পাওয়া যায়। কিন্তু বিরোধীদের দাবি খারিজ এবং দোষারোপ করার জন্য তাঁরা যেভাবে হস্তক্ষেপ করলেন তা ঔদ্ধত্য ফেরানোর নজির হিসেবেই থেকে যাবে।
আরও পড়ুন- সুস্বাস্থ্যই লক্ষ্য! অভিষেকের হাত ধরে শুরু ‘সেবাশ্রয়’, ঘুরে দেখলেন পরিকাঠামো
সরকার একযোগে নির্বাচনের জন্য সংবিধান (১২৯তম) সংশোধনী বিল উত্থাপন করে এবং বিলটিকে দ্রুত পাঠিয়ে দেয় যৌথ সংসদীয় কমিটিতে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্য না-থাকায় সরকার পক্ষ বিপাকে পড়েই এই নিয়ম লঙ্ঘনের কাজটি করেছে। বিলটি উত্থাপনের সময় তার পক্ষে ২৬৩ এবং বিপক্ষে ১৯৮ ভোট পড়েছিল। কিন্তু তার কাছে উপস্থিত সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন এবং সংবিধান সংশোধনী বিল পাশের জন্য প্রয়োজনীয় ভোট ছিল, সরকার এটা দেখাতে পারেনি। বিলটিকে ‘পরাজিত’ করতে লোকসভায় বিরোধীদের প্রয়োজন ছিল মাত্র ১৮২ ভোট। সেখানে ‘ইন্ডিয়া’ ব্লকের রয়েছে ২৩৪ আসন।
বিলটির পরাজয় আধ ডজন কারণে জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ ।
এক, সংবিধানে এই ব্যবস্থা রয়েছে যে লোকসভা (অনুচ্ছেদ ৮৩) এবং বিধানসভাগুলি (অনুচ্ছেদ ১৭২) নির্বাচিত হতে হবে পাঁচবছরের জন্য। এটি সংবিধানের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এই মৌলিক বৈশিষ্ট্য সংশোধন করার ক্ষমতা সংসদের নেই। ধরা যাক, বিধানসভাগুলি একবারে একবছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হবে বলে সংবিধান সংশোধনী বিল একটি উদ্ভট পরিবর্তনের প্রস্তাব নিয়েছে। সেটি অসাংবিধানিকই হবে। কারণ এমন পরিবর্তন নির্বাচনকে প্রহসন এবং আইনসভাকে একটি সার্কাসে পরিণত করবে। এই নিয়ম মানতে গিয়ে, একইভাবে, লোকসভার মেয়াদের সঙ্গেই সমাপ্ত হবে বিধানসভার মেয়াদ! তাতে হাস্যকর এবং প্রহসনে পরিণত করা হবে বিধানসভা এবং রাজ্য সরকারগুলিকে। একটি নির্বাচিত বিধানসভার আয়ু ছ’মাস থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে যেকোনও মেয়াদের হতে পারে। ১৯৯৬, ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনগুলির কথা একবার ভেবে দেখা যেতে পারে। ‘ওয়ান নেশন ওয়ান ইলেকশন’ প্রস্তাবটি গত শতকের নব্বইয়ের দশকে কার্যকর থাকলে তবে সমস্ত রাজ্য বিধানসভাকেও তিনবছরে তিনটি নির্বাচনের ঝক্কি পোহাতে হত। আর এমনটা হলে স্থিতিশীল রাজ্য সরকারের ধারণাকে বিদায় জানাতে হবে।
দুই, সংসদীয় গণতন্ত্রে একটি সরকারের জন্য নির্দিষ্ট মেয়াদের কোনও কনসেপ্ট নেই।
কেন্দ্রীয় সরকারকে লোকসভার কাছে প্রতিদিন অবশ্যই দায়বদ্ধ থাকতে হবে। তার মানে হল, সেই সরকার প্রতিদিন সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপিদের সমর্থন নিয়ে চলবে। একটি কেন্দ্রীয় সরকার তার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন হারিয়েছে বলেই কেন দেশের রাজ্য সরকারগুলিও তাদের স্থিতিশীলতা হারাবে? রাজ্য সরকারগুলি তো শুধু নিজ নিজ রাজ্যের আইনসভা বা বিধানসভার কাছেই দায়বদ্ধ। আরও ভেবে দেখুন, হয়তো একটি বিধানসভা নির্বাচনের একমাস পরই ভেঙে দেওয়া হল লোকসভা! লোকসভা ভেঙে যাওয়ার দায়ে কেন একটি সদ্যগঠিত বিধানসভা-সমেত দেশ জুড়ে সমস্ত বিধানসভাকেই ভেঙে দেওয়া হবে?
তিন, কোনও বিরোধী দল যারা একটি রাজ্য সরকার চালায় তারা প্রধানমন্ত্রীকে পরাজিত করতে ভোট দেবে না। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর পতনের কারণে লোকসভা ভেঙে দেওয়া হলে তখন সমস্ত বিধানসভাও যে ভেঙে যাবে! ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে বাঁচাতে ছুটে যাবেন সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাই! তাঁদের নিজেদের কার্যকাল ও বিধানসভার মেয়াদ বাঁচাতেই মরিয়া হয়ে এই কাণ্ড ঘটাতে বাধ্য হবেন তাঁরা!
চার, সংসদীয় গণতন্ত্রে এই অলিখিত নিয়ম আছে যে, যে-প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে লোকসভার সমর্থন রয়েছে তিনি যেকোনও সময় সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন আয়োজনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারেন। রাষ্ট্রপতিকে সেই পরামর্শ মেনে নিয়ে অবশ্যই নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। একজন ধূর্ত প্রধানমন্ত্রী যদি নিশ্চিত হন যে তাঁর দল কেন্দ্রে পুনর্নির্বাচিত হবে, তাহলে বিরোধী দলগুলির তরফে গঠিত রাজ্য সরকারগুলি ফেলে দিতে তিনি লোকসভার অকাল বিলুপ্তিই চাইবেন এবং সেইমতো রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারেন। তখন রাজ্য সরকারগুলির ভাগ্য আর রাজ্য বিধানসভার হাতে থাকবে না, চলে যাবে প্রধানমন্ত্রীর কবজায়।
পাঁচ, একজন প্রার্থীর মেয়াদ অনিশ্চিত হয়ে গেলে তিনি নির্বাচনে লড়তে যাবেন কেন? একইভাবে জনগণও ভাবতে পারে, কেন একজন প্রার্থীকে ভোট দেবে যখন তারা নিশ্চিতই হতে পারছে না যে সেই ব্যক্তিটি কতদিন তাদের বিধায়ক হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করবেন?
ছয়, বিলটির পিছনে আসল উদ্দেশ্য হল বিরোধী দলগুলিকে ক্ষীণবল বা দুর্বল করা, যাদের জন্য তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, পাঞ্জাব, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলিতে বিজেপি কোনওভাবেই ভোটে জিততে পারছে না। এই দাপুটে বিরোধী দলগুলির থেকে বিজেপি সবরকমে পরিত্রাণ চাইছে।
খেয়াল করুন, সংখ্যার তফাত ২০১৪ সাল এবং ২০১৯ সালের চেয়ে খুব বেশি আলাদা নয়। ২০১৪ সালে এনডিএর এমপি সংখ্যা ছিল ২৮২ এবং ২০১৯ সালে ছিল ৩০৩। এবার লোকসভায় কেবল বিজেপি একাই অনেক কমে গিয়েছে। নরেন্দ্র মোদি তাঁর দলের সদস্যদের এবং সহযোগীদের একটা জিনিস চটপট বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের মতোই জনসমর্থন নিয়ে তাঁরা পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর এই আশ্বাসেই এনডিএ সাংসদদের নার্ভাসনেসের প্রাথমিক ধাক্কাটি দূর হয়ে গিয়েছে। ফিরে এসেছে ঔদ্ধত্য।
এই অভব্যতাকে সহমত শেখাতেই হবে। এটাই ২০২৫-এর রেজোলিউশন।