এনডিএ ৩-এর প্রথম মিটিংয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতের সংবিধান মাথায় ছোঁয়ার ছবি গোটা ভারতবর্ষ প্রত্যক্ষ করেছিল। এই প্রতীকী ছবি দিয়ে উনি বার্তা দিলেন, সংবিধানকে মান্যতা দিয়ে প্রধানমন্ত্রিত্ব চালাবেন, তবে মাস ঘুরতে না ঘুরতেই সেই বার্তা যে কতটা অন্তঃসারশূন্য তা প্রমাণিত হতে লাগছে। ভারতীয় সংবিধানের ২১ নম্বর ধারায় প্রত্যেক নাগরিকের জীবনের অধিকার অলঙ্ঘনীয় এবং ৪১ নম্বর ধারায় শিক্ষার অধিকারকে সুনিশ্চিত করার কথা উল্লেখিত আছে সাথে ৪৬ নম্বর ধারাতেও দুর্বল শ্রেণির মানুষের জন্য শিক্ষার প্রসারের কথা উল্লেখিত আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের পিএইচডির কোর্সে ভর্তির বিষয়ে একদা মাওবাদী নেতা অর্ণব দামকে যেভাবে বাধা দান করছেন রাজ্যপালের মদতপুষ্ট বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তা সংবিধানের পরিপন্থী।
প্রসঙ্গত, উল্লেখ্য, ২০১২ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর একদা মাওবাদী মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ অর্ণব দাম জেলে বসে তাঁর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাঠ সমাপ্ত করেন, প্রথম শ্রেণিতে ইতিহাসে স্নাতক হন এবং স্নাতকোত্তরেও প্রথম শ্রেণিতে পাশ করেন। পরবর্তী সময়ে গবেষণা ক্ষেত্রে পদার্পণ করার মনস্থির করেন এবং নিবিড় অধ্যয়নে রত হন। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জেল কর্তৃপক্ষের সমীচীন সাহায্য সর্বদাই পেয়েছিলেন অর্ণব, সংশোধনাগারের উপযুক্ত পরিকাঠামো ছাড়া স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়া এক জেলবন্দির পক্ষে সম্ভবপর নয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগ অবশ্যই তারিফযোগ্য, সংশোধনাগরের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে তারা যেভাবে বাস্তবায়িত করেছে তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ২০১৯ সালে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে, অর্ণব দাম জেল কর্তৃপক্ষের কাছে স্টেট এলিজিবিলিটি টেস্ট অর্থাৎ গবেষণা ও সহকারী অধ্যাপনা করার ছাড়পত্র যে পরীক্ষা প্রদান করে তা দেওয়ার আবেদন জানান। জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করে এবং পরীক্ষায় বসার অনুমতি দেয়। মেধাবী ছাত্র অর্ণব এই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গবেষণার ছাড়পত্র পান। ২০২৪ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডির পরীক্ষায় আবেদন করেন এবং গবেষণা অনুসন্ধিৎসু মনের অর্ণব পিএইচডির পরীক্ষায় ইতিহাস বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ২০১৯ সালের তৎকালীন কারামন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস স্বয়ং হুগলি জেলে বন্দি অর্ণবের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে তাঁর উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেই মোতাবেক জেল কর্তৃপক্ষের সমস্ত সহযোগিতা অর্ণব পেয়েছেন। নব্বই-এর দশকের শেষ থেকে মাওবাদী সমস্যা গোটা ভারতেই বিস্তার লাভ করেছিল, সেই মতাদর্শে আচ্ছন্ন হয়েছিল অনেক কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত তরুণ-তরুণী, অর্ণবও তাঁদের মধ্যে একজন। আইআইটি খড়্গপুরের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মেধাবী ছাত্র অর্ণব হয়ে উঠেছিলেন জঙ্গলের মাওবাদী নেতা। ২০১১-এর পরবর্তী সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা মাটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জঙ্গলমহলে শান্তি ফিরেছে, মাওবাদী সমস্যা নির্মূল হয়েছে, মহুল পলাশের সুবাস মানুষ গ্রহণ করতে শুরু করেছে, অর্ণবরা আজ গবেষণার মাধ্যমে আলো দেখতে শুরু করেছেন। কিন্তু বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে বিজেপির মদতপুষ্ট রাজ্যপাল এবং তাঁর নিয়ন্ত্রিত বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। বর্তমান কারামন্ত্রী অখিল গিরি তাঁর কারা বিভাগকে অর্ণব দামের সাথে সম্পূর্ণ সহযোগিতার নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁর মন্ত্রক চায় গবেষণা অনুসন্ধিৎসু অর্ণব যাতে নির্বিঘ্নে তাঁর গবেষণা সম্পাদনা করতে পারেন। প্রয়োজনে হুগলির সংশোধনাগার থেকে সরিয়ে তাঁকে বর্ধমানের সংশোধনাগারে আনার পথ খোলা রাখছে কারা মন্ত্রক। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও অর্ণবের গবেষণার বিষয়ে সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সমস্ত বিভাগের পিএইচডির ভর্তির প্রক্রিয়া শেষ করলেও অজ্ঞাত কারণে ইতিহাস বিভাগের ভর্তির প্রক্রিয়াকে স্থগিত রেখেছে, সহজেই অনুমান করা যায় যে, ইতিহাস বিভাগের পিএইচডির পরীক্ষায় প্রথম হওয়া অর্ণবের গবেষণাকে নিয়ে টালবাহানার জন্যই এই স্থগিতাদেশ। ইতিমধ্যে সারাদেশে সর্বভারতীয় নেট পরীক্ষার দুর্নীতির যে ছবি সর্বসমক্ষে এসেছে সেখান থেকেই পরিষ্কার হওয়া যায়, বিজেপির নেতৃত্বাধীন এই এনডিএ সরকার ছাত্র-ছাত্রীদের গবেষণার বিষয়ে কতটা উদাসীন ও বিরুদ্ধাচারণকারী। গত এনডিএ সরকারের আমলে গবেষণার ফেলোশিপ শিক্ষা মন্ত্রকের অধীনস্থ সংস্থা ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশন (ইউজিসি) বন্ধ করে দিয়েছেল, সারাদেশ উত্তাল হয়েছিল এর প্রতিবাদে। কেন্দ্রীয় সরকার কর্ণপাত করেনি। তবে, গবেষকদের সেই বেদনাকে হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, গবেষকদের জন্য চালু করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ ফেলোশিপ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সর্বদাই সমস্ত স্তরের গবেষকদের বিষয়ে যত্নশীল।
আরও পড়ুন-কথা দিয়েছিলেন অভিষেক, রাস্তা পেয়ে আপ্লুত শিক্ষক
আসলে গবেষণা মানে নতুন বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা, নতুন কার্যকারণ সম্পর্ক নির্দেশ, সেই নতুন চিন্তাকে ভয় পায় ভারতীয় জনতা পার্টি, তাই এই বিজেপি-পোষিত রাজ্যপাল এবং তাঁর অঙ্গুলিহেলনে চলা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কোপ মেরেছেন অর্ণবের গবেষণায়। এই কাজের পিছনে ক্ষমতায়নের এক সামাজিক মনস্তত্ত্ব কাজ করে, প্রান্তিক গোষ্ঠীর কোনও মানুষকে অভিজাত বর্গের মধ্যে প্রবেশ করতে দিতে চায় না ভারতীয় জনতা পার্টির মতো স্বৈরাচারী শক্তি। যেই প্রান্তিক মানুষগুলো অভিজাত কেন্দ্রে প্রবেশ করলে স্বৈরাচারী শক্তিকে প্রশ্ন করবে, এই প্রান্তিক গোষ্ঠীর মধ্যে থাকে নারীরা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, দলিত মানুষ এবং অর্ণবরা।
ওয়েস্ট বেঙ্গল কলেজ অ্যান্ড ইউনিভার্সিটি প্রফেসরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তথা শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু-সহ এই সংগঠনের সহ-সভাপতি মণিশঙ্কর মণ্ডল ও সুমন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রাক্তন সাংসদ কুণাল ঘোষ উদাত্ত চিত্তে অর্ণব দামের এই গবেষণার প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানিয়েছেন, সমর্থন জানিয়েছেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ ও অন্যান্য ছাত্রছাত্রী। কেবলমাত্র বাধা প্রদান করেছেন উপাচার্য স্বয়ং, কোনও যথাযথ কারণ তিনি দেখাতে পারেননি। ভারতীয় জনতা পার্টির মদতপুষ্ট রাজ্যপাল এবং তাঁর নির্দেশে চলা উপাচার্যের এই যুক্তিহীন, স্বৈরতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক কাজের বিরুদ্ধে আগামী দিনে জনমত আরও তীব্রতর হবে এবং সাধারণ মানুষ মন থেকে এই অনাচারকে প্রত্যাখ্যান করবে।