ইডি বা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের কাজের গতি হঠাৎ বেড়ে ওঠার নিষ্ঠা কি আসলে অতিসক্রিয়তার আড়ালে রাজনৈতিক প্রভুদের প্রতিহিংসার অঙ্গুলিহেলন? এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছে সর্বত্র।
আরও পড়ুন-মহামায়ার মহালয়া
১৯৪৭ সালের ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্টের (ফেরা) মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের ইকনমিক অ্যাফেয়ার্সের ডিপার্টমেন্টের গর্ভে ১৯৫৬ সালের পয়লা মে এনফোর্সমেন্ট ইউনিট নামক তদন্তকারী সংস্থার আত্মপ্রকাশ। রেভিন্যু সারভিস এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের জনাকয়েক অফিসার, সঙ্গে তিন পুলিশ ইন্সপেক্টর নিয়ে পথ চলা শুরু এই ইউনিটের। পরের বছর (১৯৫৭) নাম পাল্টে এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টোরেট (ইডি), ১৯৬০ সালে ইকনমিক অ্যাফেয়ার্স থেকে এই সংস্থাকে আনা হল ফাইনান্স মিনিস্ট্রির অধীনে রেভিন্যু ডিপার্টমেন্টে। ১৯৭৩ সালে ‘ফেরা’তে এমেন্ডমেন্টের মাধ্যমে এদের ক্ষমতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ফরেন এক্সচেঞ্জ নিয়ে এদের নাড়াচাড়ার শুরু। ফরেন এক্সচেঞ্জ কোন দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিদেশ থেকে প্লাস্টিক, পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্ট থেকে ভোজ্য তেল, ইলেক্ট্রনিকস সরঞ্জাম থেকে লোহার আকরিক ইত্যাদি যা কিছু আমদানি তা ডলার কিংবা বিদেশি মুদ্রার বিনিময়ে। শ্রীলঙ্কাতে এই ফরেন এক্সচেঞ্জ নিঃশেষ হয়ে যাওয়াতেই এই দেশ আজ দেউলিয়া, দুবাইয়ে তারা যতই ক্রিকেটের এশিয়া কাপ জিতুক না কেন! পরের দেউলিয়া হতে যাওয়া দেশ কারা? কেন এশিয়া কাপে রানার্স আপ পাকিস্তান রয়েছে না!
আরও পড়ুন-ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর চাঁদের উলটো পিঠ
দেশে বিভিন্ন অসাধু উপায়ে (ঘুষ, দুর্নীতি, কাটমানি, ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা ইত্যাদি) রোজগার করা কালো টাকা বিদেশে পাচার করে, বিদেশে কয়েক হাত ঘুরিয়ে ফের এনজিও বা নানান ফিকিরে দেশে সাদা করে ফিরিয়ে আনা আটকাতে এই ফেরা-র প্রয়োগ। অস্ত্র থেকে ড্রাগের আমদানি কিংবা সন্ত্রাসবাদে ফান্ডিং-এও এই কালো টাকারই রমরমা আর এসবই দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক। কালো টাকা আটকাতেই রয়েছে ইডি-র সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা।
১৯৯১ সালে লিবারেলাইজেশন, প্রাইভেটাইজেশন এবং গ্লোবালাইজেশন এই তিন মূল মন্ত্রের সূত্র ধরে দেশ জুড়ে শুরু হয়ে যায় খোলা বাজার এবং কর্পোরেট কালচার।
আরও পড়ুন-ও নদী রে
ফেরা আইন থাকলেও তেমনভাবে ফরেন এক্সচেঞ্জ নিয়ন্ত্রনে রাখা যাচ্ছিল না তাই অর্থনীতিতে ১৯৯৯ সালে ‘ফেরা’র সংস্কার করে তার পরিবর্তে সিভিল আইন ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্টের (ফেমা) জন্ম। আরও বেশ খানিকটা ক্ষমতা বৃদ্ধি হল ইডি-র। ফরেন এক্সচেঞ্জে কিছুটা উন্নতি হলেও বেআইনি অস্ত্র, ড্রাগ এবং সন্ত্রাসবাদ আটকাতে বিদেশে টাকা পাচারে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছিল না তাই ২০০২ সালে আরও কড়া আইন প্রণয়ন হল, প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট। ভারতীয় সংবিধানে ইডির উল্লেখ নেই তাই এটি কন্সটিটিউশন্যাল বডি নয় কিন্তু ফেমা-তেই সেকশন ৩৬শে এই আইনকে স্ট্যাটিউটারি বডি বলা হয়েছে।
নতুন উপদ্রব শুরু হল এর পরে, বেশ কিছু বড় বড় অসাধু ব্যবসায়ী ব্যাঙ্ক থেকে ব্যবসার নামে বড় অঙ্কের লোন নিয়ে তাঁদের সম্পত্তি গুটিয়ে বিদেশে ট্রান্সফার করে বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছে আর তার ঋণের বোঝা পড়ছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। বিদেশে পালিয়ে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে আরও একটি আইনের প্রণয়ন ঘটল ‘দ্য ফিউজিটিভ ইকনমিক অফেন্ডারস্ অ্যাক্ট’ ২০১৮। এই আইনে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ঋণখেলাপিদের দেশে পড়ে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির দখল এবং নিলাম (অ্যাটাচ এবং কনফিসকেট) করা যাবে। এই অপরাধে ললিত মোদি, মেহুলভাই চোক্সি, নীরব মোদি, বিজয় মাল্য, যতীন মেহেতা এবং আরও বহু নাম আজ দেশের সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। সব মিলিয়ে ঋণখেলাপিদের ঋণের পরিমাণ প্রায় তিরানব্বই হাজার কোটির মতো।
আরও পড়ুন-ঝুলন গোস্বামীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবেগঘন ট্যুইট মুখ্যমন্ত্রীর
টাকা পাচার আটকাতে এই সব আইনে বেশ খানিকটা সহায়তা পাওয়া গেল কিন্তু সরকারের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রয়োগের ভিন্নতা রাজনৈতিক নেতা, শিল্পপতি, বড় ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহের উদ্রেক করেছে। এই আইনেই রয়েছে ইডি অফিসার চাইলে এফআইআর ছাড়াই মানি লন্ডারিং অ্যাক্টে যে কোনও সন্দেহজনক ব্যক্তির ইন্ডাস্ট্রি, ব্যবসার ক্ষেত্র কিংবা বাড়িতে রেড করতে পারবে। সেক্ষেত্রে ইডি অফিসারদের এনফোর্সমেন্ট কেস ইনফরমেশন রিপোর্টই (ইসিআইআর) যথেষ্ট, অভিযুক্তকে শুধু মুখে বললেই হল তার কপি দেওয়ারও বালাই নেই। তদন্ত করে গ্রেফতার এবং তার সন্দেহজনক প্রপার্টি অ্যাটাচ কিংবা কনফিসকেট (নিলাম) করতে পারবে। উদ্ধার হওয়া টাকা কিংবা সম্পত্তির উৎস অভিযুক্তকে প্রমাণ করতে হবে এটা তাঁর হকের কামাই, প্রমাণের দায়িত্ব প্রসিকিউশনের নয়। আরও মজার বিষয় হল এই আইনে জামিন পাওয়া খুবই কঠিন, সিজ করা টাকা বা প্রপার্টির ডাবল সিকিওরিটি জমা রাখতে হবে নইলে গ্রেফতার হওয়ার পর একেবারে ট্রায়াল শেষেই সাজা নয়তো মুক্তি পেতে হবে। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে চাপ দিয়ে, ভয় দেখিয়ে, লোভ দেখিয়ে কিংবা মারধর করে আদায় করা স্টেটমেন্ট ইডির তদন্তকারী অফিসার তার বিরুদ্ধে কোর্টে ব্যবহার করতে পারবে (এই নিয়ম আবার সংবিধানে প্রদত্ত ফান্ডামেন্টাল রাইটসের পরিপন্থী)। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যারা এই মানি লন্ডারিংয়ে সহযোগিতা করবে, টাকার ভাগ কিংবা পরোক্ষভাবে সুবিধা নেবে তাদেরও শাস্তি অপরাধীর সমান, এই প্রভিশনটিও প্রশ্নাতীত নয়।
আরও পড়ুন-নিউ গড়িয়া-রুবি মেট্রোর ট্রায়াল শুরু
আইনে আবার গোল বেধেছে অন্যত্র, ক্রিমিন্যাল প্রসিডিওর কোড কিংবা ইন্ডিয়ান পেনাল কোড অনুসারে যে কোনও কেসের তদন্ত করতে গেলে এফআইআর প্রয়োজন। তা ছাড়াও এই নিয়েই সুপ্রিম কোর্টে অনেকগুলি মামলা হল। প্রায় ২৪১টি পিটিশন একত্র করে বিগত জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্ট শুনানি করে জানিয়ে দিল টাকা পাচারে একটু কড়া আইনই প্রয়োজন নাহলে মানি লন্ডারিং আটাকনো যাচ্ছে না। প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে, তাই আপিল মামলা সুপ্রিম কোর্টে পেন্ডিং রয়েছে এবং তা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
আরও পড়ুন-লিগে খেলবে না মোহনবাগান
ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা আনতে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আইন প্রণয়ন আগেও হয়েছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রয়োগ হয়েছে। কিন্তু আজকের এই অদ্ভুত পরিস্থিতি আগে কোনওদিন আসেনি। আইন প্রণয়নের পর ২০০৫ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ১১২টি সন্দেহজনক অপরাধীর ক্ষেত্রে ইডির রেড হয়েছিল কিন্তু ২০১৪ থেকে ২০২২ এখনও পর্যন্ত রেড হয়েছে ৩০১০টি। ৪,৯৬৪ টিইসিআইআর ফাইল হয়েছে এবং সব মিলিয়ে ৯৯,৩৫৬ কোটি টাকা কনফিসকেটেড হয়েছে। মজার কথা এই, রেডগুলো পি চিদাম্বরম, কার্তি চিদাম্বরম, মুম্বইয়ের সঞ্জয় রাউত, দিল্লিতে মণীশ শিশৌদিয়া এবং আমাদের পশ্চিমবাংলায় বারবার হয়েছে। রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে ৯৪% আর বাকি সকলের বিরুদ্ধে মাত্র ৬%। পক্ষপাতিত্ব কি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে? সাধে কি আর বিরোধীরা বলছে শাসক-বিরোধী ব্যবসায়ীরা ভয় পেয়েছে ব্যবসা করতে, শাসকের রক্তচক্ষু দেখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে বাইরে ব্যবসা করতে, তাহলে বেকারদের আর চাকরি হবে কী করে? যে রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে রেড হচ্ছে তাঁদের বিরুদ্ধে জনমানসে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে তাতে তাঁরা যদি ইডিকে বলেন ইলেকশন ডেস্ট্রয়ার তাহলে কি তাঁদের তেমন দোষ দেওয়া যাবে?