ঋতু বদলের অসুখে

ঝড়-বাদলের রেশ কাটিয়ে উত্তুরে হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আসছে শীত। আর সেই সঙ্গেই ভাইরাসদের বাড়বাড়ন্ত। ঋতু পরিবর্তনের এই সময় জ্বর, সর্দি, কাশি সামাল দেবেন কীভাবে জানালেন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জেরিয়াট্রি মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান ডাঃ অরুণাংশু তালুকদার

Must read

ঝড়-বাদল পেরিয়ে আবার সোনা রোদের মুখ দেখল আকাশ বাতাস। উত্তুরে হাওয়া মন্দ-মন্দ বইতে শুরু করেছে। আবহাওয়া দফতরের বক্তব্য অনুযায়ী আর আপাতত কিছুদিন ঝড়, জল, বৃষ্টির আশঙ্কা নেই। কিন্তু আবার তৈরি হতে পারে নিম্নচাপ। এখন নিম্নচাপের গতিপ্রকৃতি বোঝা দায়। ঋতু পরিবর্তনের ঘণ্টা বেজে গেছে আর শুরু হয়ে গেছে নানারকম অসুখবিসুখ। ঘরে ঘরে জ্বর-সর্দি-কাশি, গা-হাত-পা যন্ত্রণা, জ্বর না থাকলেও সারাক্ষণ একটা জ্বর-জ্বর ভাব, মাথা যেন ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। কিছুতেই স্বস্তি নেই। এই সময় একবার ঠান্ডা লাগলেই বিপদ। সহজে ছাড়বে না, চলতেই থাকবে শীত জুড়ে।

আরও পড়ুন-বিদ্যাসাগর সেতুতে বেসরকারি যাত্রিবাহী বাসে আগুন

টানা বৃষ্টির পরেও এতটুকু কমেনি গরম অর্থাৎ বৃষ্টি, গরম, ঘাম একসঙ্গে। আবার গত কয়েকদিন ধরে ভোরের দিকে ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া। আবহাওয়ার বদল ঘটছে, কুয়াশাও পড়ছে। তাপমাত্রার এই হেরফেরের প্রভাবে ঠিক এই সময় থেকে অ্যালার্জিক হাঁচি, সর্দি, কাশি, জ্বর-জ্বর ভাব, রানিং নোজ বা নাক দিয়ে জল পড়া, শ্বাসকষ্ট— এগুলো হতে দেখা যায়। একে চিকিৎসার পরিভাষায় অ্যালার্জিক রাইনাইটিস বলে। বিশেষ করে এই সময় বাতাসে যেহেতু ধূলিকণার পরিমাণ অনেক বেশি থাকে আর ভোরের দিকে বেলা পর্যন্ত যত বেশি কুয়াশা পড়তে শুরু করবে তত বেশি ধূলিকণা থাকবে নিচের দিকে এবং তার প্রভাবে হাঁচি, কাশি, গা-ব্যথা শুরু। কিন্তু আবার হয়তো দেখা যাবে তিন-চার দিন পরে কমেও গেছে। এই যে তাপমাত্রার রদবদল বৃষ্টি, ঠান্ডা, গরম এই সময় রেসপিরেটরি ভাইরাসগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, রেসপিরেটরি সিনিসিটিয়াল ভাইরাসগুলোর বংশবিস্তারের জন্য আদর্শ পরিবেশ। সেই জন্য এই ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু হবার সম্ভাবনা বেশি।
কী করে বুঝবেন
সমস্যা হল কী করে বুঝব অ্যালার্জি হয়েছে না কোনও ধরনের ভাইরাসঘটিত। যদি নাক দিয়ে জল পড়ে, হাঁচি, কাশি হয় কিন্তু দেখা গেল ২৪, ৩৬ বা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই উপসর্গ কমে গেছে তাহলে বুঝতে হবে কোনও রকম আবহাওয়ার বদলের কারণে বা ধুলোবালি থেকে হয়েছে। কিন্তু যদি ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ভাইরাল ফিভারের জন্য হয় তাহলে এই উপসর্গের সঙ্গে গলায় ব্যথা হয়, কাশি, গা-হাত-পা যন্ত্রণা হয়, লুজ মোশন বা পেট খারাপ হতে পারে, গা গোলাতে পারে, কারও কারও মাথার যন্ত্রণা হয়। যদি দেখা যায় শ্বাসনালি ছাড়াও শরীরের অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গেও কিছু সমস্যা হচ্ছে তাহলে এটাকে ধরে নেওয়া হয় যে ভাইরাল ফিভার। ইনফ্লুয়েঞ্জা, রেসপিরেটরি সিনসিটিয়িল ভাইরাস, কোল্ড ফ্লু ভাইরাস-এর কারণেও হতে পারে।

আরও পড়ুন-কাশ্মীরে মৃদু ভূমিকম্প

হতে পারে ডেঙ্গি বা ম্যালেরিয়া
প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে, হাড়ে হাড়ে ব্যথা হচ্ছে সেক্ষেত্রে ডেঙ্গিও কিন্তু হতে পারে। আবার যদি দেখা যায় হাঁচি, সর্দি নেই কিন্তু কাঁপুনি দিয়ে যদি জ্বর আসছে, মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা— তবে এই সময় ম্যালেরিয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ ডেঙ্গি এবং ম্যালেরিয়া কোনওটাই কিন্তু এখনও পুরোপুরি চলে যায়নি। ঋতু পরিবর্তনে এই সময় যদি দেখা যায় হাঁচি, সর্দি, কাশি একদিন বা দু’দিন আছে আর কোনও উপসর্গ নেই, মাথাব্যথা বা পেটের গন্ডগোল নেই তাহলে ক’দিন একটু বিশ্রাম নিতে হবে। জল বেশি করে খেয়ে যেতে হবে। সহজপাচ্য খাওয়াদাওয়া করতে হবে, হাঁচি-সর্দির জন্য অ্যান্টি হিস্টামিন জাতীয় ট্যাবলেট খেলেই এই উপসর্গ কমে যাবে। তবে জ্বর-জ্বর ভাবের সঙ্গে গা-হাত-পায়ে ব্যথা, মাথাব্যথা বা মাথাঘোরা তাহলে ধরে নিতে হবে ভাইরাল ফিভার। তাঁদেরও এই সময় বেশি করে জল খেতে হবে। রোগীর রক্তচাপ দেখে নিন। যদি প্রেশার লো থাকে তবে সঙ্গে সঙ্গে নুন-চিনির শরবত খাওয়াতে হবে। পুষ্টিকর খাবার একটু বেশি করে খেতে হবে। কিন্তু যদি দেখা যায় জ্বরের সঙ্গে প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা বা জ্বরের সঙ্গে কাঁপুনি তাহলে সঙ্গে সঙ্গে রক্তপরীক্ষা করে নেওয়া জরুরি। দেখতে হবে ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া হচ্ছে কি না বা টাইফয়েডের কোনও উপসর্গ আছে কি না।
টাইফয়েডের ক্ষেত্রে উপসর্গে হাই ফিভার, খুব দুর্বলতা, পেটব্যথা, গায়ে লাল ফুসকুড়ি ইত্যাদি যুক্ত হতে পারে। উচ্চমাত্রার জ্বর ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রেও হতে পারে। দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যান তাঁরাই বলে দেবে কী কী পরীক্ষা করতে হবে।
এই সময় জ্বর এলেই ভয় পাবার কিছু নেই এক-দু’দিন বিশ্রামে থাকুন সেই সঙ্গে প্রচুর জল খান। ৪৮ ঘণ্টা নিজেকে অবজার্ভ করুন। এর পরেও যদি জ্বর তিন-চারদিনে না কমে তাহলে চিকিৎসকের
পরামর্শ নিন।
শীত আসছে
সামনেই শীত আসছে। যাঁদের হাঁপানি রয়েছে বা ব্রঙ্কাইটিস রয়েছে তাঁদের এই সময় একটু শ্বাসকষ্ট শুরু হতে পারে। এর কারণ শীতকালে বাতাসে ধুলোবালির পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। এগুলো থেকেই মূলত শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। সেই কারণে আগেভাগে সাবধানতা অবলম্বন জরুরি। ঠান্ডা একেবারেই লাগাবেন না। এখন থেকেই মুখে মাস্ক পরুন। ঠান্ডা জল এবার এড়িয়ে যান। যাঁরা ধূমপান করেন তাঁরা বর্জন করুন বা কমিয়ে ফেলুন। এই সময় চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে বয়স্কদের ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন নিয়ে নিতে হবে। এর ফলেও অনেকটা সুরক্ষিত থাকা সম্ভব।
ছোটদের ঠান্ডা লাগলে
বাচ্চাদেরও এই সময় সমস্যা বাড়ে। শিশুদের শ্বাসনালি তুলনামূলক ভাবে বড়দের চেয়ে অনেক ছোট হয়। ফলে একটু সর্দি-কাশি হলেই বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। ঘড়ঘড় করতে থাকে। বুকে কফ বসে যায়। সেই কারণে ছোটদের খুব সাবধানে রাখুন। সর্দি-কাশি যেন না লেগে যায়। আর খুব বেশি ঘড়ঘড় করলে, শ্বাসকষ্ট শুরু হতে পারে— তাই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। তবে খুব বেশি চাপাচুপি দিয়েও রাখবেন না। এতে সর্দিগর্মি
হতে পারে।

Latest article