জেলিফিশের অমরত্ব

ডাইনোসরের থেকেও প্রাচীন মেরুদণ্ডহীন এক প্রকার থকথকে জেলি-সদৃশ্য প্রাণী যারা নাকি মৃত্যুকেও জয় করার ক্ষমতা রাখে আর জানে অমরত্বের রসদ। সত্যিই কি তাই! আজ তারই আলোচনায় প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

Must read

সমুদ্রের গভীরে কত প্রাণীরই না আনাগোনা, বিচিত্র তাদের রূপ, বিচিত্র তাদের চরিত্র, বিচিত্র তাদের জীবনযাপন, বিচিত্র তাদের বেঁচে থাকার কৌশল। সমুদ্রের গভীরে থাকা এরকমই একটি প্রাণী হল জেলিফিশ (Jellyfish) যারা নাকি অমর তারা তাদের যেকোনও ক্ষতিগ্রস্ত অংশকে অতি দ্রুত জুড়ে নিতে পারে। মনে করা হয় এরা পরিবেশের সমস্তরকম প্রতিকূলতাকে সহ্য করার শক্তি রাখে। তাই পরিবেশের যেকোনও তারতম্য এরা খুব সহজেই মানিয়ে নিয়ে টিকে থাকতে পারে পৃথিবীর বুকে, বহাল তবিয়তে।

পরিচয়
শুধুমাত্র একটি প্রাণীরই এই অসাধারণ ক্ষমতা আছে বলে জানা যায় : জেলিফিশের (Jellyfish) একটি প্রজাতির নাম টুরিটোপসিস ডোরনি, নিডারিয়া পর্বভুক্ত এই প্রাণীর আশ্রয়স্থল গভীর সমুদ্রের পাদদেশ। ছোট ছোট এই জেলিফিশগুলিকে সাধারণত ভূমধ্যসাগর ও জাপান-এর জলে পাওয়া যায়। ভূমধ্যসাগরে ১৮৮০-এর দশকে প্রথম এটি আবিষ্কৃত হয়। সমস্ত জেলিফিশের মতো, টুরিটোপসিস ডোরনি-ও একটি লার্ভা হিসেবে তার জীবন শুরু করে, যাকে প্ল্যানুলা বলা হয়, সাধারণত এটি একটি নিষিক্ত ডিম থেকে বিকাশ লাভ করে। একটি প্ল্যানুলা প্রথমে সাঁতার কাটে, তারপর সমুদ্রের তলদেশে গিয়ে নিজেদের মতো বসতি স্থাপন করে এবং একটি নলাকার কলোনির মতো অংশ বৃদ্ধি পায়, যাকে পলিপ বলা হয়। এগুলি শেষ পর্যন্ত মুক্তভাবে সাঁতারযোগ্য, জেনেটিক্যালি অভিন্ন কিছু মেডুসার জন্ম দেয় যাকে আমরা জেলিফিশ হিসেবে চিনি, এগুলি প্রায় কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠে।
সম্পূর্ণভাবে বেড়ে ওঠা, টুরিটোপসিস ডোরনি-র আকার হয় প্রায় 4.5 মিমি (0.18 ইঞ্চি)–এর মতো, যাকে দেখতে অনেকটা গোলাপি পেরেকের মতো লাগে। এদের দেহটি হয় স্বচ্ছ, যার মাঝখানে একটি উজ্জ্বল-লাল পেট দেখতে পাওয়া যায়, এদের প্রান্তগুলিতে ৯০টি পর্যন্ত সাদা শুঁড়। অদ্ভুতভাবে এই ক্ষুদ্র, স্বচ্ছ প্রাণীদের বেঁচে থাকার অসাধারণ দক্ষতা রয়েছে। শারীরিক ক্ষতি বা এমনকী অনাহারের প্রতিক্রিয়া হিসেবে, তারা তাদের বিকাশ প্রক্রিয়ায় প্রায় একেবারে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে আবার ফিরে যায় তাদের পলিপ দশায় তারা রূপান্তরিত হয় পলিপে। একটি প্রক্রিয়ায় পুনরায় জন্মগ্রহণকারী পলিপ কলোনি অবশেষে কুঁড়ি এবং মেডুসার জন্ম দেয়, যা আহত বা আঘাতপ্রাপ্ত প্রাপ্তবয়স্কদের সাথে জিনগতভাবে অভিন্ন, নতুন জন্ম পেয়ে একইভাবে তারা আবার ভেসে বেড়ায়। প্রকৃতপক্ষে, যেহেতু এই ঘটনাটি ১৯৯০-এর দশকে প্রথম পরিলক্ষিত হয়েছিল, তাই প্রজাতিটির এই জন্মের পুনরাবৃত্তির গুণটির কথা মাথায় রেখেই তাকে ‘অমর জেলিফিশ’ বলা হয়।

আরও পড়ুন- ক্রোড়পতি দুর্বৃত্তদের দল ওরা

কীভাবে ঘটে এসব?
ক্ষুদ্র অমেরুদণ্ডী প্রাণীটি কীভাবে বার্ধক্য-বিরোধী এই কীর্তিটি সম্পাদন করে তা খুঁজে বের করতেই বিজ্ঞানীদের একটি দল তাকিয়েছিল তাদের জিনোমের দিকে। প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস-এ অগাস্টে প্রকাশিত একটি গবেষণায়, স্পেনের ওভিডো বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানীরা প্রজাতিটিকে অন্যান্য জেলিফিশ প্রজাতির সাথে তুলনা করে দেখিয়েছেন যে তথাকথিত জেলিফিশগুলিতে দ্বিগুণ জিন রয়েছে যা মেরামত করে তাদের ডিএনএ রক্ষা করে। এই জিনগুলির সাহায্যে, জেলিফিশ (Jellyfish) তাদের দেহরক্ষাকারী এবং পুনরুদ্ধারকারী প্রোটিন তৈরি করতে পারে।
ডিএনএ-এর Telomere অংশ যা বয়সের সাথে সাথে ছোট হওয়ার জন্য যে-কোনও প্রাণীদের ক্ষেত্রে বার্ধক্য আসে তা এই জেলিফিশের ক্ষেত্রে খুব ধীরগতিতে ঘটে। আসলে এই জেলিফিশগুলিতে ঘটা জেনেটিক মিউটেশন এই ক্ষয়কে ধীর করে দেয়।
জেলিফিশগুলি তাদের দীর্ঘায়ু সংরক্ষণের জন্য একাধিক জেনেটিক উপায় ব্যবহার করে। এর পেছনের সেলুলার মেকানিজম একটি বিরল প্রক্রিয়া যা ট্রান্সডিফারেনটিয়েশন নামে পরিচিত। এই ট্রান্সডিফারেন্টিয়েশনের মাধ্যমে একটি প্রাপ্তবয়স্ক কোষ, যেটি একটি নির্দিষ্ট টিস্যুর জন্য পূর্বনির্দিষ্ট, তা একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের বিশেষ কোষে পরিণত হতে পারে। আর ঠিক এই কারণেই বিজ্ঞানীরা আশায় বুক বেঁধেছেন। চিকিৎসায় এর সম্ভাব্য প্রয়োগের রাস্তা অনুসন্ধানের জন্যই বিজ্ঞানীদের কাছে আজ এই জেলিফিশ বিশেষ আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে। আসলে এটি কোষ পুনর্ব্যবহার করার একটি কার্যকর উপায় এবং স্টেম সেল গবেষণায় অধ্যয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র যা ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলিকে প্রতিস্থাপন করতে সাহায্য করতে পারে। এই জেলিফিশ শুধুমাত্র একটি অসাধারণ বেঁচে থাকার কৌশলই জানে তা নয়। এটি একটি প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক আক্রমণকারীও। তাই গবেষকরা সম্প্রতি অমর এই জেলিফিশকে ‘চমৎকার হিচিকার’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, বিশেষ করে কার্গো জাহাজে দীর্ঘ ভ্রমণে বেঁচে থাকার জন্য এগুলি বিশেষভাবে উপযুক্ত।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বলতে গেলে জেলিফিশ (Jellyfish) কিন্তু ডাইনোসরের থেকেও প্রাচীন, হাড় নেই, তাই এদের জীবাশ্ম পাওয়া কঠিন। এই প্রাণীগুলি লক্ষাধিক বছর ধরে অতি নিশ্চিন্তে বসবাস করছে মহাসাগরের তলদেশে। বিজ্ঞানীরা বলেন এই প্রাণীগুলি আমাদের মহাসাগরে কমপক্ষে ৫০০ মিলিয়ন বছর ধরে বাস করছে। গবেষণায় প্রাপ্ত এই জেলিফিশগুলি ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের মহাসাগর জুড়ে। তাই তাদের নাগালে পাওয়া এমন কিছু বড় ব্যাপার নয়। সাধারণত এটিকে মানুষের বার্ধক্য অনুসন্ধানকারী হিসেবে কাজে লাগানোর কথা ভাবছেন বিজ্ঞানীরা। এমনকী স্টেম কোষ গবেষণার ক্ষেত্রে এরা যে কোনও ধরনের চিকিৎসায় বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত কোষ তথা অঙ্গকে প্রতিস্থাপিত করার কাজে সাহায্য করতে পারে। মৃত্যুকে ফাঁকি দেওয়ার কৌশলে পারদর্শী এসব ক্ষুদ্র, মেরুদণ্ডহীন জীব দিতে পারে মানুষকে অমরত্ব আর তাই তাই-ই বোধহয় এই ক্ষুদ্র প্রাণীটিকে নিয়ে বিজ্ঞানীরা এত আশাবাদী।

Latest article