২০১৬ সালে প্রথম গ্রিন করিডর ব্যবহার করে অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়েছিল বাংলায়। উত্তর ২৪ পরগনার স্কুলছাত্র স্বর্ণেন্দু রায় এক দুর্ঘটনায় জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। চিকিৎসকরা ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষণার পর পরিবার অঙ্গদান করার সিদ্ধান্ত নেয়। সন্তানের কিডনি, চোখ ও লিভার দান করতে সম্মত হন মৃতের বাবা-মা।
অগুন্তি মানুষের জীবনরক্ষায়, তাঁদের আবার নতুন করে বেঁচে থাকার আশা জোগায় অঙ্গদান। এর চেয়ে পবিত্র এবং মহৎ কাজ আর নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য এটাই যে, বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে অঙ্গদানের হার সবচেয়ে কম। এখানে প্রতিস্থাপনযোগ্য অঙ্গের চাহিদা জোগানের তুলনায় অনেক বেশি। তাই অঙ্গদানের গুরুত্ব, সচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্রতিবছর ১৩ অগাস্ট পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব অঙ্গদান দিবস। পরিসংখ্যান বলছে ১৪০ কোটির দেশে পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষ রোজ অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষায় দিন গুণছেন। যার মধ্যে এক শতাংশ মাত্র তাঁদের প্রয়োজনের অঙ্গটি পেয়েছেন। কাজেই সবার লক্ষ্য, হোক মানুষকে অঙ্গদান সম্পর্কে সচেতন এবং উৎসাহিত করা।
আরও পড়ুন-কেজরি জেলে, স্বাধীনতা দিবসে পতাকা তোলার অনুমতি মিলল না অতিশির
প্রথম অঙ্গদাতা
রোনাল্ড লি হেরিক প্রথম ব্যক্তি যিনি তাঁর অঙ্গদান করেছিলেন। তিনি তাঁর যমজ ভাই রিচার্ডকে কিডনি দান করেছিলেন। চিকিৎসক জোসেফ মারে সফল কিডনি প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেছিলেন। ১৯৯০ সালে সার্জন জোসেফ মারে এবং নেফ্রোলজিস্ট জন মেরিল অঙ্গ প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ার অগ্রগতিতে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ফিজিওলজি এবং মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার পান। প্রথমে ভারতে অঙ্গদান দিবসটি পালিত হত প্রতিবছর ২৭ নভেম্বর। কিন্তু ১৯৯৪ সালে ভারতে প্রথম মৃত দাতার সফল হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট দিনটিকে স্মরণ রেখে ২০২৩ সালে ১৩ অগাস্ট নতুন করে অঙ্গদান দিবস পালন শুরু হয়।
অঙ্গদান কী
কোনও রোগীর অঙ্গ বিকল হয়ে গেলে তখন তাঁর অঙ্গদানের প্রয়োজন হয়। কিডনি, হার্ট, অগ্ন্যাশয়, চোখ এবং ফুসফুসের মতো অঙ্গদান দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে।
কোনও জীবিত ব্যক্তি যাঁর দীর্ঘস্থায়ী রোগে কোনও একটি অঙ্গ বিকল হয়ে গেছে তাঁর অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রয়োজনে কোনও জীবিত বা মৃত ব্যক্তির থেকে জৈবিক টিস্যু বা কোনও একটি অঙ্গ নিয়ে তাঁর প্রতিস্থাপনের অনুমতি প্রাপ্তির প্রক্রিয়া হল অঙ্গদান।
অঙ্গদানের প্রক্রিয়া
অঙ্গদান দু’ভাবে হতে পারে
জীবন্ত অবস্থায় অঙ্গদান এবং মৃত অবস্থায় অঙ্গদান।
জীবিত দাতা অঙ্গদানের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর একটি কিডনি, একটি ফূসফুস, যকৃতের একটি অংশ, অগ্ন্যাশয়ের একটি অংশ এবং অন্ত্রের একটি অংশ দান করতে পারেন।
অন্য দিকে মৃত দাতা দুটি কিডনি, যকৃৎ, ফুসফুস, কর্নিয়া, হৃৎপিণ্ড, অগ্ন্যাশয়, অন্ত্র-সহ বিভিন্ন টিস্যু, হাত, মুখ— সব দান করতে পারেন।
যেসব অঙ্গদাতা জীবিত অবস্থায় অঙ্গদান করছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই অঙ্গদানের পরে কোনও নির্ভরতা ছাড়াই সুস্থ জীবনে ফিরেছেন। কারণ জীবিত ব্যক্তিদের অঙ্গদানের ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির সুস্থতাকে প্রথম প্রাধান্য দেওয়া হয়।
মৃত ব্যক্তির অঙ্গদানের ক্ষেত্রে যিনি দাতা তাঁকে হাসপাতালে, ভেন্টিলেটরে রাখা হয় এবং ব্যক্তি যে মৃত তা চিকিৎসক নিশ্চিত করেন তারপরেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়।
এই অবস্থায় ভেন্টিলেটরে থাকার সম্পূর্ণ খরচ বহন করে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল।
এ-ছাড়াও কোনও ব্যক্তির ব্রেন ডেথ হলে, সেক্ষেত্রেও সেই ব্যক্তির পূর্বসম্মতিতে অঙ্গদান করা সম্ভব। অর্থাৎ যদি তিনি আগে বলে গিয়ে থাকেন তবে পরবর্তীতে তাঁর নিকটাত্মীয় সেই অঙ্গ দান করতে পারে। মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে তাঁর অঙ্গদানের সিদ্ধান্ত পরিবার নিতে পারে।
চোখে গুরুতর কোনও সংক্রমণ না থাকলে যে কোনও ব্যক্তিই তাঁর কর্নিয়া দান করতে পারেন।
১৮ বছরের কমবয়সি ব্যক্তি অঙ্গদান করতে চাইলে তাঁকে বাবা-মা অথবা অভিভাবকের অনুমতি নিতে হবে।
চাইলেই মরণোত্তর অঙ্গদান সহজে করা সম্ভব নয় তার কারণ মৃত ব্যক্তিকে শারীরিকভাবে পরীক্ষা করার পরেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে তাঁর অঙ্গটি কাজে লাগবে কি না।
অঙ্গদানের অঙ্গীকার করার জন্য কোনও মেডিক্যাল টেস্টের প্রয়োজন হয় না।
ভারতে অঙ্গদান নিয়ন্ত্রণ করার আইন রয়েছে। অঙ্গ এবং টিস্যু প্রতিস্থাপন আইন মেনেই হয়। আইন একমাত্র জীবিত এবং মৃত ব্যক্তিকে অঙ্গদানের অনুমতি দিতে পারে।
আরও পড়ুন-সেনা-জওয়ানকে থানায় নগ্ন করে পেটাল বিজেপির পুলিশ
সবাইকে অঙ্গদানে উৎসাহিত করুন
অঙ্গদান নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে সেই সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা এবং সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়া সবচেয়ে জরুরি এই মুহূর্তে। অনেকেই একে ধর্মবিরুদ্ধ মনে করেন যেটা একেবারেই ভ্রান্ত। অঙ্গদানের মতো পবিত্র কতর্ব্য আর নেই।
অঙ্গদান করলে চেহারা বিকৃত হয়ে যাবে এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। একজন জীবিত অঙ্গদাতা চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে নিয়ম মেনে অঙ্গ দান করে সারাজীবন সুস্থ থাকতে পারে। এমনকী মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও শরীর থেকে অঙ্গ বার করে নেওয়ার পরে আবার সেই দেহ শেষকৃত্যের জন্য ফিরিয়ে দেওয়া হয় পরিবারকে।
অনেকেই মনে করেন বেশি বয়সে অঙ্গদান করা যায় না। আসলে কিন্তু বয়স কোনও ভাবেই অঙ্গদানের ক্ষেত্রে বাধা নয়।
একটি সমীক্ষা অনুযায়ী পরিবারের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করলে অনেক ভুল ভেঙে যায় অনেক কঠিন সময়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক সহজ হয়ে ওঠে। পরিবারে স্কুল, কলেজে যদি আলোচনা করা হয় অঙ্গদান নিয়ে তবে দিনে দিনে অঙ্গদানের হার আরও বৃদ্ধি পাবে।
রোজ একটু করে বেড়েছে রোগের প্রকোপ। ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন এবং ক্রনিক কিডনির রোগ সবই এখন লাইফস্টাইল ডিজিজ। যার কোনও ওষুধ হয় না। ফলে সময়ের আগেই অঙ্গ বিকলতার দিকে এগচ্ছে মানুষ। তাই বেড়ে চলেছে অঙ্গের চাহিদা, বিশেষত কিডনি এবং লিভারের। চাহিদা ছাড়াচ্ছে জোগানকে। ফলে বহু রোগী উপযুক্ত দাতার আগেই মারা যান তাই কেবলমাত্র সময়মতো অঙ্গদানই বাঁচাতে পারে এই সব রোগীর জীবন।