বাংলায় এবার শিল্পে সমৃদ্ধি বাংলায় এবার কর্মবৃদ্ধি

অনুকূল পরিবেশ রচনা করে, জমিনীতির জট কাটিয়ে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পে বিনিয়োগ আমন্ত্রিত। জননেত্রীর দূরদর্শী নীতির সুবাস দিকে দিগন্তে তরঙ্গায়িত। স্রেফ আবেগের উদ্গার নয়, তথ্য ও উপাত্তে এই চিত্র বিম্বিত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক দশকের বেশি সময় ধরে আন্তরিক প্রয়াসের ফসল এসব। লিখছেন বারাসত কলেজের বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক ড. রূপক কর্মকার

Must read

পশ্চিমবঙ্গ একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও শিল্পের ঐতিহ্য বহন করে। সময়ের ব্যবধানে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পসত্তার বিপুল পরিবর্তন হয়েছে যা আজ ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প ও চিত্রকলায় বিশ্বের নানান প্রান্তে সুপ্রসিদ্ধ। একটা সময় বিরোধী রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বাম নেতারা বলতে শুরু করেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের ভবিষ্যৎ শূন্য। কিন্তু বাম সরকারের আমলে বাম দলগুলির ট্রেড ইউনিয়নবাদ যে কত কলকারখানা বন্ধ করেছিল তার কিন্তু কোনও হিসাব নেই। পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের প্রধান সমস্যা ছিল জমির প্রাপ্যতা। তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার গঠনের গোড়ার দিকে একাধিক মঞ্চে শিল্প জগতের প্রতিনিধিরা প্রশ্ন তুলেছিলেন রাজ্যের জমি নীতি নিয়ে। কিন্তু তাই বলে সরকারের কাছে জমি চেয়েও পাননি এমন অভিযোগ করেননি কোনও উদ্যোগপতি। বরং উদ্যোগপতিদের সংশয় দূর করতে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারং বার তাঁদের আশ্বাস দেন রাজ্যের ল্যান্ড ব্যাঙ্কে পর্যাপ্ত জমি আছে।

আরও পড়ুন-স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নয়নে বরাকরে রাজ্যের ৫ কোটি ২৬ লক্ষ টাকায় গড়া হচ্ছে হাসপাতাল

শুধু তাই নয়, বিদেশি লগ্নি টানার উদ্দেশ্যে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বারংবার তাঁর সরকারি অধিকর্তাদের নিয়ে বিদেশে ছুটে গেছেন, তার ফল হয়তো এখন আমরা পাচ্ছি। আসলে সফলতা আসে দীর্ঘ পরিশ্রমের ফলে, আর মাননীয়ার চোখে আজকের দিনের যে স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে তা অনেক আগেই তিনি অনুমান করেছিলেন। ব্যবসার মাপকাঠিতে বিভিন্ন সুবিধার পরিবেশে এক সময়ে রাজ্য যেখানে পিছিয়ে ছিল তার অবশ্য কারণ ছিল যেমন বন্‌ধের রাজনীতি, ট্রেড ইউনিয়নগুলির অতিসক্রিয়তা, জমিদাতাদের বিক্ষোভ ইত্যাদি। এইসব সমস্যা পিছনে ফেলে বলা যায় পশ্চিমবঙ্গ এখন ‍‘শিল্পের গন্তব্য’, তারও কিছু কারণ অবশ্যই আছে, যেমন বন্‌ধের সংস্কৃতি আর নেই, পর্যাপ্ত পরিমাণ জমি আছে সরকারের হাতে, সুলভ ও দক্ষ শ্রমিকের সহজলভ্যতা ইত্যাদি। যে কোনও রাজ্যে শিল্পের দুটি স্তর আছে, তা হল ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প এবং বৃহৎ বা ভারী শিল্প। কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পোদ্যোগ রাজ্যের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যার ফলে রাজ্য সরকার MSME গুলোর দ্রুত উন্নতি ও বৃদ্ধিতে বিশেষ করে সমস্তরকম প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। MSME গুলিকে শুধুমাত্র পরিকাঠামো, অথনৈতিক বিনিয়োগ বা দক্ষতা বৃদ্ধিতেই নয়, তৎসহ Ease of Doing Business (EODB) এর মাধ্যমে সুষ্ঠু ব্যবসায়িক পরিবেশও নিশ্চিত করেছে। যার ফলস্বরূপ বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে প্রায় ৩৫৫৭০০ এর বেশি প্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রেশন পেয়েছে যা বিগত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। MSME তে ২০২২-২৩ এ ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ ও ২৫.৯৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বস্ত্রশিল্পে পশ্চিমবঙ্গে এক অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৬৮ কোটি ব্যয়ে ৪২৬ টি উন্নতমানের বিদ্যুৎচালিত তাঁত স্থাপন করা হয়েছে, যার মধ্যে ২৭৮টি তাঁত স্কুল ইউনিফর্ম প্রকল্পের জন্য কাপড় উৎপাদন শুরু করে দিয়েছে।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের ঝাড়গ্রামে মন্ত্রীর হাতে সূচনা লাল মাটির হাটের

পূর্ব বধমান জেলায় ৩৪.৩২ কোটি টাকার মেগা হ্যান্ডলুম ক্লাস্টার প্রকল্প হয়েছে তাতে ২০০০০ বেশি তাঁতশিল্পী ও কর্মী নিযুক্ত হবেন। বাংলার ঐতিহ্যশালী শাড়ি ‘তন্তুজ’ আজ বিশ্বের মধ্যে একটি ব্র্যান্ড তৈরি হয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার জয়গাঁছিতে আধুনিক টেক্সটাইল হাট নির্মাণ হয়েছে, যেখানে ২৫০০ বস্ত্র ব্যবসায়ী সুবিধা পাবেন। Scheme of Approved Industrial Park (SAIP) ২০২০ প্রকল্পের অধীনে ৪৪টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক গঠনের প্রস্তাব পাওয়া গেছিল যারমধ্যে প্রায় ১.৬০৭ একর জমির জন্য ১৫টি চূড়ান্ত এবং ২৩টি নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পরিসংখ্যান বোধহয় মিথ্যে বলে না। ২০২৩ সালে তন্তুজ, মঞ্জুষা, পশ্চিমবঙ্গ রেশম শিল্পী, বিশ্ববাংলা মার্কেটিং কর্পোরেশন এবং বঙ্গশ্রী সম্মিলিত ব্যবসার পরিমাণ প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। রাজ্যজুড়ে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পোদ্যোগ বিভাগে মোট ৩১টি মেলার সংযোজিত আয় ২৭৭.৭৭ কোটি টাকা। পশ্চিমবঙ্গ প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ। বিশেষ করে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম জেলার ব্যপক অংশের মানুষ খনিজ উত্তোলনের কাজে যুক্ত। তাঁদের বিজ্ঞানসম্মত ও সুস্থায়ী জীবিকার পথ নিশ্চিত করণে WBMDTCL ৮৭টি ‘অভিপ্রায় পত্র’(LOL) প্রকাশ করেছে। যা ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে খনিগুলিতে কাজ চালু হবে বলে আশা করা যায়। ২০২৩ সালে বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটে প্রায় ৪০টি দেশের ৪০০ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছিলেন। রফতানি ব্যবসার উন্নতির জন্য বিশ্বমানের ব্যবসায়িক পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য ওয়েস্ট বেঙ্গল এক্সপোর্ট প্রোমোশন পলিসি ২০২৩ গ্রহণ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন-সিঙ্গাপুরে গুকেশ-লিরেন লড়াই, ড্রয়ের হ্যাটট্রিক, বাকি এখনও ৮টি রাউন্ড

লজিস্টিক সেন্টারের বিকাশের জন্য ওয়েস্ট বেঙ্গল লজিস্টিক পলিসি গ্রহণ করা হয় এবং পরবর্তী পাঁচ বছরে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ হাইওয়েগুলির দু’পাশে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যবসায়িক করিডর গড়ে তোলা হবে। সুদূর ইংল্যান্ড থেকে ব্রিটিশ সরকারের হাত ধরে ব্রিটিশ ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ২০৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার প্রকল্পে, একই প্রকল্পে ম্যাগপেট সংস্থার হাত ধরে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। এই প্রকল্পে প্রায় ১০০০০ কর্মসংস্থান হবে। পর্যটনে পশ্চিমবঙ্গ এখন এক নম্বর। উত্তরবঙ্গে অব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত চা-বাগানগুলিতে পরিবেশবান্ধব পর্যটন প্রসারের জন্য দি ট্যুরিজম অ্যান্ড অ্যালায়েড বিজনেস পলিসি ২০১৯ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ৩১৬.৫৬ কোটি টাকার বিনিয়োগের অনুমোদন হয়েছে। বেঙ্গল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (BGCL) ৫৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে তাতে প্রায় ১৭ লাখ শ্রমদিবস তৈরি হবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহ, শিল্প এবং পরিবহণ ক্ষেত্রে গ্যাস সরবরাহ হবে ফলে বিভিন্ন পরিকাঠামোয় ব্যাপক উন্নতি হবে। দেউচা-পাঁচামির কয়লাখনি হোক বা অশোকনগরের তেল ও গ্যাসের ভাণ্ডার যে শিল্পের জোয়ার আনবে আগামিদিনে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু বিনিয়োগের প্রস্তাব নয়, বিভিন্ন প্রকল্পে যে বিনিয়োগের হচ্ছে তা আমরা স্বচক্ষে দেখতেও পাচ্ছি। বছর বছর বিনিয়োগর পরিমাণ যে আরও বাড়বে সেটা বিশ্বের তাবড়-তাবড় শিল্পকর্তাদের অর্থাৎ রিলায়েন্স, মাইক্রোসফট, উইপ্রো, টাটা, গোয়েঙ্কা, আদানি এবং অনান্য গোষ্ঠীর নজরে তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে। সমস্ত শিল্পদ্যোগীর কাছে পশ্চিমবঙ্গ এখন বিনিয়োগের সেরা স্থান। তথ্যপ্রযুক্তি হোক বা পর্যটন বা লজিস্টিক অথবা MSME, সব ক্ষেত্রেই বিপুল কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর চোখে বাংলা এখন‍‘সোনার খনি’ অর্থাৎ বিনিয়োগের সেরা ডেস্টিনেশন এখন বাংলা।
বিগত কয়েকবছরে শিল্পক্ষেত্রে যে নিঃশব্দ বিপ্লব এসেছে তা তথ্যপ্রযুক্তি হোক বা বিভিন্ন স্থানের শিল্পনগরীতে, তা চোখধাঁধানো। আগামী বছর শিল্প সম্মেলনে আরও কত চমক অপেক্ষা করছে বাংলাবাসীর জন্য তা এখন থেকেই অনুমেয়। আগামী কয়েক বছরে সব রাজ্যকে পেছনে ফেলে শীর্ষে উঠে আসবে পশ্চিমবঙ্গ, এটাই এখন বাস্তব। পশ্চিমবঙ্গ সত্যি সত্যি যে ‘বিশ্ব বাংলায়’ পরিণত হবে এবং কর্মসংস্থানে যে জোয়ার আসবে তা হয়তো এবছরের প্রস্তুতি বৈঠকেই আমরা বুঝতে পারছি।

Latest article