‘‘যে প্রেম তিনি পাননি, যে প্রেম শেষ হয়ে
গিয়েছে, যা আর কোনোদিনও ফিরে আসবে না,
জীবনানন্দ সেই অচরিতার্থ প্রেমের কবি।”
রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতায় জীবনানন্দই নিঃসন্দেহে কবি শ্রেষ্ঠ। তাঁর বেদনাভারাবনত স্বপ্নাবিষ্ট কবিতার কোমল ধূসরতায় পাওয়া গেল মহাজীবনের স্বাদ, পাওয়া গেল রবীন্দ্র-বলয়মুক্তির নিশ্চিত ঠিকানা। রবীন্দ্রনাথ যদি বর্ষা আর নদীর কবি হন, তবে জীবনানন্দ নিঃসন্দেহে হেমন্ত আর প্রান্তরের কবি। রবীন্দ্রনাথের পক্ষপাত যেখানে ‘প্রভাত আলো’র দিকে, সেখানে জীবনানন্দের পক্ষপাত ‘নৈশতা’র দিকেই। কিন্তু সন্ধ্যার রহস্য মদির অন্ধকার কিংবা কুয়াশার স্বপ্ন-নিবিড় ঘ্রাণ জীবনানন্দের কবিতা সম্পর্কে শেষকথা নয়। এক তীক্ষ্ণ রস-প্রগাঢ় ইন্দ্রিয়ানুভূতি এবং সমসাময়িক যুগের আশ্চর্য নিটোল কাব্য রূপায়ণ বাংলা সাহিত্যে সত্যিই দুর্লভ। জীবনানন্দ এক আশ্চর্য মৌলিক কবি। অনুভূতির এমন স্তরে পৌঁছে তিনি কবিতাচর্চা করে গেছেন, সাধারণ মানুষের পক্ষে সেই আরশিনগর স্পর্শ করে ওঠা প্রায় অসাধ্য। বাংলা ভাষাভাষী সমস্ত পাঠককে তাঁর কবিতার প্রসাদ ও মাধুরী দিয়ে প্রথমে তিনি আবিষ্ট করেন, পরে ক্রমশ পাঠকের মানসরাজ্য অধিকার করে রাখেন। একবার তাঁর কবিতায় মুগ্ধ বা আবিষ্ট হলে, সেখান থেকে মুক্তি পাওয়া তাই সহজ নয়। তিনি এক ধূসর স্বপ্নের মধ্যে আধুনিক যুগ এবং তার বেদনাকে দেখেছেন, কিংবা বলা চলে, আধুনিক যুগের মধ্যে দেখেছেন এক চিরায়ত ধূসর স্বপ্নকে। এই স্বপ্নহীন যুগে সেই স্বপ্নই জীবনানন্দ দাশ। ১২৫ ছুঁয়েও তিনি ভীষণভাবে সমসাময়িক, চিরনতুন ও আধুনিক। কেবল প্রেমের কবিতায় নয়, সময়ের আশ্চর্য কল্পনায় যে চিত্রকল্পের জগৎ তিনি নির্মাণ করে গেছেন, তুলনারহিত। বাংলা কবিতার পাঠক-সমাজের কাছে জীবনানন্দ দাশ একটি স্বপ্নের মতো গভীরচারী, একটি স্বপ্নের মতো স্বতন্ত্র-অস্তিত্ব। সমুদ্রের নীল, শূন্য বন্দর, বিকেলের উপকণ্ঠে সাগরের চিল, দৃঢ়তম দ্বীপ, নক্ষত্র, জাহাজ, রাত্রির জল, দারুচিনি, ইতিহাসের ধূসর জগৎ, ধানসিঁড়ি নদী, বাংলার ঘাস, গাঙুড়ের জলে, ফড়িঙের ঘন শিহরণ, পউষের রাত, পান্ডুর চাঁদ, কুয়াশার প্রান্তরের পথ-এ সমস্তই এক অপরূপ স্বপ্নবৃত্ত রচনার অম্লান উপকরণ। তাই তাঁকে কেউ বলেছেন ‘মিস্টিক’, কেউ বলেছেন ‘স্যুররিয়ালিস্ট’, কেউ বলেছেন ‘নির্জনতম কবি’, কেউ বলেছেন ‘পলায়নবাদী’। কিছু খণ্ডিত বিমুগ্ধতায়, প্রমোহে বা দৃষ্টিতে জীবনানন্দের কাব্যের বিচার চলে না। জীবনানন্দ প্রকৃতপক্ষে, জীবনবাদী কবি। সেই জীবন দেশকালোত্তীর্ণ নিরবচ্ছিন্ন নিত্য-প্রবহমান মহাজীবন। জীবনানন্দ সেই মহাজীবনের দক্ষ রূপকার, সেই মহাপৃথিবীর নিপুণ-চিত্রকর।
আরও পড়ুন-যৌননির্যাতনের শিকার ১০ বছরের শিশু
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ (১৯২৭) যেন প্রকাশোন্মুখ কবি-কিশোরের আত্মনিষ্ঠ বিষণ্ণতার শিল্পিত উচ্ছ্বাস। তারপর ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬) প্রকাশের মাঝখানে আট বছরের ব্যবধান কিন্তু ক্রমবিকাশের ব্যবধান দুস্তর। প্রকৃতির এক দুর্লভ প্রগাঢ়তা এক পরিপ্রেক্ষণীয় বৈচিত্র্য ও ব্যাপ্তি ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ‘রূপস বাংলা’য় আবার পট-বদল। এখানে কেশবতী কন্যার রূপ নিয়ে যখন নীল সন্ধ্যা আসে সবার চোখের ওপর তার কালো চুল ভাসে, অজস্র চুলের চুম্বন হিজলে কাঁঠালে অবিরাম ঝরে, তখন রূপসীর চুলের অফুরন্ত গল্পের বাহারে মনে সৃষ্টি হয় এক বিমুগ্ধ বিস্ময়। নরম ধানের গন্ধে, কলমীর ঘ্রাণে, হাঁসের পালকে, পুকুরে জলে সরপুঁটিদের মৃদুঘ্রাণে। কিশোরীর চাল-ধোয়া ভিজে হাতখানিতে, কিশোরের পায়ে-দলা মুথা ঘাসে, লাল বটফলের ব্যথিত গল্পের মধ্যে চিরন্তন বাংলাদেশের প্রাণের স্পর্শ মেলে। ‘রূপসী বাংলা’র পর এল ‘মহাপৃথিবী’। মানুষের বিকৃত জীবন ও বৃদ্ধি এই কাব্যের বিষয়। ‘মহাপৃথিবী’র আর-এক বৈশিষ্ট্য হল তির্যক শ্লেষ ও বিদ্রুপ। ‘মহাপৃথিবী’র সঙ্গে ‘বনলতা’ সেন-এর কাল-ব্যবধান নগণ্য, কিন্তু ভাব-ব্যবধান বিস্তর, বিপুল। ‘মহাপৃথিবী’র তিক্ততা আর নেই। আবার প্রেম, প্রকৃতি, জীবন ও মৃত্যু-মগ্ন চেতনায় ইতিহাসের দুর্মর প্রেরণারূপে ‘বনলতা সেন’ও ফিরে এসেছে। এখানে ধুমের ঘ্রাণ, রৌদ্রের গন্ধ, বালির ওপরে জ্যোৎস্না, বিচূর্ণ-খামের মতো দেবদারু-ছায়া, চন্দ্রমল্লিকার রাত্রি, শিঙের মতো বাঁকা নীল চাঁদ, হলুদ নদী, পাখির নীড়ের মতো চোখ সৃষ্টি করেছে নতুন এক জগৎ-এক রূপের জগৎ, মুগ্ধতার জগৎ-এক স্বপ্নের ‘আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়’। ‘বনলতা সেন’এর পরেই ‘সাতটি তারার তিমির’। ‘বনলতা সেন’ যেমন ইতিহাস-চেতনার জন্মন্তরীণ শব্দস্পর্শগন্ধময় অনবদ্য শস্য, ‘সাতটি তারার তিমির’ তেমনি সমকালীন সমাজ ও যুগ-জীবনের নির্মম সমালোচনা। যুদ্ধবিধ্বস্ত, ক্ষতবিক্ষত রক্তস্নাত
মানব-আত্মার করুণ বিকৃত প্রতিচ্ছবি। ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ তাঁর বেলাশেষের কাব্য (১৯৬১)। যুদ্ধোত্তর মানস-প্রশান্তিতে সুস্থ এক জীবন-চেতনা ফিরে এসেছে। বিদগ্ধ মনন ও সুদৃঢ় প্রত্যয় ‘বেলা-অবেলা’র ভিত্তিভূমি; হয়তো তা ছিল কোনো অনাগত অলিখিত কাব্যের পূর্বাভাস। কিন্তু তার পূর্বেই কবির আকস্মিক মৃত্যুতে (১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ২২ অক্টোবর মৃত্যু) সেই উজ্জ্বল সম্ভাবনারও হল মৃত্যু। ৫৬ বছরের জীবন পেয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ। একজন মৌলিক শিল্পীর জন্য এই আয়ুরেখা সামান্যই। তবু এই সময়পর্বেই তিনি অসামান্য সব কাজ করে গেছেন। লিখেছেন অনেক, অসংখ্যও বলা যায়, প্রকাশ করেছেন সামান্যই। তাঁর জন্মশতবর্ষে নানা ধরনের লেখা আবিষ্কারের চমকিত ঘটনা সামনে এসেছিল। তুতেনখামেনের গুপ্তধনের মতো কবির কালো ট্রাঙ্ক থেকে বেরিয়েছে শত জ্যোৎস্নার মাধুরী। কবিতাই শুধু নয়, গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ-লিটরারি নোটস, চিঠিপত্র ইত্যাদি নানা ধরনের লেখা। মৃত্যুর বহু বছর পর, কোনও বাঙালি লেখকের এত অজস্র অপ্রকাশিত লেখা উদ্ধারের ঘটনা অদ্ভুতই নয়, বিস্ময়করও। বিশ্বসাহিত্যে এমন অলৌকিক কাণ্ড আগে কখনও ঘটেনি। বিস্ময়কর, কেন-না জীবনানন্দ সেই কবি, যিনি বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। প্রতিদিনের জীবনযাপনে যেমন, প্রধানত শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আশ্চর্য রকমের খুঁতখুঁতে ও উৎকর্ষের চূড়া স্পর্শ করার প্রচেষ্টায় মগ্ন এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রী। কবিতা নির্মাণের শ্রেষ্ঠ রূপটিই জীবনানন্দ দিতে চাইতেন। কারণ, তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’।
কবিতার বাইরে জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, অজস্র গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। তাঁর ‘মাল্যবান’ উপন্যাস অসামান্য বললেও কম বলা হয়। তিনি প্রায় কুড়িটি উপন্যাস লিখেছেন। সেগুলোর মধ্যে ‘জলপাইহাটি’, ‘সুতীর্থ’, ‘কামবাসনা’ বা ‘কলকাতা ছাড়ছি’র মতো উপন্যাস বারবার ফিরে ফিরে পড়া যায়। আর তাঁর ছোটগল্প, কমবেশি একশো কুড়িটির মতো গল্প লিখেছেন। ‘জামরুলতলা’, ‘ছায়ানট’, ‘মেয়েমানুষের ঘ্রাণে’, ‘উপেক্ষার শীত’ তাঁর বিশিষ্ট গল্প। একইসঙ্গে লিখেছেন বেশ কিছু ভাবনা-জাগানিয়া প্রবন্ধ ও চিন্তামূলক গদ্য।
সাহিত্যের নানা মাধ্যমে কাজ করলেও জীবনানন্দ সার্বিকভাবে কবি হিসেবেই পাঠকমহলে পরিচিত। তাঁর খ্যাতি ও সাফল্য ধরা দিয়েছে কবিতায়। তাঁর এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতাসংখ্যা ছিল তিনশোর কম, ২৬২টি। তিনি ছিলেন সময়ের থেকে অগ্রসর ও আধুনিক কবি, যে-কারণে সমসাময়িককালে তিনি দুর্বোধ্য হিসেবেও চিহ্নিত ছিলেন। ভবিষ্যৎদ্রষ্টা এই কবি দারুণভাবে আজও প্রাসঙ্গিক ও সমসাময়িক। বরং সময়ই সবচেয়ে বড় বিচারক হায়ে ধরা দিয়েছে। ‘বনলতা সেন’ কবিতায় জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন—
‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন
আমারে দুদণ্ড শাস্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।’
আরও পড়ুন-শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পথে ধর্ষিতা হেড কনস্টেবল
কবি-বুকের তোরণ থেকে বেরিয়ে-আসা এই অব্যক্ত অনুভব ও আর্তি তো সমস্ত তরুণ-প্রেমিক হৃদয়ের।
হেমন্ত ছিল জীবনানন্দ দাশের প্রিয়তম ঋতু। ১৮৯৯ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি বরিশালের ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম-নেওয়া জীবনানন্দ তাঁর প্রিয় হেমন্তের এক রাতেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। কিছু অসমাপ্ত এবং বেশিরভাগই অপ্রকাশিত রেখে বড় বেদনায় চোখ বুজেছেন। কেন-না, লেখার ক্ষতি হবে ভেবে জীবন থেকে তিনি অনেক কিছু বাদ দিয়েছেন। যে মানুষটি বেঁচে থাকতে উল্লেখ করার মতো একটা জীবন পাননি; সবখানেই খামতি ও বেদনার গল্প জুড়ে ছিল দগদগে ঘায়ের মতো। ভাল কোনও চাকরি পাননি, স্ত্রী ভালবাসেননি, নিজের বাড়িতেও থাকতেন বহিরাগতের মতো, কিছুটা নাম হওয়ার পরেও তাঁর লেখা ফেরত আসত; সেই মানুষটি প্রগাঢ়ভাবে অনুভব করতেন-সামাজিক প্রভাব আর সাহিত্যিক দাপট আলগা হয়ে এলে কে শ্রেষ্ঠ তা সময়ই বলবে। বরং সময় কি আজ অনেকটাই প্রকাশ করে দেয়নি? হাজার লাইন লেখার পর কবিতার সুর, ছন্দ ও সুরভিতে বিশেষ দখল থাকলেই কেবল এমন কথা লিখে ওঠা যায়— প্রেম ধীরে মুছে যায়/নক্ষত্রেরও একদিন ঝরে যেতে হয়।