আহা মরি মরি মোদিতে মোদিতে…

জনপ্রিয় বাংলা গানের কথায় সামান্য বদল করা ছাড়া উপায় নেই। নইলে বোঝাতেই পারা যাবে না কী বিষ-জ্বালায় জ্বলছি আমরা মোদিত অর্থনীতির কল্যাণে। অভিজ্ঞতা আর উপাত্তের মিশ্রণে সে-কথাই তুলে ধরলেন আকসা আসিফ

Must read

মোদি জমানায় (Modi Era) অর্থনৈতিক পদক্ষেপের কথা উঠলেই প্রথমে মনে পড়ে নোটবন্দির কথা। কিন্তু স্বয়ং মোদির মুখে কি আর নোট বন্দির প্রসঙ্গ শোনা যায়?
তিনি রামমন্দিরের কথা বলেন। কাশ্মীর থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদের অবলুপ্তি বলেন। চন্দ্রযান, স্বচ্ছ ভারত, এমনকী জিএসটিও বলেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত তিন বছরে ধরে নিজের কৃতিত্ব-তালিকায় যা কখনও আর বলেন না, সেটি হল নোট বাতিল। শেষ কবে তিনি সভা, সমাবেশ, সংসদ, ভোটপ্রচার, মন কি বাতে নোট বাতিলকে নিজের অন্যতম সফল সিদ্ধান্ত হিসেবে দাবি করেছেন, সেটা গবেষণার বিষয়। কেন? কারণ, তাঁর সরকার জানে, এই শো পুরোটাই ফ্লপ।
জাল টাকার রমরমা ঠেকাতে মোদি সরকারের ব্যর্থতার চরম নমুনা পাওয়া গিয়েছে লোকসভায় সরকারেরই দেওয়া রিপোর্টে। একটি প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রক সংসদে জানিয়েছে, গত তিন বছরে ভারতে উদ্ধার হওয়া জাল টাকার পরিমাণ বেড়েছে তিনগুণ। আর এই রিপোর্ট খোদ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের। সবথেকে বিস্ময়কর হল, ৫০০ টাকার নোট তো জাল হচ্ছেই, ২ হাজার টাকার নোটও রয়েছে নকলের তালিকায়। অর্থমন্ত্রকের রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২১ সালে ৫০০ টাকার জাল নোট ধরা পড়েছিল ৩ লক্ষ ৯৪ হাজার ৫৩০টি। ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা হয়েছে ৯ লক্ষাধিক। ২০২৪ সালে সাড়ে ৮ লক্ষেরও বেশি। ২ হাজার টাকার নোট বাজেয়াপ্ত হয়েছিল ২০২১ সালে ৮৭ হাজার ৯৮০টি। আর ২০২৪ সালে সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে ২ লক্ষ ৬০ হাজার।
এই প্রতিবেদন লেখার সময় জানতে পারলাম, খাস কলকাতায় উদ্ধার বিপুল পরিমাণে জাল নোট। একেবারে শহরের প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলা থেকে আজ, বৃহস্পতিবার সকাল বেলায় উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ৩ লক্ষ টাকার জাল নোট। ঘটনায় কলকাতা পুলিসের এসটিএফ-এর হাতে পাকড়াও হয়েছে এক জন। ঘটনার পিছনে কোনও বড় চক্র কাজ করছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখছেন পুলিস আধিকারিকেরা।

২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর রাত ৮টার সময় টেলিভিশন সম্প্রচারের কথা মনে পড়ে? সেদিন প্রধানমন্ত্রী নাটকীয়ভাবে বলেছিলেন, ‘যখন দেশে কোনও সঙ্কট আসে, তখনই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।’ এরপরই ঘোষণা করেন, সেদিন রাত ১২টার পর ৫০০ টাকা এবং হাজার টাকার নোট বাতিল করে দেওয়া হল।
কেন?
প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কালো টাকা ‘ধ্বংস’ করার এটাই একমাত্র উপায়। তাহলেই দুর্নীতির গ্রাস থেকে বাঁচবে দেশ।
পরদিনই গোটা দেশে নেমে এসেছিল হাহাকার। মোদির আশ্বাস ছিল, ‘৫০ দিন সময়। তার মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’ ৫০ দিন দূরঅস্ত্‌, বছরের পর বছর কেটে গিয়েছে, মধ্যবিত্তের ভাঙা কোমর জোড়া লাগেনি। উল্টে বেড়েছে জাল নোট। এবং কালো টাকা। প্রশ্ন হল, ৫০০ টাকার পাশাপাশি ২ হাজার টাকার নোটও এত জাল হচ্ছে কেন? তাহলে কি বাজার অর্থনীতির আড়ালে সমান্তরাল কালো অর্থনীতি চলছে? কারণ, ২ হাজার টাকার লেনদেন বন্ধ। কারা নিচ্ছে জাল ২ হাজারি নোট? কারা দিচ্ছে? কোথায় যাচ্ছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর মোদি সরকার দিতে পারবে?
এখানেই শেষ নয়। গত ১০ বছর ধরে পরিসংখ্যান বারবার প্রমাণ দিয়ে চলেছে মোদি সরকারের সবচেয়ে বড় বন্ধু বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলো।
মোদি জমানার প্রথম পাঁচ বছরে প্রায় ১২ লক্ষ কোটি টাকা ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব নিয়ে তোলপাড় পড়েছিল। তার পরের পাঁচ বছর, অর্থাৎ ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অঙ্কেও কিন্তু খুব ফারাক হল না। সরকারি তথ্যই বলছে, এই সময়সীমায় প্রায় ১০ লক্ষ কোটি টাকার ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব হয়েছে। এবং তার সিংহভাগই কর্পোরেট। কৃষি এবং সমবায় ঋণ কিছু আছে বটে, তবে ১০ লক্ষ কোটি টাকার পাহাড়ে তা কয়েকটা নুড়ির সমান। আর তার সবটাই প্রায় ভোটের লক্ষ্যে। ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে।

আরও পড়ুন-কর্মবিরতির সময়ে স্বাস্থ্যসাথীর অপব্যবহারের তদন্ত করে শাস্তি

ঋণে ডুবে যায় কৃষক। বাড়তে থাকে সুদের পরিমাণ। আন্দোলন হয়। দাবি ওঠে, কৃষিঋণ মকুব করতে হবে। কিন্তু সেই আর্তি দিল্লির দরবারের অন্দরমহলে পৌঁছয় না। সেখানে অবাধ যাতায়াত শুধু কর্পোরেটের! ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষেই ২০ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার কৃষিঋণ দিয়েছে সরকার। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, ভারতে কৃষিঋণ শোধের হার যথেষ্ট ভাল। তারপরও কৃষকদের কোনও বাড়তি সুবিধা কর্পোরেটদের মতো দেওয়া হয় না। অথচ, ১৯৯০-’৯১ এবং ২০০৮-’৯ অর্থবর্ষে কিন্তু কৃষিঋণ মকুব হয়েছে। আর ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে? মকুব হয়েছে ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার ব্যাঙ্ক ঋণ। তার বেশিটাই কর্পোরেট। কৃষকদের মতো বেহাল দশা ছোট ব্যবসায়ীদেরও। গত ছ’বছরে প্রায় ৪১ হাজার সংস্থা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার জন্য আবেদন করেছে। গত ছ’মাসে সংখ্যাটা ২ হাজার ২৩৬। সংসদে একথা জানিয়েছেন স্বয়ং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। তাঁর বক্তব্য, ২০১৮-’১৯ থেকে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণের ভারে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে প্রায় ৪১ হাজার সংস্থা।
গত ১০ বছরে গরিবরা আরও গরিব হয়েছে, ফুলেফেঁপে উঠেছে ধনীরা। ২০১৯-’২০ অর্থবর্ষে সবথেকে বেশি ২ লক্ষ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ মকুব করেছিল ব্যাঙ্কগুলি। সেই ধারা বজায় রয়েছে। নীরব মোদিরা কিন্তু দেশে ফেরেননি।
এই হল মোদি-শাসিত ভারতের অর্থনীতির হাল-হকিকত। এর পরেও ছাপান্ন ইঞ্চি ছাতির গুণকীর্তন করবে ভারত!
কীভাবে? এবং, কেন?

Latest article