প্রাণের উৎস সন্ধানে

‘এ-মাটি সবুজ সবুজ, ও-আকাশ সোনা সোনা’— সবই এই পৃথিবীর প্রাণের মহিমা; কিন্তু কবে, কখন, কীভাবে, ঠিক কোথায় প্রথম প্রাণের উন্মেষ ঘটেছিল!? সাম্প্রতিক গবেষণার আলোকে প্রথম পর্বের আলোচনায় তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

জীবন বড্ড বেশিই প্রিয়! তাই তো বারবার আওড়াই, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ বাঁচতে চাই কারণ আমাদের একটি সুন্দর জীবন আছে; আর জীবনে রয়েছে ফুটফুটে প্রাণ—
প্রাণ তুমি কোথা থেকে আসছ?
তোমার উৎস কোথায়?
তুমি এই ধরাধামে কীভাবে এলে, কে তোমায় নিয়ে এল?
তুমি এই পৃথিবীর বুকে প্রথম কবে উদয় হয়েছিলে?
এই পৃথিবীর সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে এই প্রশ্নগুলো আজও মানুষের মনে অদম্য কৌতূহল জাগায়; বৈজ্ঞানিক মহলে এর সঠিক উত্তর খুঁজে পেতে চলছে নিরলস কর্মযজ্ঞ; তারই ফলস্বরূপ সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত গবেষণায় উঠে এসেছে, গভীর মহাসাগরের তল থেকে প্রাপ্ত পাথরের নমুনা প্রাণের উৎস সন্ধানে নতুন আলোর দিশা দেখাচ্ছে।
সাম্প্রতিক গবেষণা
এবছর গত ৮ অগাস্ট বিখ্যাত ‘সায়েন্স’ জার্নালে পৃথিবীর নানা দেশের ২৯ জন বিজ্ঞানীর একটি সম্মিলিত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে; বিজ্ঞানীরা সেই পত্রে দাবি করেছেন, তাঁরা হয়তো শীঘ্রই সমগ্র মানবজাতির সামনে এই পৃথিবীতে কোথায় কীভাবে কখন পার্থিব প্রাণের উন্মেষ ঘটেছিল তার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হবেন। তাঁদের ধারণা পৃথিবীর গভীর সমুদ্রের তলদেশে এমন একটি জায়গা রয়েছে, সেখানেই হয়তো প্রথম প্রাণের বিকাশ ঘটে।

আরও পড়ুন-উধাও বিজেপির প্রধান-উপপ্রধান পরিষেবা নেই, পঞ্চায়েতে তালা

পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত প্রাণের উৎস সন্ধানের যে নিবিড় কৌতূহল, তার উত্তর পাওয়ার আশায় বিজ্ঞানীদের ওই দলটি মধ্য আটলান্টিক মহাসাগরের গভীর তলদেশে বৈজ্ঞানিকভাবে কল্পিত হারানো সভ্যতা বা ‘লস্ট সিটি’র বুকে গভীর খননকার্য চালিয়েছেন তারই নমুনা সংগ্রহের আশায়। তাঁরা সম্প্রতি সেই নমুনা সংগ্রহ করতে পেরেছেন এবং এই নিয়েই দুনিয়াভর বৈজ্ঞানিক মহলে শুরু হয়েছে তীব্র আলোড়ন!
প্রথম প্রাণ প্রতিষ্ঠা কীভাবে হয়েছিল এই ধরাতলে, তা জানার জন্য পরীক্ষাগারে বৈজ্ঞানিকভাবে নানা তত্ত্বগত পেপার ওয়ার্ক এবং মডেলিং স্টাডিজ করা হলেও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এই বিশেষ প্রাপ্তি গবেষণার পরিসরে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। ‘বিল্ডিং ব্লকস অব অরিজিন’ খোঁজার উদ্দেশ্যে আয়োজিত গভীর সমুদ্রের বুকে খননকার্য যথার্থই প্রাণের উৎস সন্ধানের ক্ষেত্রে একটি নতুন ভিত্তি স্থাপন করবে, এমনটাই মনে করেন ভূবিজ্ঞানীরা।
এর আগে কোনও অভিযানে বিজ্ঞানীরা এত বহুল পরিমাণে নমুনা সংগ্রহ করতে পারেননি। এবারে বিজ্ঞানীরা প্রায় এক চতুর্থাংশ মাইল দৈর্ঘ্যের চোঙাকৃতি অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য পাথুরে নমুনা সংগ্রহ করতে পেরেছেন। এই গবেষণাপত্রটির প্রথম লেখক ইউনাইটেড কিংডমের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেসে কর্মরত শিলাতত্ত্ববিদ ড. সি জোহান লাইজেনবার্গ জানান, তাঁরা সত্যিই অভিভূত, ভাবতেই পারেননি যে এত সহজেই এত অসাধারণ দুর্লভ নমুনা তাঁরা সংগ্রহ করতে পারবেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, সাফল্যের সঙ্গে নমুনা সংগ্রহের সময় মনে হচ্ছিল তাঁরা যেন শিশুর দল যাঁরা একটি মুক্ত ক্যান্ডি স্টোরে আছেন এবং যা চাইছেন তাই যেন হাতের মধ্যে এসে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন-চলন্ত ট্রেনে আগুন, আতঙ্ক

সংগৃহীত নমুনা
বিজ্ঞানীদের কয়েক দশকের গবেষণায় বারবার উঠে এসেছে যে, সমুদ্রের অভ্যন্তরীণ উষ্ণ প্রস্রবণ এবং তার তলায় অবস্থিত পাথরসমূহ একপ্রকার ভূ-রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্ম দেয় যা হয়তো বহু শতাব্দী আগে পার্থিব প্রাণের উন্মথন ঘটিয়েছিল। এছাড়াও বিজ্ঞানীদের দৃঢ় ধারণা, পৃথিবীর পৃষ্ঠতল বা ক্রাস্ট এবং অন্তঃস্তল বা কোর অঞ্চলের মধ্যবর্তী ম্যান্টল অঞ্চল পৃথিবীর বুকে স্থলজ চুম্বকত্ব, পৃথিবীর পৃষ্ঠতলের গঠন, এবং তার সঙ্গে জলমণ্ডল বা হাইড্রোস্ফিয়ার, বায়ুমণ্ডল বা অ্যাটমোস্ফিয়ার, ও জীবমণ্ডল বা বায়োস্ফিয়ারের মধ্যে বিভিন্ন উপাদান চক্রের সুসংহতি বজায় রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এককথায় বলা যায় ম্যান্টল পৃথিবীতে প্রাণের উৎস সন্ধানে একটি মজবুত সূত্রের দিশা দিতে পারে।
মহাসাগরের তলদেশ খননের ফলে যদি পৃথিবীর ম্যান্টল অঞ্চল থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে পারা যায়, তাহলে তা পরীক্ষার মাধ্যমে আদিমতম প্রাণ রসায়নের হদিশ পেতেই বারমুডা প্রদেশ থেকে পূর্ব দিকে প্রায় ১৪০০ মাইল দূরে মধ্য আটলান্টিক মহাসাগরের নিম্ন দেশে স্থিত ‘লস্ট সিটি’তে ‘সায়েন্টিফিক ড্রিলিং’ করা হয়। এর ফলেই বিজ্ঞানীদের হাতে আসে ১২৬৮ মিটার লম্বা চোঙাকার নমুনা প্রস্তর পিণ্ড! সংগৃহীত নমুনা প্রস্তরই প্রাণের উৎস সন্ধানের কেন্দ্রীয় গবেষণার বিষয়।
আমেরিকার ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের আর্থিক তত্ত্বাবধানে ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর স্ক্রিপস ইনস্টিটিউট অব ওশিয়েনোগ্রাফির ড. ডোনা ব্লাকম্যান, ডিউক ইউনিভার্সিটির ড. জেফরি কার্সন, এবং ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ড. দেবরাহ কেলি আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে ‘লস্ট সিটি’কে আবিষ্কার করেন। এই অঞ্চলটি সমুদ্র তলদেশের আটলান্টিস ম্যাসিফ পর্বতের পাশে, যেখানে একটি অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্ট ফাটল সমুদ্রতলের সঙ্গে আড়াআড়িভাবে অবস্থান করছে সেখানে অবস্থিত।
ওই অতল সামুদ্রিক স্থানে উষ্ণ জলের ঝরনা বিদ্যমান থাকায় জলের ধারা ধিকিধিকি উপরের দিকে উঠতে থাকে এবং উপস্থিত খনিজ পদার্থগুলোকে উপরাংশের বরফশীতল সামুদ্রিক জলের সাথে বিক্রিয়ায় উত্তেজিত করে। সমুদ্রের গভীরে তৈরি হয় খাঁজকাটা অমসৃণ বিশাল বিশাল ভয়ঙ্কর অতিপ্রাকৃত সূক্ষ্মনাগ্রী চূড়া বা শিখর। সৃষ্ট পাথরের পাহাড়গুলো পিরামিড বা মোচা আকৃতির হয়ে থাকে; সবচেয়ে উঁচু চূড়াটি প্রায় একটি ২০তল বিল্ডিংয়ের সমান। বৈজ্ঞানিকদের বিশ্বাস এইপ্রকার জলতাপীয় বিক্রিয়া অঞ্চল নতুন কোষ সৃষ্টির পক্ষে অভাবনীয়ভাবে অনুকূল। তাই এই অঞ্চলে এত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান।

আরও পড়ুন-৮ দিনের সিবিআই হেফাজতে সন্দীপ

বৈজ্ঞানিক উত্তমাশা
এই অভাবনীয় ম্যান্টল ব্রেকথ্রু, পৃথিবীর প্রায় ২০টিরও বেশি দেশের সামগ্রিকভাবে একটি দানব জাহাজের সাহায্য নিয়ে সমুদ্রের তলদেশ খনন করার মহতী অভিযান ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল ওশেন ডিসকভারি প্রোগ্রাম’-এর অংশবিশেষ। আমেরিকার নাসার অন্তর্গত ক্যালিফোর্নিয়া স্থিত জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরির একজন ভূ-রসায়নবিদ ড. মিখাইল জে. রাসেল বলেন, বিজ্ঞানীদের এই সাম্প্রতিক গবেষণা সেইসব বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় যাঁরা ‘পৃথিবীতে প্রাণের অগ্রদূত’ নিয়ে কাজ করছেন তাঁদের মধ্যে একটি উৎসাহের তরঙ্গ বয়ে এনেছে। তিনি আরও বলেন, সাগর গর্ভে এইরকম উষ্ণ-শীতল জলের প্রস্রবণের উপস্থিতি নিঃসন্দেহে প্রাণ প্রতিষ্ঠার উদ্রেককর!
১২৬৮ মিটার লম্বা চোঙাকারে সংগৃহীত পৃথিবীর ম্যান্টল অঞ্চলের নমুনা পৃথিবী গঠনের প্রধান উপাদান মোটা মোটা প্লেটোনিক শিলার সঙ্গে সূক্ষ্ম পেরিডোটাইট শিলা মিশ্রিত হয়ে লম্বা বিছে আকারে রয়েছে। এ-যাবৎ পৃথিবীর ম্যান্টল রচনা এবং অভিব্যক্তি শুধুমাত্র পৃষ্ঠতলের নমুনা সংগ্রহ এবং কিছু পরোক্ষ প্রক্রিয়ায় অনুমান করা হত; কিন্তু এবারেই তা সরাসরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা এই প্রাপ্তি শুধুমাত্র পৃথিবীর বুকে প্রাণের উৎস নয়, সৌরজগতের অন্যত্র, এমনকী সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কীভাবে প্রাণের উন্মেষ ঘটে তা জানতে সাহায্য করবে।

Latest article