অদম্য কৌতূহল
অব্যক্ত গ্রন্থে বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু লিখেছেন, তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গানদীকে দেখে তাঁর মনে হত নদী আসলে একটি গতি পরিবর্তনশীল জীব, তাই উৎসাহ ভরে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন, নদী তুমি কোথা হইতে আসিতেছ? উত্তরটা সেদিন তিনি ওই নদীর স্রোতের প্রবহমানতায় শুনতে পেয়েছিলেন। ঠিক তেমনি সময়ের রথে সভ্যতার চলমানতায় আমাদের এ প্রশ্ন আজন্মের, প্রাণ তোমার উৎস কোথায়— স্থলে না জলে! আজও তার সঠিক উত্তর মেলেনি। তবে নিরন্তর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান জারি…
খুঁজে পাওয়া বৈজ্ঞানিক মতামত ও মতবাদের তারতম্য থাকলেও অধিকাংশ বিজ্ঞানীর ধারণা, গভীর সমুদ্রের তলদেশে উপস্থিত লস্ট সিটির মতো স্থান থেকেই প্রাণের প্রথম উন্মেষ। পৃথিবী সৃষ্টির রহস্য এবং পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব, এই জমাট কৌতূহল সমগ্র মানবজাতির জন্যই এক বিরাট কর্মযজ্ঞ, যা নিবৃত্তির জন্য চলছে বহুবছর ধরে গভীর সমুদ্রের নীচে প্রাণ ও পৃথিবী উন্মেষণ অভিযান।
আরও পড়ুন-সন্দীপকে হেফাজতে পেল না সিবিআই
পৃথিবীর রহস্যময়ী পরিকাঠামো
সাধারণত পৃথিবীর গঠন বলতে বোঝায়, পৃথিবীর যান্ত্রিক ধর্ম এবং তার রাসায়নিক গুণের তারতম্য অনুসারে উপাদানগত শ্রেণিবিন্যাস। যান্ত্রিক ধর্ম অনুযায়ী পৃথিবী দুইরকম স্তরের সমন্বয়ে গঠিত— একটি ভূত্বক বা লিথোস্ফিয়ার, যা অসংখ্য কঠিন পাতের দ্বারা সৃষ্ট এবং তার নীচে উপস্থিত জেলির মতো অ্যাস্থেনোস্ফিয়ার। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পৃথিবীর গাঠনিক উপাদান রাসায়নিক ধর্ম অনুযায়ী চার প্রকারের। যথা, সবচেয়ে উপর পৃষ্ঠের কঠিন পাথর ও খনিজ পদার্থ দিয়ে তৈরি প্রায় ৪.৫- ৬৯ কিলোমিটার গভীর পর্যন্ত ক্রাস্ট অঞ্চল, তারপরে প্রায় ২৯০০ কিলোমিটার ব্যাপী সিলিকেট পাথরের পুরু স্তর ম্যান্টল। এই অংশটি বৈজ্ঞানিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পৃথিবীর ভরের প্রায় ৬৭% এবং আয়তনের প্রায় ৮৪% একাই বহন করে। এর পরে পৃথিবীর কেন্দ্র অঞ্চলে উপস্থিত কোর অংশ, সবচেয়ে ঘন এবং উত্তপ্ত এই স্থানের তাপমাত্রা প্রায় ৪-৫ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। সাধারণত পৃথিবীর কোর লোহা এবং নিকেল দিয়ে তৈরি হলেও এখানে অক্সিজেন, সিলিকন এবং সালফারের উপস্থিতি রয়েছে। কোর অঞ্চলের দুটি অংশ, আউটার কোর বা বাইরের অংশটি তরলাকৃতির হলেও ইনার কোর বা মধ্যবর্তী অংশটির প্রায় ৯০% কঠিন লোহা দিয়ে তৈরি।
পৃথিবী গঠনের প্রতিটি স্তরের নির্দিষ্ট কিছু রাসায়নিক গুণ ও ভৌতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা পৃথিবীর পৃষ্ঠে উপস্থিত জীবন ও পরিবেশকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। পৃথিবীর কেন্দ্রস্থ কোর অঞ্চলের তাপমাত্রার তারতম্যের জন্য ম্যান্টল অংশের যে চলাচল হয়, তার ফলে ভূমিকম্প এবং আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ও সুনামি হয়ে থাকে; এইসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভূমিভাগের জীবন এবং সম্পদের ভালমন্দের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পৃথিবীর কেন্দ্র এবং পৃথিবীপৃষ্ঠের জনজীবনের সঙ্গে যে অদ্ভুত মিথষ্ক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় তা নিয়েই বৈজ্ঞানিক মহলের এত কৌতূহল— পৃথিবী সৃষ্টি এবং পৃথিবীর বুকে প্রাণের উৎস-রহস্য কি তবে পৃথিবীর কোর অঞ্চলেই লুকিয়ে রয়েছে! বহু বছর আগেই শুরু হয়েছে খোঁজ—
গভীর সমুদ্র অভিযান
পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক বোঝাপড়া, তার মধ্যেকার প্রকৃতি ও সমুদ্রের জলবায়ুর পরিবর্তন, ভূ-গাঠনিক পাতের নড়াচড়া, নানা ধরনের ভূতাত্ত্বিক বিপদের প্রভাব ও প্রকৃতি জানতে, এবং এই ধরিত্রীর বুকে প্রাচীন প্রাণের জন্মকথা উন্মোচনের উদ্দেশ্য নিয়েই বহু আগেই শুরু হয়েছে গভীর সমুদ্রের তলদেশ খনন অভিযান। বেশ কয়েক দশক আগের প্রোজেক্ট মহোল, ডিপ সি ড্রিলিং প্রোজেক্ট, ওশেন ড্রিলিং প্রোগ্রাম, এবং ২০০৩-২০১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলা ইন্টিগ্রেটেড ওশেন ড্রিলিং প্রোগ্রামের ফলে প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় লস্ট সিটির আটলান্টিস ম্যাসিফ শৈলচূড়ার নমুনা সংগ্রহ এবং গভীর সমুদ্র খননকার্য অভিযান। বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে এই কর্মযজ্ঞ ইন্টারন্যাশনাল ওশেন ডিসকভারি প্রোগ্রাম নামে চিহ্নিত। একত্রে প্রায় ২৩টি দেশের বিজ্ঞানীরা আন্তর্জাতিক স্তরে এই বিশাল মহাসামুদ্রিক অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন।
আরও পড়ুন-তদন্ত চলাকালীন সাসপেনশন নয়, জুনিয়র ডাক্তারদের সব ধরনের পরিষেবায় ফেরার নির্দেশ কোর্টের
দ্য ড্রিলিং শিপ
ইন্টারন্যাশনাল ওশেন ডিসকভারি প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত সভ্য দেশের একদল বিজ্ঞানী আমেরিকার ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় এবং টেক্সাস এ-অ্যান্ড-এম ইউনিভার্সিটির ব্যবস্থাপনা ও বৈজ্ঞানিক পরিচালনায় ‘দ্য জয়ডেস্ রিসোলিউশন্ সায়েন্স অপারেটর’ অভিযানের মধ্য দিয়ে লস্ট সিটির মধ্যে সামুদ্রিক ড্রিলিং শুরু করেন। এই অভিযানে তাঁরা ‘জয়েন্ট ওশিয়েনোগ্রাফিক ইনস্টিটিউশনস্ ফর ডিপ আর্থ স্যাম্পলিং’ নামে একটি জাহাজ ব্যবহার করেন যা সংক্ষেপে জয়ডেস্ রিসোলিউশন বা জেআর নামে পরিচিত।
জয়ডেস্ রিসোলিউশন ওভারসিজ ড্রিলিং লিমিটেডের মালিকানাধীন কানাডার নোভা স্কোটিয়ায় হেলিফ্যাক্স শিপইয়ার্ডে নির্মিত ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে সাইপ্রাসের লিমাসল পোর্টে নিবন্ধন-কৃত একটি তৈল উত্তোলনকারী সামুদ্রিক ভেসেল। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৭০.৫ ফুট, উচ্চতা প্রায় ২০২ ফুট, এবং ৭০ ফুট মরীচি বিশিষ্ট; ৭৫ দিনের এনডিউরেন্স পিরিয়ডের এই জলজাহাজটিতে একসঙ্গে ৬৫ জন বিজ্ঞানী এবং ৬০ জন যন্ত্রকৌশলী কাজ করতে সক্ষম। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে এই ভেসেলটিকে প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য ব্যবহার করা হয়; ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ওশেন ড্রিলিং প্রোগ্রামের মূল রিসার্চ ড্রিলিং ভেসেল হিসেবে কাজ করার পর, ২০০৭–০৮ খ্রিস্টাব্দে এই জাহাজটিকে আরও উন্নত করা হয় এবং ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে এটি পুরোপুরিভাবে একটি সামুদ্রিক ভাসমান বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগার হিসেবে পরিগণিত হয়। প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৮ কিলোমিটার গতিবেগ-সহ এই ভেসেলটিতে রয়েছে উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি, ডেটাবেস, নানা ধরনের অ্যানালিটিক্যাল ইক্যুইপমেন্ট, এবং পরীক্ষাগারের ৩৬০ ডিগ্রি উলম্বিক চলাচলের সুবিধা। উন্নত ওয়্যারলাইন কোরিং এবং লগিং প্রযুক্তির সাহায্যে এই জাহাজটি সমুদ্রের তলায় পৃথিবীর কোর অঞ্চলের প্রায় ২৪৯-১৯০০০ ফুট পর্যন্ত ড্রিলিং করতে সক্ষম, এবং এটি এখনও পর্যন্ত সর্বাধিক ৬৯০০ ফুট পর্যন্ত ড্রিলিং করেছে। দীর্ঘ কর্মজীবনে জয়ডেস্ রিসোলিউশন মোট ৩২২ কিলোমিটার কোর অঞ্চলের নমুনা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে।
আরও পড়ুন-ইস্টবেঙ্গল এফসির কোচের পদ থেকে ইস্তফা কুয়াদ্রাতের
শেষ থেকে শুরু
প্রাণ ও পৃথিবীর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের রূপরেখা খুঁজে পেতে সমুদ্র অভিযানের ‘সায়েন্স প্লান—২০১৩-২০২৩’ অনুযায়ী এই ভেসেলটি তার শেষ খনন অভিযান চালিয়েছে এবছর জুন মাসে। দুঃখজনকভাবে আমেরিকার ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন আর কোনও আর্থিক সাহায্য করতে পারবে না বলেই এবছর অগাস্ট মাসে এই জয়ডেস্ রিসোলিউশন-এর বৈজ্ঞানিক সফর শেষ হল। আমস্টারডামে এই জাহাজটির প্রতিটি অংশ খুলে খুলে সংরক্ষণ করা হবে। এই ভেসেলকৃত প্রাপ্ত পৃথিবীর কোর অঞ্চলের নমুনাগুলো টেক্সাস এ-অ্যান্ড-এম ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ব্রেমেন, এবং জাপানের কোচি ইউনিভার্সিটিতে সংরক্ষণ ও গবেষণা করা হবে। আগামী দিনে আমরা নিশ্চয়ই ওইসব গবেষণায় নতুন করে প্রাণ ও পৃথিবীর জন্মবৃত্তান্ত জানতে পারব।