পাঁচদিনের পুজোর সাজে

আজ মহাপঞ্চমী। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি তুঙ্গে। কেনাকাটার পর্ব প্রায় সারা, এখন লাস্ট মিনিট শপিং। কোনটা কেনা বাকি? স্কার্ট, সালোয়ার নাকি ড্রেস? শার্ট-প্যান্ট না ধুতি- পাঞ্জাবি? অঞ্জলিতে লাল-সাদা জামদানি চাই-ই। আর দশমীতে গরদ মাস্ট। কোন দিন কোন সাজে, কেমন লুকে পুজোয় মাতবেন রইল তার গাইডলাইন। সেই সঙ্গে এ-বছর পুজোর নির্ঘণ্ট। লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

গণেশের ভারি রাগ তাঁর এখনও একটা ধুতি আর পাঞ্জাবি হয়েছে। একটা শেরওয়ানি চেয়েছিল কিন্তু কেনার সময় পাননি তাঁর মা জননী। সরস্বতীর আবার ধোতি প্যান্ট আর কুর্তা লাগবে। এদিকে মা মহামায়ার নাভিশ্বাস উঠছে, ছিটেফোঁটা সময় নেই তাঁর। এখন মর্ত্যে যাওয়া মানে প্রায় দশদিনের গল্প। এই ক’দিনের সব রান্না মাকেই করে যেতে হবে। কোনও রাঁধুনি বামুনের হাতের রান্না বাবা ভোলা মহেশ্বর খাবেন না। এদিকে আর এক জ্বালা, ছেলেমেয়েদের তিনি বোঝাতেই পারছেন না যে এখন পুজোয় থিমের রমরমা হলেও শাড়ি বা ওই শাড়ি জাতীয় পোশাক ছাড়া উদ্যোক্তারা কিছু পরাবেন না। থিমের মণ্ডপে মা শূন্যে ভাসমান হলেও তাঁকে শাড়ি পরেই ভাসতে হবে। দুর্গা মণ্ডপের নাম যতই প্রগতি বা সংহতি হোক প্রতিমার পরনে আধুনিক কলারড স্লিভলেস ব্লাউজ, শিফন শাড়ি বা জিনস টপ নট আলাউ। ওখানে মাকে ট্রাডিশনাল সাজেই থাকতে হবে। লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিকদেরও তাই। তাহলে ট্রেন্ডিং পোশাক কিনে হবেটা কী! ওটা শুধুই জেনারেশন জি-দের জন্য। এদিকে ভোলা মহেশ্বরের রাগটাও দিনে দিনে যেন বাড়ছে তার কারণ হল এখন পুজোয় মার বাপের বাড়ি থাকবার সময়সীমা অনেকটা বেড়ে গেছে। আসলে বয়স বাড়ছে তো! তাই স্ত্রী ছাড়া এখন মহেশ্বর বড়ই অসহায় বোধ করেন। এদিকে মহালয়াটুকু পেরনোর উপায় নেই তার আগে থাকতেই ছেলেমেয়েদের জামাকাপড়, নিজের শাড়ি-গয়না গুছিয়ে রেডি থাকেন মা রেসের মতো ‘রেডি স্টেডি অনিওমা গো’ ব্যাস। এক মুহূর্ত আর সময় নষ্ট করা সম্ভব না। দর্শনার্থীর চাপ সামাল দিতে দুর্গাকে মণ্ডপে চলে আসতে হবে। তাই এবার মা দুর্গা ঠিক করেছেন মর্ত্যে গিয়েই বাকি কেনাকাটা সারবেন।
আজ মহাপঞ্চমী তাই কেনাকাটার হিড়িক তুঙ্গে। লাস্ট মিনিট শপিং আর প্যান্ডেল হপিং এখন থেকে অষ্টমী অবধি দুটোই চলবে একসঙ্গে। ওইদিন পর্যন্ত সব দোকানই থাকবে খোলা। তাহলে কী কিনবেন, কী রইল বাকি, কোনদিন কোন পোশাক, সঙ্গে কী চুল বাঁধবেন, কেমন গয়নাই বা পরবেন দেখে নেওয়া যাক।

আরও পড়ুন-আড়ালের প্রতিমারা

পঞ্চমীতে হালকা সাজে
পুজোর আসল কথা হল মনপসন্দ ফ্যাশন। ওটা না হলে সব কিছুই মাটি। পুজো শুরুর লুকটা হোক হালকা-ফুলকা। শেষ মুহূর্তের কেনাকাটি থেকে একটা বেছে নেওয়া যাক। পঞ্চমী, ষষ্টিতে অনেকের অফিস থাকে। সহকর্মী বন্ধুদের সঙ্গে এদিন পুজোর সেলফি, গ্রুপফিও মাস্ট। তাহলে সকালে একটা হালকা সুতোর কাজের কুর্তি হলে কেমন হয়। আসলে সারাবছর আমরা সবধরনের পোশাক পরি, পুজোর ক’দিন না হয় একটু ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে রইলাম, মন্দ কী। যাঁদের অফিসে ইউনিফর্ম রয়েছে তাঁরা ছাড়া জিনস, টপ বা ফরমাল ওয়্যার না পরে একটা কুর্তা, স্ট্রেট প্যান্ট আর দোপাট্টা পরলে কেমন হয়। শাড়ি পরবেন? তাহলে একটা ফেন্ডি শিফন ফাটাফাটি হবে।
ফেন্ডি এবছর ইন।
লাইট ওয়েট গ্লসি জর্জেট। শুধু পাড়ের আউটলাইনে লকিং এমব্রয়ডারি ব্যস। গর্জাস অথচ সিম্পল। ফেন্ডি শাড়ি আরও জমকালো হয় সেটা তোলা থাক অন্যদিনের জন্য। এর সঙ্গে ছিমছাম হেয়ার ডু, হালকা জুয়েলারি।
পঞ্চমীর সন্ধেবেলা একটু হাইপড হওয়া ঠাকুরগুলো দেখে ফেলুন কারণ যত দিন গড়াবে তত ভিড় বাড়বে। রাতে তাহলে ক্যাজুয়াল ওয়্যার হালকা অথচ কনটেম্পরারি, আধুনিক অথচ আভিজাত্যের মিশেল। মোডাল কুর্তি বা মোডাল ওয়ান পিস বা থ্রি পিস কুর্তা সেট বা কাফতান লং টপ বেশ লাগবে। মেটিরিয়াল হালকা চিনন বা সিল্ক বা র-সিল্ক ভাল হবে। ছেলেদের ক্ষেত্রে ডেনিম সঙ্গে ওভারসাইজড ব্যাগি টি শার্ট।

আরও পড়ুন-বাবরি মসজিদ নির্মাণ ও অযোধ্যা-রায় নিয়ে চন্দ্রচূড়ের মন্তব্যে বিতর্ক

ষষ্ঠীতে হোক ট্রেন্ডিং
লুক। ষষ্ঠী মানেই পুরোদমে পুজো শুরু। এই দিনে অনেকেই প্যান্ডেল হপিং করতে যান তাই কমফর্ট বা আরামটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনটার জন্য বেছে নিতে পারেন কটন বেগমপুরি পাড় বসানো ধোতি এবং শর্ট স্লিভলেস কুর্তা বা এ লাইন একটু স্ট্রেট কাটের স্কার্ট এবং টপ। কুর্তার সঙ্গে লাইট বটম ওয়্যার হিসেবে পালাজো বা ফ্লেয়ারড প্যান্ট মানানসই। শাড়ি পরতেই পারেন তবে সেটা সকালে হলে বেশি ভাল। শাড়ি পরে মণ্ডপে বসা, আড্ডা দেওয়ার কমফর্টটাই আলাদা। কেরলা কটন বা মাহেশ্বরী কটন, বাগরু প্রিন্টের লাইট ওয়েট সুতি সঙ্গে ব্লাউজটা একটু অন্যরকম হলে দারুণ লাগবে। রোদে বেরলে চুল বেঁধে নিন, খোলা রাখতে পারেন তবে দেখবেন মাথা যেন না ঘামে। তাহলে শ্যাম্পু করা ফুরফুরে ফোলা চুল একদম পেতে যাবে। রাতের সাজটাই মাটি হবে। আজকের মেকআপ-এ আধুনিকতার সঙ্গে থাক হালকা ট্রাডিশনের ছোঁয়া। মুখে দিন হালকা বেস, একটু আই লাইনার আর লিপ গ্লস, রাখুন মিনিমাল জুয়েলারি।
সপ্তমীতে সুন্দর ছিমছাম
সপ্তমীতে সকালে ঠিক করেছেন বন্ধু বা পরিবার নিয়ে খেতে যাবেন বা বাড়িতে আসবে গেস্ট তাহলে সকালের সাজ হোক মিনিমাল। একটা হালকা অফ হোয়াইট তসর বা জুট কটন বা হ্যান্ডলুম সেরা। বম্বে কাটের স্লিভলেস ব্লাউজ। শর্ট স্লিভ বা এলবো স্লিভ ব্লাউজ বা ব্যাকলেস ডিজাইনের চেস্ট কাট ব্লাউজ দারুণ মানাবে রাতের জন্য। সপ্তমীর রাতে একটা জারদোসি সালোয়ার, কুর্তা বা ফাইন কটনে সিকুইন এম্ব্যালিশ করা শারারা, বা শর্ট কুর্তা ওভারল্যাপ জ্যাকেট নিচে ফ্লেয়ারড পালাজো দারুণ মানাবে। শাড়ি এদিন হ্যান্ড পেন্টেড মুর্শিদাবাদ সিল্ক, ফেব্রিক প্রিন্টেড সিল্ক, বাটিক সিল্কও পরতে পারেন সঙ্গে স্টেটমেন্ট বড় দুল। চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে শাড়ির সঙ্গে মানানসই লিপস্টিক। এবার ছেলেদের পোশাকে অ্যানিমাল প্রিন্ট, বার্ড প্রিন্ট ফ্যাশনে এদিন পরতে পারেন। এছাড়া শর্ট কুর্তা, সোয়েড শার্ট, শার্ট স্টাইল কুর্তা, ব্যাগি প্যান্ট, কটন ট্রাউজার, লিনেন ট্রাউজার ফাটাফাটি।
অষ্টমীতে ট্র্যাডিশনাল
অষ্টমী মানেই আট থেকে আশি শাড়িই পরবে। এদিন আপনি পরিপূর্ণ বাঙালিকন্যা। আর অষ্টমীর সকালে লাল-সাদা মাস্ট। লাল-সাদা হোক বা সাদা- লাল বা পুরো লাল খাদি কটনে জামদানি উইভ, লাল-সাদা লেস জামদানি, শিউলি শাড়ি, রঙের, লাল হ্যান্ডলুমে, এই দিনটির জন্য বেছে রাখুন। সঙ্গে বড় একটা কানবালা বা ঝুমকো, কপালে বড় টিপ, চোখের মেক-আপ কোল পেনসিল দিয়ে কোনের দিকটা আঙুল দিয়ে স্মাজ করে দিন। চুলে অবশ্যই খোঁপা আর ফুল দিতে ভুলবেন না।
এদিন রাতেও থাকবে বাঙালিয়ানার ছোঁয়া। আপনি হয়ে উঠবেন উৎসবের মুখ। এদিনের শাড়ি হিসেবে বেছে নিন দারুণ একটা মাশরু বা খাড্ডি সিল্ক বা পশমিনা। জামদানি লেস ওয়র্কে ব্লাউজ পরুন এর সঙ্গে। শাড়িতে যাঁরা কমফর্টেবল নন তাঁদের জন্য জামদানি লং ড্রেস, জামদানি টু পিস, জামদানি থ্রি পিস দুর্দান্ত হবে। কিশোরীরা ফ্লেয়ার্ড স্কার্টের সঙ্গে শার্ট-স্টাইল ব্লাউজ। চুলটা একটু অন্যরকম ভাবে নটিং কুরন বা খুলে রাখতে পারেন। আইমেকআপ ট্র্যাডিশনাল। ঘন কাজল স্মাজ করে। আইশ্যাডো আর কাজল ব্লেন্ড করে অংইন চোখের কোণে। ব্লাশ অন একটু শিমার পাউডার টাচ— ব্যাস। শাড়ি হলে বড় দুল পরুন গলায় নেকপিস না হলেও চলবে। ছেলেদের জন্য, অষ্টমী মানেই লং কুর্তা আর পাজামা বা চোস্ত। কুর্তায় একটু ড্রেপড বা অ্যাসিমেট্রি স্টাইল দারুণ লাগবে৷ ধোতি প্যান্ট, জোহেব প্যান্ট, হারেম প্যান্ট পরা যেতে পারে৷ বোতামগুলো এক্কেবারে সোজাসুজি না হয়ে একটু সাইড বটন, আঙ্গরাখা স্টাইল পাঞ্জাবিও দারুণ লাগবে।
নবমীতে গ্ল্যামারাস
নবমীর রাতে জমে ওঠে পুজোর সবচেয়ে গ্ল্যামারাস পার্টিগুলো। তাই এই দিনে ট্র্যাডিশনের বাইরে গিয়ে ফিউশন লুকে মাতাতে পারেন। ধুতি প্যান্টের সঙ্গে এমব্রয়ডারি কুর্তি, মোডাল পেনসিল স্কার্ট আর টপ, গুজরাতি কাজ করা কুর্তি বা লেহেঙ্গা, ফ্লেয়ারড সিকুইন স্কার্ট পরতে পারেন। শাড়ি জারদোসি ওয়র্ক করা, সিক্যুইন ওয়র্ক, ট্র্যাডিশনাল বেনারসি, কাঞ্জিভরম, তসর জামদানি বেছে নিন। খুব হালকা শাড়ি পরতে পছন্দ করলে ট্র্যাডিশনাল পিওর কলমকারি সিল্ক, মাহেশ্বরী সিল্ক, বোমাকাই সিল্ক বেছে নিতে পারেন। শাড়ির সঙ্গে অবশ্যই স্টেটমেন্ট ব্লাউজ মসাবা কাট বা সিকুইন ব্লাউজ, সব্যসাচী কাটের ব্লাউজ বেছে নিন। চুল কার্ল করে সেট করে রাখতে পারেন, হেয়ার অ্যাক্সেসরিজ দিয়ে সাজাতে পারেন। এইদিন নেভি আই অর্থাৎ নেভি ব্লু আই মেক-আপ, চোখে স্মোকি আই, শিমারি আই মেকাপ ফাটাফাটি যাবে। কানে বড় স্টোন স্টাডস, সেমি প্রেশাস স্টোনের গয়না ভাল লাগবে। ছেলেদের জন্য, ড্রেপড কুর্তা উপরে একটু জমকালো কাজ করা নেহরু জ্যাকেট পরতে পারেন৷ আবার নেহরু জ্যাকেটের বদলে বন্ধগলাও পরতে পারেন। ওপেন জ্যাকেটও হতে পারে। পরতে পারেন শেরওয়ানিও।
দশমীতে রাঙাবাসে
দশমীর সকাল মানেই সিঁদুর খেলা, আর তার সঙ্গে রাঙা শাড়ি একদম উপযুক্ত। তবে বেশি ভারী না করে বেছে নিন হালকা কোন শাড়ি কারণ সিঁদুর লাগবেই যাতে কাচাধোওয়া করে ফেলা যায়। ছোট খোঁপা, কানে সোনালি ঝুমকা আর হাতে সোনালি চুড়ি— এটাই সেরা লুক দশমীর। শাড়ি কী পরবেন ভাবছেন? বেছে নিতে পারেন মঙ্গলগিরি কটন, তসর থেকে গরদ ব্লাউজে বোটনেক, ব্লাউজ স্টাইল ক্রপ টপ, স্লিভলেস ডিপ নেক, চাইনিজ় কলার, অফ শোল্ডার টপ এখন দশমীতে অনেক ঠাকুরই বিসর্জন হয় না। অনেকেই ভিড়ের ভোগান্তি আটকাতে ওইদিন ঠাকুর দেখতে বেরন। দশমীতে জিনস আর এথনিক কুর্তায় আপনাকে অনবদ্য লাগবে তাই একটা দিন অন্যরকম সাজতে হলে খান ড্রেস বেছে নিতে পারেন যাকে আমরা পাঠানি বলি। রেডিমেড ধুতি, তাঁতের ধুতি, হ্যান্ডলুম ধুতি কম্বিনেশন করে কুর্তা দারুণ লাগবে এইদিন।

Latest article