এপ্রিল মাসেই শুরু হয়ে গেছে তাপপ্রবাহ। গ্রীষ্মকালে বড়সড় বিপদ হল এই হিট ওয়েভ। যেন আগুন-চাদরের হলকা। আন্তর্জাতিক জলবায়ু সংস্থা এবং বিজ্ঞানীরা বলেছেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবছর তাপপ্রবাহর পরিমাণ প্রায় ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেশি থাকবে। কাজেই এ-বছরের গরমে সবার সুস্থ থাকাটাই হবে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। গরমে এই ‘হিট ওয়েভ’ জনিত সমস্যা আসে নানা রূপে। পরিস্থিতি সামাল দিতে চিনতে হবে উপসর্গ।
আরও পড়ুন-জয় জগন্নাথ! জয় বাংলা!
হিট স্ট্রোক
গরমে ঝুঁকি বেড়ে যায় হিট স্ট্রোকের। হিট স্ট্রোক বা সান স্ট্রোক হলে শরীরে তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়ে যায়। সেই বৃদ্ধির পরিমাণ হতে পারে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। শরীরের এই অতিরিক্ত গরম-অবস্থাকে বলা হয় হাইপারথার্মিয়া। শরীর অত্যধিক শুকিয়ে যায়। ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। শরীরের ভিতরটা গরম হয়ে যায়। কিন্তু হাত-পা ঠান্ডা থাকে। হৃদস্পন্দনের গতি কমে যায়। শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে সমস্যা হয়। ভুল বকা কিংবা সাময়িক ভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়াও হিট স্ট্রোকের লক্ষণ। হিট স্ট্রোকের কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি ছাড়াও ডিহাইড্রেশন, অতিরিক্ত গরম পোশাক, অ্যালকোহল নেওয়া। ৬০ বছরের বেশি বয়সি এবং ১২ বছরের কম বয়সি শিশুদের এবং উচ্চরক্তচাপ এবং কিডনির সমস্যাযুক্ত ব্যক্তিদের সান স্ট্রোকের বা হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি।
উপসর্গ
অতিরিক্ত ঘাম হয়। শ্বাস-প্রশ্বাস বৃদ্ধি। বমি-বমি ভাব কখনও বমিও হয়। তীব্র মাথাব্যথা। হৃদস্পন্দন বাড়ে। রক্তচাপ বেড়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন রোগী। প্রচণ্ড দুর্বল লাগে, মাথা ঘোরে। চলাচলে অসুবিধা হয়। ত্বক লাল হয়ে ওঠে।
হিট পিডিমা
প্রবল তাপপ্রবাহ থেকে তৈরি হয় এই গুরুতর সমস্যা। প্রচণ্ড গরমের কারণে শরীরের রক্তনালিগুলো প্রসারিত হয়, যার ফলে শরীরের তরল পদার্থ হাতের বা পায়ের টিস্যুগুলোতে জমা হতে শুরু করে এর ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশে ফুলে যায়।
উপসর্গ
হিট পিডিমার লক্ষণ হল পায়ের পাতা ফুলে যাওয়া, কিছুক্ষেত্রে পায়ের উপরের অংশ প্রচণ্ড ফুলে যায়। কারও ক্ষেত্রে হাত-পা দুই-ই একসঙ্গে ফোলে।
আরও পড়ুন-‘পাকিস্তানে গিয়ে কি মরব আমরা?’ ভারত ছাড়ার নিদানে দিশাহারা সারদা বাইরা
হিট ক্র্যাম্প
প্রচণ্ড গরমে যাঁরা খুব পরিশ্রম করেন বা ব্যায়াম করেন তখন শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে শরীরের পেশিগুলো নিজেদের সঙ্কোচনকে অনবরত নিয়ন্ত্রণ করার স্বাভাবিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। হিট ক্র্যাম্পের প্রধান কারণ হল ডিহাইড্রেশন অর্থাৎ শরীরে জলের অভাব এবং ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স অর্থাৎ শরীরে বিভিন্ন খনিজের অসমতা।
উপসর্গ
হিট ক্র্যাম্পে প্রচণ্ড ঘাম হতে থাকে এবং পেশিতে একধরনের খিঁচুনি শুরু হয়। পা, পেট এবং হাতের পেশিতে তীব্র ব্যথা অনুভব হয়। খুব দুর্বল লাগে। এই ক্র্যাম্প বেশ কিছুদিন থাকে। একে অবহেলা করলে গুরুতর আকার নিতে পারে।
হিট টেটানি
এটা হিট স্ট্রোকের মতোই জরুরি অবস্থা। অত্যধিক তাপপ্রবাহে অনেক সময় হাত-পা বেঁকে যায়। হাত-পায়ের সাড় চলে যায়। হাত আর পা ভাঁজ করতেও বেগ পেতে হয়। এই ধরনের সমস্যাকে ‘হিট টেটানি’ বলে। এতে শরীরে ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্য নষ্ট হয়।
উপসর্গ
হিট টেটানি হলে ত্বক প্রচণ্ড গরম এবং লালচে হয়ে যায়। জ্ঞান হারাতে পারেন রোগী। শ্বাস নিতে অসুবিধে হয়, দ্রুত হৃদস্পন্দন হয়। মাথা ঘোরে বা ঘোরা ভাব হয়। বমি হতে পারে।
হিট সিনকোপ
যাকে বলে বেহুঁশ হয়ে যাওয়া। প্রচণ্ড রোদে একটানা দাঁড়িয়ে থাকলে ডিহাইড্রেশন হয়, শরীর অতিরিক্ত গরম হয়ে অনেক সময় জ্ঞান হারায় রোগী। শরীরের ছোট ছোট রক্তনালি তাপ বিকিরণের জন্য প্রসারিত হয় সঙ্গে সঙ্গে রক্তচাপ কমে যায়। মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্ত সরবরাহ কমে যায় বলেই চোখ-মুখে অন্ধকার দেখে, অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে রোগী। একে বলে ‘হিট সিনকোপ’।
উপসর্গ
মানসিক বিভ্রান্তি, মাথা ঘোরানো এবং হঠাৎ অল্প সময়ের জন্য অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। আঠালো ত্বক, ঠান্ডা আর্দ্র এবং ফ্যাকাশে ত্বক। হালকা মাথাব্যথা, বমি ভাব। ঝাপসা দৃষ্টি, অতিরিক্ত ঘাম এবং ক্লান্তি।
হিট ওয়েভ থেকে বাঁচতে
সারাদিন পর্যাপ্ত জল পান করুন।
বেলা এগারোটা থেকে দুপুর তিনটা বাইরে থাকবেন না। কারণ এই সময়ে সূর্যরশ্মি সবচেয়ে তীব্র হয়।
চড়া গরমের বাইরে বেরলে ঢিলে-ঢালা পোশাক পরুন। ছাতা, সানগ্লাস মাস্ট।
সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। হালকা কোনও কাপড় দিয়ে মুখ-চোখ ঢেকে বের হন।
কোথাও পুকুর বা খালবিল দেখলেই নিজেকে ঠান্ডা করার জন্য সেখানে নেমে পড়বেন না, কারণে তাতে পরে বিপদ বাড়বে।
হিট পিডিমার বিশেষ কোনও ওষুধ নেই। বিশ্রাম নিলে, বেশি করে জল খেলে আর উঁচু বালিশের উপর পা তুলে রাখলে, আক্রান্ত স্থানে ঠান্ডা জল বা বরফ দিলে সেরে যায়।
হিট ক্র্যাম্প রুখতে অবশ্যই গরমে খুব পরিশ্রমসাধ্য কাজ করবেন না। বিশ্রামের জন্য ঠান্ডা জায়গা খুঁজতে হবে। ঠান্ডা জলে স্নান করে ফেলুন। যদি হিট ক্র্যাম্পে আক্রান্ত ব্যক্তির বমি হয় বা বমি-ভাব আসে তাহলে দ্রুত আইভি (ইন্ট্রাভেনাস ফ্লুইড) দিতে হতে পারে।
হিট টেটানি হলে প্রথমেই বিশ্রাম সেই সঙ্গে হাত-পা মালিশ এবং পরিমাণমতো জল খেলেই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠা যায়। তবে অবস্থা বুঝে যদি গুরুতর হয় হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
হিট সিনকোপ অর্থাৎ হঠাৎ জ্ঞান হারালে ঠান্ডা জলে রোগীকে স্নান করিয়ে দিন, কিংবা বরফজল দিয়ে গা-হাত-পা মুছে দিন।
এরপর রোগীকে শুইয়ে দিন পা উঁচুতে রেখে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ফ্লুইড দিন। প্রয়োজনে কোল্ড কম্প্রেস করতে হবে।