দৈত্য মাকড়সাদের দেশে

জানেন কি বাড়ির দেওয়াল বেয়ে তরতরিয়ে উঠতে থাকা মাকড়সারা সমুদ্রের গভীরেও সমানভাবে স্বচ্ছন্দ? বিশাল আকার দেহ নিয়ে সমুদ্র তলদেশে তারা স্বমহিমায় বিরাজমান। কোন শারীরিক সক্ষমতায় তারা এমনটা পারে অনায়াসে? সেই দৈত্যাকার মাকড়সাদের কথা লিখলেন প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

Must read

জলের নিচে দৈত্যাকার মাকড়সা
লিকলিকে আটটি পা আর ছোট্ট একটা শরীর নিয়ে আমাদের আশপাশে প্রায়শই আমরা এদের ঘুরে বেড়াতে দেখি, দেখি ঘরের কোনও কোনা-ঘুপচিতে জাল বুনতে, এদের চলাফেরা দেখে আমাদের অনেকেরই গা শিরশির করে ওঠে। হ্যাঁ, একদম ঠিক। আজকের প্রসঙ্গ মাকড়সা। যাদের আমরা মূলত স্থলজ প্রাণী হিসেবে জানলেও এদের বাসস্থানের বিস্তৃতি জলেও দেখা যায়। ব্যাপারটি সত্যিই অবাক করার মতো, সাধারণত যে প্রাণীকে আমরা আশপাশের চৌহদ্দির মধ্যে প্রায়শই দেখতে পাই সে কিনা জলের নিচেও স্বমহিমায় বিরাজমান। কীভাবে, কোন শারীরিক সক্ষমতা তাদের এই গুণ প্রদান করেছে আর কোন শ্রেণির মাকড়সা তাতে পারদর্শী দেখে নেওয়া যাক।
সামুদ্রিক মাকড়সা
পাইকনোগোনিডা (Pycnogonida) শ্রেণির প্রাণীদের সাধারণত সমুদ্র বা সামুদ্রিক মাকড়সা বা পাইকনোগোনিড বলা হয়। এই শ্রেণিতে ১,৩০০টিরও বেশি প্রজাতি রয়েছে! পাইকনোগোনিডরা হল সামুদ্রিক আর্থ্রোপড বা সন্ধিপদ। এর মানে হল এই মাকড়সারা, কাঁকড়া ও স্থলজ মাকড়সার মতো একই গোত্রের সামুদ্রিক প্রাণী। একটি সাধারণ মাকড়সার মতোই সমুদ্র মাকড়সার সাধারণত আটটি পা থাকে, আর কাঁকড়ার মতোই থাকে এদের একটি শক্ত বহিঃকঙ্কাল (exoskeleton)-এর গঠন। যদিও কাঁকড়া এবং স্থলজ মাকড়সার সঙ্গে এদের পূর্বপুরুষ একই, তবুও সামুদ্রিক মাকড়সারা শত শত মিলিয়ন বছর ধরে নিজেদের মতো করে বিবর্তিত হয়েছে। বলা বাহুল্য বিজ্ঞানীরা ৫০০০ লক্ষ বছরের পুরোনো সামুদ্রিক মাকড়সার লার্ভা আবিষ্কার করেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে, এই প্রাণীগুলো তাদের নিজস্ব অনন্য একপ্রকারের বৈশিষ্ট্য তৈরি করেছে।

আরও পড়ুন-এই ভারতবর্ষকে বিজেপি চেনে? খোঁজ রাখে ওরা ভারতের অন্তরাত্মার?

আকার
সামুদ্রিক মাকড়সার আকার সাধারণত ১ মিলিমিটার (০.০৩ ইঞ্চি) থেকে ৫০ সেন্টিমিটার (২০ ইঞ্চি) পর্যন্ত হতে পারে, যা একটি বাড়ির পোষা বিড়ালের দৈর্ঘ্যের সমান। ‘পোলার জাইগান্টিজম’ (polar gigantism) নামক একটি বিশেষ ঘটনার কারণে সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক মাকড়সার প্রজাতিগুলো উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি বাস করে। বিজ্ঞানীরা এই রহস্যময় ঘটনাটি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এদের বেশিরভাগ প্রজাতির আকার একটি নখের চেয়েও ছোট হয়, তবে কিছু অ্যান্টার্কটিক প্রজাতির পায়ের প্রসারতা (একটি পায়ের গোড়া থেকে পায়ের ডগা পর্যন্ত) এক ফুটেরও বেশি হতে পারে। এই প্রাণীগুলো ‘পোলার জাইগান্টিজম’ (polar gigantism)-এর একটি বিখ্যাত উদাহরণ। এটি এমন একটি ঘটনা যেখানে আর্কটিক ও অ্যান্টার্কটিকার মতো মেরু অঞ্চলের নির্দিষ্ট কিছু জীব উষ্ণ জলবায়ুতে থাকা তাদের কিছু আত্মীয়দের চেয়ে অনেক বড় আকার ধারণ করতে পারে।
অঙ্গসংস্থান
সামুদ্রিক মাকড়সার মাথায় একটি লম্বা নলাকার মুখ থাকে, যা প্রোবোসিস নামে পরিচিত, বেশ কয়েকটি সাধারণ চোখ থাকে এবং তিন থেকে চারটি উপাঙ্গ থাকে, যার মধ্যে একজোড়া নখর ও একজোড়া ওভিগার (ovigers) থাকে। এই ওভিগারগুলি সাধারণত দেহ পরিষ্কার করতে এবং ডিম বহন করতে ব্যবহৃত হয়। সামুদ্রিক মাকড়সার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর লম্বা, বহু-সন্ধিযুক্ত পা। এই সরু, লম্বা পা-গুলো সামুদ্রিক মাকড়সাকে সাঁতার কাটতে এবং বালুকাময় তলদেশে হামাগুড়ি দিতে সাহায্য করে, যাতে তারা সমুদ্রের পলিতে আটকে না যায়। সামুদ্রিক মাকড়সার এই পা-গুলো এদের অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজও সম্পন্ন করে। একটি সামুদ্রিক মাকড়সার পায়ে এর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থাকে। উদাহরণস্বরূপ, এর অন্ত্রে যে থলি থাকে তা পায়ের শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। সামুদ্রিক মাকড়সা তার পা ব্যবহার করে শ্বাস-প্রশ্বাসও চালাতে পারে। অক্সিজেন পায়ের বিশাল অংশ বরাবর প্রবাহিত হয় এবং পায়ের সঙ্গে লাগোয়া অন্ত্রের থলিগুলির কলায় অক্সিজেন ছড়িয়ে দেয়।

আরও পড়ুন-সার্চ কমিটিতে তছরুপে অভিযুক্ত ও রাজ্যপালের ঘনিষ্ঠজন ঢুকল কীভাবে

বাসস্থান ও খাদ্য
সামুদ্রিক মাকড়সা বিশ্বের সমস্ত মহাসাগরেই বিরাজমান। তারা গ্রীষ্মমণ্ডলীয়, নাতিশীতোষ্ণ এবং মেরু অঞ্চলের মহাসাগরে— অগভীর জল থেকে অতল গভীরতা পর্যন্ত সবজায়গায় থাকতে পারে। বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ পরিচিত প্রজাতি অ্যান্টার্কটিকায় পাওয়া যায়। খাদ্য হিসেবে একটি সামুদ্রিক মাকড়সা নরম দেহের প্রাণী যেমন সি-অ্যানিমোন, কৃমি, জেলি, স্পঞ্জ, নরম প্রবাল প্রভৃতি খেয়ে বেঁচে থাকে।
খাবার সংগ্রহের কৌশল
সামুদ্রিক মাকড়সা তার লম্বা, নলাকার মুখাংশ প্রোবোসিসের দ্বারা শিকারের নরম দেহের ভেতরের অংশ চুষে খায়। এটি প্রোবোসিস দিয়ে শিকারের চামড়া ভেদ করে, তারপর প্রাণীর দেহের ভেতরের উপাদান চুষে বের করে নেয়। এই খাদ্য সংগ্রহের কৌশলের কারণে সামুদ্রিক মাকড়সাকে প্রায়শই চোষক শিকারি (suctorial predator) বলা হয়ে থাকে। কখনও কখনও সামুদ্রিক মাকড়সা তাদের শিকারকে মেরে না ফেলে বরং তাদের সঙ্গে পরজীবী (parasite) আচরণে লিপ্ত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি সামুদ্রিক মাকড়সা একটি বড় প্রাণী থেকে রস চুষে নেয়, তবে এটি সম্ভবত সেই প্রাণীটিকে দুর্বল করে দেবে, কিন্তু মেরে ফেলবে না। ২০০৯ সালে MBARI (Monterey Bay Aquarium Research Institute)-এর গবেষকরা পম-পম অ্যানিমোন-এর পাশে বিশালাকার সামুদ্রিক মাকড়সা খুঁজে পান। দেখা যায় যে, সামুদ্রিক মাকড়সাগুলি ওই অ্যানিমোনের শুঁড় থেকে রস চুষে নিয়েছিল, যার ফলে শুঁড়গুলো নেতিয়ে পড়েছিল কিন্তু অ্যানিমোনগুলো তখনও জীবিত ছিল।
প্রজনন
সামুদ্রিক মাকড়সা তাদের পায়ে থাকা জেনিটাল ছিদ্রের (genital pores) ব্যবহার করে প্রজনন সম্পন্ন করে থাকে। পুরুষ সামুদ্রিক মাকড়সা স্ত্রীর ওপরে আরোহণ করে ছিদ্রগুলো সারিবদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত তারা নিজেদের অবস্থান ঠিক করে নেয়। স্ত্রী তার ডিম্বাণু নিঃসরণের পর পুরুষ তার শুক্রাণু দিয়ে সেগুলিকে নিষিক্ত করে। সে তার ডিম্বাণু বহনকারী অঙ্গ বা ওভিগার (ovigers)-এ ডিমগুলি ততক্ষণ বহন করতে থাকে যতক্ষণ না ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।
সামুদ্রিক মাকড়সার শিকারিরা
তারামাছ, উপকূলীয় পাখি, স্টিং রে, কাঁকড়া এবং কিছু মাছ সামুদ্রিক মাকড়সাদের খাদ্য হিসেবে ভক্ষণ করে থাকে। কিছু প্রজাতির সামুদ্রিক মাকড়সা আবার তাদের সাদাটে রঙের জন্য বালুকাময় সমুদ্রতলের সঙ্গে মিশে গিয়ে শিকারিদের হাত থেকে লুকিয়ে থাকতে পারে।
সংরক্ষণ
যদিও সামুদ্রিক মাকড়সার বসবাস উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর ঠান্ডা জলের বালুকাময় পরিবেশে তাও বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ঘটা সমুদ্রের জলের তাপমাত্রার পরিবর্তন তাদের বেঁচে থাকার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে, যদিও সাম্প্রতিক গবেষণায় এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি তবুও ভবিষ্যতে যে উষ্ণায়নের ফল এদের জীবনকে প্রভাবিত করবে না তা কে বলতে পারে।

Latest article