প্রতিবেদন : ঘরে বসে বাড়তি আয় সঙ্গে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করেছে স্বনির্ভর দলগুলি। লিখেছেন কার্তিক ঘোষ
ঘরে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে বাড়তি কিছু আয়, সেইসঙ্গে সামাজিকবন্ধন যথেষ্ট মজবুত করেছে আমাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলো, এই অভিমত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর প্রত্যেকটি মহিলা সদস্যের। এই সব মহিলারা যেন এগিয়ে চলার আর বেঁচে থাকবার একটা মানে খুঁজে পেয়েছেন। সেই সঙ্গে পেয়েছে স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ার।
স্বনির্ভর দল সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিলাম চাঁদপুর ছাগল পালন স্বরোজগারি দলের নেত্রী সুকুমণি হেমব্রমের কাছে। সুকুমণি জানালেন, আমাদের এই দলের বয়স প্রায় ১০ বছর। দলের সকলেই কেবলমাত্র নাম সই করতে জানি। ব্যাঙ্ক কী জিনিস সেটা জানতাম না। একটা জিনিস হচ্ছে আমরা প্রতি মাসে নিজেদের টাকা ব্যাঙ্কে জমা করছি, প্রয়োজনে ঋণ নিচ্ছি, শোধ করছি, সংসারের কাজে লাগাচ্ছি, আমাদের মতো মহিলারা ব্যাঙ্কমুখী হয়েছি। কিন্তু তৎকালীন দলনেত্রী আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমাদের জমানো টাকা নিয়ে কেটে পড়েন। আমরা বিকল্প শিক্ষিত মহিলা খুঁজতে গিয়ে পাড়াতেই পেয়ে যাই মৌ ঘোষ এবং নিভা ঘোষকে। নতুন কমিটি করে আবার দলকে সতেজ করে তুলি। আমরা প্রতি মাসে মৌ ঘোষের বাড়িতে একটি করে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিই। তা ছাড়া বড় কথা, একটা সময় পাড়ায় পাড়ায় মেয়েদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি চুলোচুলি লেগেই থাকত। এই স্বনির্ভর গোষ্ঠী হওয়ার ফলে যেন আমরা সকলেই একই পরিবারের সদস্য। নিজেদের মধ্যে একটা আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে উঠেছে। যা আর্থিক মূল্যে মাপা যাবে না। দলের কোষাধ্যক্ষ ঠাকুরমণি মান্ডি জানালেন কিছুদিন আগে সাপের কামড়ে আমার ১২ বছরের ছেলের মৃত্যু হয়েছে। স্বনির্ভর দলের প্রত্যেকেই বারবার আমার বাড়িতে এসে সান্ত্বনা দিয়ে গেছেন, খোঁজ নিয়েছেন বারবার। ছেলে ফিরে আসবে না ঠিকই, কিন্তু আমার আরও ন’জন আত্মীয়কে নতুন করে পেয়েছি।
দলের সম্পাদক মৌ ঘোষ জানালেন, আমাদের সিসি অ্যাকাউন্ট আছে। প্রয়োজনমতো টাকা তুলতে এবং জমা দিতে পারি। গ্রুপের সদস্যদের যখন যার টাকার প্রয়োজন হয় আমরা ইচ্ছেমতো টাকা তুলে এনে তাঁকে দিই। তবে সবকিছু করতে হয় মিটিং করে লিখিত সিদ্ধান্ত নিয়ে। তিনি আরও জানালেন দলের সদস্য মণিকা মান্ডি স্বামীহারা মহিলা, তাঁর ১৪ বছরের একটি পুত্র সন্তান আছে। মণিকা ঋণের টাকা নিয়ে একটি করে বকনা বাছুর লালনপালন করেন। বড় হলেই ২৫-৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন। ফলে বছরে তাঁর কমপক্ষে লাভ হয় কুড়ি হাজার টাকা। সুকুমণি বেশকিছু ছাগল রেখেছেন। সুকুমণি নিজেই জানালেন এই ছাগলের থেকে বছরে কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা লাভ হয়। তা ছাড়া সরকারিভাবে মাঝে-মাঝেই ছাগল, মুরগি, হাঁস বিনামূল্যে পাই। তার মধ্যে ১০টা করে বাচ্চাও যদি বেঁচে থাকে তা হলেও দুমাস পরে এক-একটি মুরগি কমপক্ষে দেড়শো টাকা করে বিক্রি হয়। ডিম দিতে শুরু করলে যেমন সংসারের পুষ্টির জোগান দেয় তেমনই সেইসঙ্গে বাড়তি কিছু আয় হয়। যা অনেকের আপাতদৃষ্টিতে চোখে পড়ে না। ফুলমণি হাঁসদা, তাঁর বয়স ৬০ বছর। তিনিও এই দলের সদস্য। ফুলমণি জানালেন, আমার স্বামী গ্রুপের টাকা নিয়ে আলুচাষ করেছিলেন, তিলচাষ করেছিলেন, সবজিচাষ করেছিলেন। কিন্তু আবহাওয়া অনুকূল না থাকায় সম্পূর্ণই লোকসান হয়ে গেছে। তবে এই টাকার সুদ তুলনামূলকভাবে অনেক কম হওয়ায় ঋণের বোঝাটা তেমন হয়নি। দলের সম্পাদক মৌ ঘোষ জানালেন, এই সকল মহিলারা ঋণগ্রস্ত হতেন না চাষে লোকসান হলেও। অতিমারির কারণে আজ দুবছর স্কুলগুলো বন্ধ আছে। দলের এই সকল সদস্যরা স্কুলে রান্না করে যে টাকা পেতেন সেই টাকা থেকে ঋণ শোধ হয়ে যেত। কিন্তু পরিস্থিতি তেমন নয়। কারণ ছেলেমেয়েদের সুরক্ষা সবার আগে। করোনার ভয়াবহতাকে রুখতে আমাদের রাজ্য সরকারকে কড়া সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের কথাও দিদি অর্থাৎ আমাদের মুখ্যমন্ত্রী ভেবেছেন, প্রতিবছর প্রত্যেকটি স্বনির্ভর দলকে ৫ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছেন। তা ছাড়া আমরা প্রতি মাসে প্রত্যেকে ৫০ টাকা করে জমা করি। মৌ দুঃখ কাশ করে বললেন, আমাদের দলের বদনি হাঁসদা বাতরোগে চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী বদনির ইন্স্যুরেন্সের টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু কীভাবে কী করব কেউ পথ বাতলে দিচ্ছে না। বদনি ঋণ নিয়ে বেশ কয়েকটি শূকর পালন করেছেন। এবং এই শূকরপালন এবং বেচাকেনার ফলে প্রতিমাসে নির্দিষ্ট নিয়মে ঋণের টাকা শোধ করছেন।
আরও পড়ুন :.হবু রাজা গবু মন্ত্রী’র নতুন রাজ্য
সবথেকে বড় কথা, আমরা ঘরগৃহস্থালি, রান্না, আমাদের প্রতিটা কাজ ছেড়ে বিছানা ছেড়ে আজ প্রতিমাসে একসঙ্গে দলবেঁধে একটা করে মিটিং করি। যেখানে আমাদের সিমলাপালের দুবরাজপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৬০টি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর প্রায় দেড় হাজার মহিলা একসঙ্গে মিলিত হই। সামাজিক ভাববিনিময়ের একটা প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠেছে। এটাও আমাদের কাছে একটা বিশেষ পাওনা।
তবে দিদি তথা রাজ্য সরকারের কাছে আমাদের বিনীত নিবেদন, যেটা হল, কয়েক বছর দেখছি উপসঙ্গের কয়েক জন মহিলাকে দিয়ে সরকারি সহায়কমূল্যে চাষীদের কাছ থেকে ধান কেনা হয়। প্রত্যেকটি গ্রামে গ্রামে গোষ্ঠীর প্রধানদের দিয়ে এই ধান কেনা হলে যেমন প্রত্যেকটি স্বনির্ভর দল কমিশনের অল্প হলেও টাকা পাবেন তেমনি চাষিদের হয়রানি বন্ধ হবে, অভাবি ধান বিক্রি থেকে চাষিরা রেহাই পাবেন।
এ ছাড়া প্রতিটি গ্রামে ১০০ দিনের কাজের জোয়ার চলছে। আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যদি এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাহলে আমরা সকলেই উপকৃত হব। পরিশেষে বলি বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজা কার্যত শুরু হয়ে গেছে। প্রত্যেকের টাকার প্রয়োজন। মঙ্গলবার আমরা ব্যাঙ্কে গিয়ে প্রত্যেকের জন্য ২০০০ টাকা করে তুলে এনেছি। ছোটখাটো দরকারে আর আমাদের গৃহকর্তাদের কাছে হাত পাততে হবে না। গভীরভাবে ভেবে দেখুন এটা আমাদের কম পাওনা নয়।