রবিঠাকুর লিখেছিলেন, ‘অবসান হল রাতি। / নিবাইয়া ফেলো কালিমামলিন ঘরের কোণের বাতি। / নিখিলের আলো পূর্ব-আকাশে জ্বলিল পুণ্য দিনে। / এক পথে যারা চলিবে তাহারা /সকলেরে নিক চিনে। কবিতাটি ‘স্ফুলিঙ্গ’-এ প্রকাশিত হয় ১৯৪৫-এ। কবির মৃত্যুর পর। আর এই ২০২৪-এ আমরা দেখছি ভারতের অ-বিজেপি দলগুলো নিজেদের রাজনৈতিক প্রয়াণ ঠেকানোর অভিপ্রায়ে জোটের কোণে থাকা কালিমামলিন বাতিটিকে চিনে ফেলেছে। খুঁজে নিতে চাইছে প্রয়োজনীয় আলো পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক আকাশে। আর তারই রাত্রির অবসানের লক্ষ্যে আর এখন একসঙ্গে পথ চলার তোড়জোড় চলছে। অভিন্ন আলোক শিক্ষাকে সামনে রেখে।
আরও পড়ুন-বাংলাদেশকে এবার জঙ্গি রাষ্ট্র বানাতে চান ইউনুস? অরাজকতার তীব্র সমালোচনা তসলিমার
ঘটনায় শুরুতে আছে একটি বেসরকারি সংবাদ চ্যানেলে সম্প্রচারিত সাক্ষাৎকার। সেখানে সোজাসাপটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার জেরে উথালপাথাল ভারতীয় রাজনীতির অন্তর-মহল। এবং অন্তরে, হৃদয় প্রকোষ্ঠে আর দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না দাবিটাকে। অন্দরে বাহিরে উপচীয়মান দাবি একটাই। “দিদিকে চাই”। কী বলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুষ্ঠান সঞ্চালকের একটি প্রশ্নের জবাবে? চুম্বকে সেটা তিনটি উপাদান বিশিষ্ট।
(১) ইন্ডিয়া জোটের শুরুটা যাঁদের হাতে হয়েছিল, মমতা তাঁদের অন্যতম। জোটের নামকরণও করেছিলেন তিনিই। কিন্তু, বর্তমানে জোটের অবস্থা বেশ খানিকটা হতাশাব্যঞ্জক। নেতৃবর্গের আত্মবীক্ষণের সময় সমুপস্থিত। জোটের ভবিষ্যতের স্বার্থেই সেটা জরুরি।
(২) সবক’টি আঞ্চলিক দলের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুসম্পর্ক বর্তমান। এই সম্পর্ক-রসায়ন জোট পরিচালনার পক্ষে অনুকূল শর্ত। সেই কারণে, জোটের নেতৃত্ব তাঁর হাতে তুলে দিলে মমতা সেই দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত। এবং
(৩) সর্বভারতীয় জোটের রাশ হাতে পেলেও মমতা পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটির দায়িত্ব থেকে যে নিজেকে সরিয়ে নেবেন, তেমনটা নয়। বরং, বাংলায় বসেই সর্বভারতীয় বিজেপি বিরোধী জোট পরিচালনায় তিনি আগ্রহী।
এই বক্তব্যের পরিধি থেকে উঠে আসা লক্ষণীয় বিষয়গুলো মোটামুটি ত্রিবিধ—
(১) ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সঙ্গে মানসিক ও আবেগধর্মী সম্পর্ক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম থেকেই আছে। এবং সেটি আজও অটুট। ওই জোট থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার কোনও অভিপ্রায় তাঁর নেই। তবে, নানাবিধ বাস্তব কারণে জোটের স্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি চিন্তিত। জোটের ফাঁকফোকর ও ফাটলগুলো অবিলম্বে মেরামত করার পক্ষপাতী তিনি।
(২) জোটের বর্তমান নেতৃত্ব যাঁদের হাতে, সেই কংগ্রেস ও তার নেতৃবর্গের বিষয়ে তিনি অন্যান্য জোট শরিকের মতোই কিঞ্ছুটা হতাশ। রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব হোক বা মল্লিকার্জুন খাড়্গের সভাপতিত্ব, কোনওটাই কংগ্রেসকে কাঙ্ক্ষিত সামর্থ্য দেয়নি। লোকসভা নির্বাচনে কিঞ্চিৎ ইতিবাচক আশা জাগানোর পর হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রে তাদের জোটসঙ্গীদের নিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ার ঘটনা এবং জম্মু- কাশ্মীরে কংগ্রেসের নির্বাচনী ব্যর্থতা বিজেপি-বিরোধী রাজনীতিতে হতাশা সঞ্চার করেছে। একাধিক জোট সদস্য ইন্ডিয়া-জোটে থাকার ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়েছে। তাদের জেদ আর আগ্রহ, দুয়েতেই ভাটার টান স্পষ্ট। জোটের সুতো ছিঁড়ে বেরোতে চাইছে আপ থেকে আরজেডি-র মতো অনেক দলই। নিজ নিজ এলাকায় বিধানসভা ভোটের সমীকরণ সংক্রান্ত হিসাব কষেই এই ভাবনা, সন্দেহ নেই। হরিয়ানায় আপ, মহারাষ্ট্রে শিবসেনা (উদ্ধব)-র নিজস্ব অভিজ্ঞতা তাদের এই ভাবনার শরিক করেছে। সাংসদ সংখ্যার বিচারে কংগ্রেসের পরেই রয়েছে সপা। তারাও হাত ধরে থাকতে অনাগ্রহী। ঝাড়খণ্ডে হাত ধরে জেএমএম জিতেছে, কিন্তু তারাও মনে করে আসন বণ্টনে কংগ্রেসি দাদাগিরির কারণে তারা বেশ কিছু আসন হারিয়েছে। অর্থাৎ, ইন্ডিয়া জোটের বর্তমান নেতৃত্বের বিষয়ে মমতার মতামত তাঁর ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা সঞ্জাত বিষয় নয়। জোটের অভ্যন্তরে এই নিয়ে টানাপোড়েনের জেরে শেষ পর্যন্ত জোট যাতে না ভেঙে পড়ে, সেদিকে লক্ষ রেখেই সময়োচিত সামূহিক অভিব্যক্তি। এবং সেই অভিব্যক্তিতে সমর্থনের সিলমোহর পড়েছে ইন্ডিয়া জোটের একাধিক শরিক দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতার মন্তব্যে। লালু যাদব, শরদ পাওয়ারের মতো নেতারা সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রাজ্ঞ ভুয়োদর্শী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত। লালু যাদবের বিহারে ভোট আগামী বছরে। সেই অঙ্কেই তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দক্ষতার কথা তুলে তাঁকেই ইন্ডিয়া জোটের নেতৃত্বে চাইছেন। আবার শরদ পাওয়ার আর উদ্ধব থাকরে রাহুলকে সরিয়ে মমতাকে চাইছেন মহারাষ্ট্রে তাঁদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে। ওদিকে, ইন্ডিয়া জোটে নেই যারা সেই ওয়াইএসআর কংগ্রেসও পশ্চিমবঙ্গের ‘দিদি’কেই ইন্ডিয়া জোটের যোগ্য নেত্রী বলে মনে করছে। কারণ, কংগ্রেসের দাদাগিরি দক্ষিণী রাজনীতির ঘরানায় না-পসন্দ একটি বিষয়। আবার, বাম রাজনীতির ডি রাজার মতো নেতা সরাসরি মমতাকে সমর্থনের কথা হয়তো বলতে পারছেন না, কিন্তু কংগ্রেসের বর্তমান নেতৃত্বে আস্থাও রাখতে পারছেন না। অস্যার্থ, ‘ইন্ডিয়া’ বৃত্তের ভিতরে থাকুক বা বাইরে, অ-বিজেপি দলগুলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে চাইছে। উদ্দেশ্যের অভিমুখ আলাদা হলেও, সবাই অভিন্ন পরিণতিতে আগ্রহী। এবং
আরও পড়ুন-রাজ্য পুলিশের সাফল্যের উল্লেখ করে সিবিআইয়ের সমালোচনায় শোভনদেব
(৩) পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেস নয়, বিজেপি। সুতরাং, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কংগ্রেসকে দুর্বলতর করে রাজ্য রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও লাভ নেই। বরং, বিজেপিকে হীনবল করার জন্য কংগ্রেসকে অক্সিজেন জোগানোই রিয়েল পলিটিক বা বাস্তব রাজনীতির কার্যকরী সূত্র। অথচ, কংগ্রেস তৃণমূল কংগ্রেসের সেই রাজনৈতিক প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। ক্রমশ রাজ্যে রাজ্যে সাইনবোর্ড থেকে ভিজিটিং কার্ডে পরিণত হয়েছে। আর লোকসভা ভোটের পর সংসদে কক্ষ সমন্বয়ে নিজেদের জালে নিজেরাই জড়িয়েছে। দেশের মানুষ যখন আদানি ইস্যু খায় না মাথায় দেয় বুঝে উঠতে পারছে না, তখন সেটাকেই আঁকড়ে থাকার জনবিচ্ছিন্ন আদিখ্যেতা দেখিয়েছে। একই সঙ্গে, দেশের আমজনতা যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার, তখন সেটাকে সংসদে তুলে ধরার ব্যাপারে আত্মঘাতী উদাসীনতা দেখিয়েছে। এসব ব্যাপারে কংগ্রেস তৃণমূল কংগ্রেসের পরামর্শে কান দেয়নি। কারণ তারা সম্ভবত ভুলে গেছে, ইন্ডিয়া জোটে তৃণমূল কংগ্রেস একমাত্র দল যারা সাম্প্রতিক অতীতে হাত না ধরেই পদ্মফুলকে পর্যুদস্ত করে জোড়া ফুল ফুটিয়ে চলেছে। এরাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিই যথেষ্ট। কারণ তাঁর জনদরদি কাজকর্ম। বুর্জোয়া অলিয়েনেশনে জননেত্রী কখনও আক্রান্ত হননি। এটাই তাঁর ইউএসপি। এটা প্রমাণিত সত্য।
২০১৬-তে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা রাজ্য ক্যাবিনেট বানিয়ে ফেলেছিলেন। চার্টার্ড ফ্লাইটে চেপে এ-রাজ্যের আকাশে ওড়াওড়ি অব্যাহত ছিল ২০২১-এও। তারপর লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে সন্দেশখালি নিয়ে অবিরঞ্জন আর ২০২৪-এর উপনির্বাচন পর্বের প্রাক্কালে আরজিকর-কাণ্ড নিয়ে মিথ্যাচার অব্যাহত ছিল। প্রতিটি নির্বাচনই ছিল অগ্নিপরীক্ষা। কিন্তু প্রতিটিতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি জনসমর্থন বেড়েছে। দহনে যার ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি পায়, তাকেই তো নিখাদ হিরণ বলা হয়।
আরও পড়ুন-রাজ্য পুলিশের সাফল্যের উল্লেখ করে সিবিআইয়ের সমালোচনায় শোভনদেব
সেই অঙ্কেই বাংলার স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সর্বভারতীয় বিরোধী রাজনীতির রাশ অর্জন অযৌক্তিক বলে মনে হয়েছে মমতার। বাংলা থেকেই সারা ভারত দেখভাল করার কথা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। ‘ইন্ডিয়া’ বৃত্তে এবং বৃত্তের বাইরে যে সমর্থন তিনি পাচ্ছেন, তার পেছনে যেমন কংগ্রেসের প্রতি বীতরাগ ক্রিয়াশীল, তেমনই মমতার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, নির্বাচনী সাফল্য এবং প্রশাসনিক দক্ষতার প্রতি প্রীতি পক্ষপাতও ক্রিয়াশীল। বীতরাগ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া, আর শেষোক্তটি ইতিবাচক। মমতা সাতবার সাংসদ হয়েছেন। দু’বার রেলমন্ত্রী। কয়লা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ক্রীড়া দফতরের মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রক সামলেছেন তিন-তিনজন ভিন্ন ঘরানার প্রধানমন্ত্রীর অধীনে। আবার এই বাংলা থেকে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে তিন-তিনবার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি যেমন ভারতের প্রথম মহিলা রেলমন্ত্রী তেমনই পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। তাঁরই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পকে যারা বিদ্রুপ করেছিল তারাই এখন সেই প্রকল্পকে টুকে লড়কি বহিন যোজনায় নিজেদের শ্বাসবায়ু খুঁজে পেয়েছে।
এসবেরই অনিবার্য পরিণতিতে দিকে দিকে ‘দিদিকে চাই’ আওয়াজ। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম, ইন্ডিয়া জোটের ভিতর ও বাহির, দিদিকে চাইছে।