মুম্বই, ২ নভেম্বর : হরমনপ্রীত ছুটছেন। এলোমেলো দৌড়। লক্ষ্যে পৌঁছে গেলে আর কোথাও যাওয়ার থাকে না! হাতে সেই বল। এইমাত্র হাতে জমিয়েছেন। তাতেই শেষ। জায়ান্ট স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে ভারত ৫২ রানে জয়ী। মেয়েদের বিশ্বকাপ এই প্রথম ভারতের (Team India)। হরমনপ্রীত তখনও ছুটছেন। পিছনে বাকিরা। কেউ হাসছেন। কেউ কাঁদছেন। জেমাইমার চোখ আকাশে। ডি ওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামের আকাশে তখন আতশবাজির মহড়া। ফুলঝুরির মতো টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে ১৪০ কোটির আশীর্বাদ। বারবার ফসকে গিয়েছে। এবার যেতে দেননি। হরমনপ্রীত সব আবেগ ও শক্তি দিয়ে আগলে রাখলেন সেই বল। যেন বলছেন, যেতে নাহি দিব।
যতক্ষণ লরা উলভার্ট ছিলেন, তাঁর দলও ততক্ষণ ম্যাচে ছিল। কিন্তু কঠিন ম্যাচে একা অধিনায়ক কী করবেন। পাশে এমন কাউকে পাননি যিনি স্কোরবোর্ড এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আসলে বৃষ্টির পর উইকেট শুধু স্লো হয়নি, বল অনেকটা করে টার্ন করতে শুরু করেছিল। এই জায়গায় দীপ্তি শর্মা আফ্রিকানদের চরম বিপদের মুখে ফেলে দেন। ব্যাট হাতে ৫৮ রান করার পর দীপ্তি বল নিয়েও ভেলকি দেখালেন। ৯.৩-০-৩৯-৫। তাঁকে কেউ খেলতে পারেননি। উলভার্ট যেমন তাঁর শিকার হলেন, তেমনই আরও চারজন। দীপ্তি হাওয়ায় বল রাখেন। খুব ভাল স্ট্রেটার আছে। আফ্রিকানরা তার হদিশ পাননি। তবে একা দীপ্তির কথা বললে হবে না। নরম উইকেটে মাটি যখন আলগা হয়ে আসছে তখন শেফালি আর শ্রী চরনিও চমৎকার বল ঘোরালেন। অন্ধ্রের মেয়ে শ্রী চরনির গত এপ্রিলে অভিষেক হয়েছিল। সেই তিনি পোড়খাওয়া বোলারের মতো বল করে গেলেন। দীপ্তি না হয় অনেকদিন খেলছেন, কিন্তু এই শ্রী চরনি, আমনজ্যোত, ক্রান্তি গৌড়রা একেবারে নতুন। তাঁদের হ্যারিদি দলকে নিজ হাতে তৈরি করেছেন। হ্যারিদি মানে জেমাইমাদের হরমনপ্রীত। শান্তা রঙ্গস্বামী, ডায়ানা এডুলজি, মিতালি রাজ, ঝুলন গোস্বামীরা যা পারেননি, সেই মুম্বইয়ে এটাই করে দেখালেন হরমনপ্রীত। কাপ জিতে ৩৭-এর হ্যারিদি নভি মুম্বইয়ে রূপকথা লিখে গেলেন। কিছুটা অদ্ভুতই বটে, বক্সে তখন ওয়ান ডে-র রাজা রোহিত শর্মা। না তাঁর আর ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ জেতা হয়নি! ছিল ১৪ বছর আগের এম এস ধোনির।
বৃষ্টিতে ফাইনাল শুরু হল দেরিতে। টসও তাই। কিন্তু ডি ওয়াই পাতিল স্টেডিয়াম তার বহু আগে থেকেই ভর্তি। গ্যালারি পুরো নীল। পঞ্চাশ হাজার আসনের কোথাও খালি নেই। থাকার কথাও ছিল না। এমন আবেগের ম্যাচ ১৪ বছর পর আবার দেখল মুম্বই। সেবারও সকাল দশটা থেকে মাঠ ভরতে শুরু করেছিল। ওয়াংখেড়েতে তিলধারণের জায়গা ছিল না। রবিবারও তাই হল।
আরও পড়ুন-দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারতীয় মহিলা দল, শুভেচ্ছাবার্তা মুখ্যমন্ত্রীর
কী অদ্ভুত! ছবিটাও কেমন মিলে গেল। ২ এপ্রিলের রাতে কাপ উঠেছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির হাতে। ২ নভেম্বর কাপ গেল হরমপ্রীত কৌরদের দখলে। বার দুয়েক বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছে ভারতের মেয়েরা।। ২০০৫ আর ২০১৭-তে। কিন্তু কপালে জুটেছে হার এবং হার। তবে কথায় বলে, সাগর শুধু নেয় না। ফিরিয়েও দেয়। এই যেমন রবিবাসরীয় রাত। সেই নীল সমুদ্র গ্রাস করল নভি মুম্বইকে। জনসমুদ্রে থমকে গেল বাণিজ্য নগরীর জীবন। মানুষ নেমে পড়লেন রাস্তায়। ১৪ বছর আগে এভাবেই মেরিন ড্রাইভ মানুষের সাগরে পরিণত হয়েছিল। রবিবার হরমনপ্রীত এম এস ধোনি হয়ে উঠলেন।
প্রতিকা রাওয়াল চোট পাওয়ায় চটজলদি নিয়ে আসা হয়েছিল শেফালি ভার্মাকে। সেই শেফালি যিনি এই দলের মেরুদণ্ড ছিলেন একসময়। কিন্তু সময় বড় নিষ্ঠুর। রান না পাওয়ায় নির্বাচকরা তাঁকে ঘরোয়া ম্যাচ খেলতে পাঠিয়েছিলেন। একটা সেঞ্চুরিও করেন কয়েকদিন আগে। তারপর এই ডি ওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামে সেমিফাইনালে প্রত্যাবর্তন। রান পাননি শেফালি। তাঁকে ফেরানোর সিদ্ধান্ত ভুল হল কি না ভাবতে ভাবতেই ফাইনাল। অতঃপর মিরাকল। ব্যাটে-বলে শেফালি শো।
ভারত (Team India) যে আগে ব্যাট করে ২৯৮/৭ তুলেছে তার সিংহভাগ কৃতিত্ব শেফালির। ৭৮ বলে ৮৭ রান করেছেন তিনি। কিন্তু পাশে থাকা স্মৃতি মান্ধানাকেও কুর্নিশ জানাতে হয়। সিনিয়র পার্টনার হিসাবে প্রথম থেকে বকাঝকার মধ্যে শেফালিকে রেখেছিলেন। কিন্তু অষ্টাদশ ওভারে যখন একশো পার করে ফেলেছে ভারত, তখনই স্মৃতি আউট হয়ে গেলেন ৪৫ রানে। এরপর আর একটা জেমাইমা শোয়ের জন্য যখন নভি মুম্বই নড়েচড়ে বসেছে, মুম্বইয়ের মেয়ে আচমকা আউট(২৪)।
হরমনপ্রীতও যখন ২০ রানে ফিরে গেলেন, ভাল শুরুটা মাঠে মারা গেল বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু অলরাউন্ডার দীপ্তি শর্মার ব্যাট জ্বলে উঠল। সেমিফাইনালে রান আউট হয়ে প্রবল সমালোচিত হয়েছিলেন। স্লো দৌড়ের জন্য কটাক্ষ শুনতে হয়েছিল। দীপ্তি রবিবার সেসবেরই জবাব দিলেন শেষদিকে একা কুম্ভ হয়ে। ৫৮ বলে ৫৮ রান করে এদিনও রান আউটই হয়েছেন। কিন্তু সোনার চেয়ে দামি ইনিংস খেলে না গেলে ভারত তিনশোর দরজায় পৌঁছত না। সেক্ষেত্রে আফ্রিকানদের জন্য ৬ রানের আস্কিং রেটও থাকত না। অনেক সহজ হত টার্গেট।

