সাগরপাড়ে রূপকথা, জেমাইমার ব্যাটে ফাইনাল

১৪ বছর আগে এক ছক্কায় কাপ হাতে তুলে নিয়েছিলেন এমএস ধোনি। বৃহস্পতিবার যেন ধোনিই হয়ে গেলেন জেমাইমা রডরিগেজ।

Must read

মুম্বই, ৩০ অক্টোবর : সাগরপাড়ে এই রাত ঘুরেফিরে আসে। ১৪ বছর আগে এক ছক্কায় কাপ হাতে তুলে নিয়েছিলেন এমএস ধোনি। বৃহস্পতিবার যেন ধোনিই হয়ে গেলেন জেমাইমা রডরিগেজ। ছটফটে জেমাইমা মেয়েদের ক্রিকেটের আকর্ষণীয় চরিত্র। তিনি গিটার বাজান। সুরের মূর্ছনা ছড়ান। ডি ওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামে ব্যাট হাতে এদিন যে মায়াজাল ছড়ালেন সেটা ক্রিকেটের চিরকালীন রূপকথায় জায়গা যাবে।
ছোটখাটো তরুণী যেন এনার্জির ভাণ্ডার। হরমনপ্রীত ফিরে যাওয়ার পর মনে হচ্ছিল আর হবে না। কিন্তু তিনি, জেমাইমা ভাবছিলেন অন্য কথা। রিচা, আমনজ্যোতদের পাশে নিয়ে পৌঁছে গেলেন বিশ্বকাপ ফাইনালে। ১৩৪ বলে ১২৭ নট আউট। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্বকাপে পুরুষ-মহিলা, কোনও দল এর আগে এত রান তাড়া করে জেতেনি। কিন্তু এসব পরিসংখ্যান বরং তোলা থাক এখন। বৃহস্পতিবারের রাত হোক জেমাইমার নামে। ভারতীয় ক্রিকেটে এভাবে কেউ বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে আগে জেতাতে পারেনি। অদ্ভুতভাবে ভারত ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে খেলবে এই মুম্বইয়ে ২ নভেম্বর। তারিখটা এক। ধোনিরা কাপ জিতেছিলেন ২ এপ্রিল।
শেফালিকে ফেরানো হয়েছিল প্রতিকা রাওয়ালের জায়গায়। অনেকদিন পর জাতীয় দলে ফিরেছেন তিনি। মারকুটে ওপেনার খুব জনপ্রিয়। কিন্তু শেফালির (১০) প্রত্যাবর্তন ভাল হয়নি। তিনি যখন আউট হন ভারতের রান ১৩। কিম গার্থ যখন শেফালিকে ফেরালেন তখন গ্যালারি বিশেষ মাথা ঘামায়নি। কারণ পরিষ্কার। স্মৃতি মান্ধানা আছেন। তাঁর আর জেমাইমা রডরিগেজের জুটিতে এরপর যখন ৪৬ রান উঠে গেল, অনেকে ভেবেছিলেন টুর্নামেন্টে স্মৃতির তিন নম্বর সেঞ্চুরি অপেক্ষা করছে। কিন্তু সেই গার্থ ঘাতকের চেহারা নিয়ে ফিরিয়ে দিলেন স্মৃতিকে (২৪)। ১০ ওভারে ভারতের রান দাঁড়াল ৫৯/২। এবার চাপটা টের পাওয়া গেল।


তখন কি কেউ জানত যে সাগরপাড়ে আসল লড়াই শুরু হবে এইবার। তৃতীয় উইকেটের পার্টনারশিপে জেমাইমা আর হরমনপ্রীত রেকর্ড পার্টনারশিপ গড়ে ফেলবেন। এরমধ্যে এক নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি হল যখন হিলি জেমাইমার সহজ ক্যাচ ফেলে দিলেন। ছটফটে জেমাইমা মাঠে থাকা মানেই কিছু না কিছু হবে। তা সে তিনি ব্যাট করুন বা ফিল্ডিং। অফুরন্ত এনার্জি নিয়ে মাঠে থাকেন। তাঁকে দেখে মনে হয় না তিনি হারতে মাঠে নেমেছেন। নাহলে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে যে কোনও উইকেটে রেকর্ড পার্টনারশিপ গড়তে পারতেন না। বাকিটা অবশ্য ইতিহাস।
এখনও পর্যন্ত একজনের কথা বলা হয়নি। অধিনায়ক হরমনপ্রীত। ৩৩৯ রান তাড়া করে তুলতে গেলে একজনকে ধরতে হয়। হরমনপ্রীত শুরুতে এই কাজটাই করলেন। যাতে আরও উইকেট না পড়ে যায়। ততক্ষণে জেমাইমা স্কোর বাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু হরমনপ্রীত যখন এরপর মারতে শুরু করেন, তখন অস্ট্রেলিয়াকে প্রথমবার চাপে পড়েছে মনে হল। ২০১৭ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ভারত অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল এই হরমনপ্রীতের ব্যাটে ভর করে। তিনি ১৭১ রান করেছিলেন। কে জানত সাদারল্যান্ডের বলে ওরকম একটা ক্যাচ ধরবেন গার্ডনার। তুলে মেরেছিলেন অধিনায়ক। গার্ডনার বাউন্ডারির ধারে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই ক্যাচ তুলে নেন। হরমনপ্রীত যখন ৮৮ বলে ৮৯ রান করে ফিরে যাচ্ছেন, গোটা স্টেডিয়াম তখন স্তব্ধ। রেকর্ড পার্টনারশিপে যে ১৬৭ রান উঠেছে সেটাও তখন কেমন যেন পানসে লাগছে। তবে জেমাইমা হ্যায় না! ম্যাচ শেষে সতীর্থদের ভালবাসার অত্যাচার ঢাকা পড়ে গেলেন। ইশ, এই ছবিটাই যদি রবিবারও দেখা যায়।

আরও পড়ুন-বাঁকুড়া জেলায় এসআইআর নিয়ে বিধানসভা ভিত্তিক সর্বদলীয় বৈঠক

সেমিফাইনালের মতো ম্যাচে অ্যালিসা হিলিকে খেলাতে মরিয়া ছিল অস্ট্রেলিয়া। চোট থেকে উঠে এসে তিনি প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন। কিন্তু আগেরদিন তাঁকে নভি মুম্বই মাঠে না দেখে মনে হয়েছিল হিলি খেলবেন তো? তিনি অবশ্য খেললেন। আর ভিআইপি বক্সে বসে খেলা দেখলেন তাঁর ক্রিকেটার স্বামী মিচেল স্টার্ক। কিন্তু তাঁর ১৫ বলের ইনিংস ঠিক হিলি-সুলভ হল না। তাঁকে সেট হওয়ার আগেই বোল্ড করে দেন ক্রান্তি গৌড়। চোট পাওয়ার আগে এই বিশ্বকাপে দুটি সেঞ্চুরি হয়ে গিয়েছিল হিলির। এদিন ফিরে গেলেন ৫ রান করে।

পাওয়ার প্লে-র শেষ ওভারে হিলি যখন ফিরে গেলেন, তখন অস্ট্রেলিয়ার রান ২৫। সেমিফাইনালের মতো হাই প্রেশার গেমে চাপ তৈরি করার সময় ছিল এটাই। কিন্তু হরমনপ্রীত কৌরের বোলাররা সেটা পারেননি। আর পারেননি বলেই অতঃপর একটা দুর্দান্ত পার্টনারশিপ দেখতে পেল ডি ওয়াই পাতিল স্টেডিয়াম। এলিস পেরি (৭৭) পুরনো মুখ। অনেক বড় ইনিংস খেলেছেন। কিন্তু হিলির ওপেনিং পার্টনার ফোবি লিচফিল্ড যে সেঞ্চুরি করে গেলেন তা অসাধারণ।
হিলি টসে জিতে ব্যাটিং নিয়েছিলেন। অধিনায়ক দ্রুত ফিরে গেলেও লিচফিল্ড দমেননি। শেষপর্যন্ত আমনজোতের বলে রিভার্স সুইপ মারতে গিয়ে তাঁর ৯৩ বলের ইনিংস শেষ হয়ে গেল ১১৯ রানে। সেঞ্চুরির ঠিক পরেই অবশ্য রিচা উইকেটের পিছনে লিচফিল্ডের ক্যাচ ফেলেছেন। এই উইকেটে বোলারদের জন্য কিছু ছিল না। তাই এরকম সুযোগ ফসকালে বোলারদের কিছু করার থাকে না। প্রথম স্পেলে ক্রান্তি, দীপ্তি প্রচুর রান দিয়েছেন। যার সুযোগ নিয়ে জুটিতে ১৫৫ রান তুলে দেন লিচফিল্ড ও পেরি।

অস্ট্রেলিয়া শেষমেশ ৪৯.৫ ওভারে ৩৩৮ রান করেছে। সেটা সম্ভব হল লোয়ার অর্ডারের দৃঢ়তা ও ভারতের খারাপ ফিল্ডিংয়ের জন্য। এদিন ক্যাচ যেমন পড়েছে তেমনই বল গলেছে বিস্তর। ওভার থ্রোতে বাউন্ডারি পর্যন্ত হতে দেখা গেল। তবে এসব বলে পেরি (৭৭) আর গার্ডনারের (৬৩) হাফ সেঞ্চুরিকে খাটো করে দেখা যাবে না। পেরি আর তাহলিয়া ম্যাকগ্রা ৬৬ রান যোগ করে দলকে পরে তিনশো পার করে দেন। অস্ট্রেলিয়া অবশ্য শেষ চারটি উইকেট হারিয়েছে ৭ রানে। কিন্তু তাতে তাদের তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি।
ভারতীয় বোলিং এদিন প্রত্যাশিত মান ছুঁতে পারেনি। শ্রী চরনী আর দীপ্তি দুটি করে উইকেট নিয়েছেন। কিন্তু দীপ্তি ৯.৫ ওভারে ৭৩ রান দিয়েছেন। ৮ ওভারে ৬৬ রান দিয়েছেন রাধা যাদব। একমাত্র রেণুকা সিং ঠাকুর ৮ ওভার বল করে উইকেট না পেলেও ৩৯ রান দিয়েছেন। বাকিরা সবাই প্রচুর রান দিয়েছেন।

Latest article