এই সরকার লাইনে দাঁড় করানোর সরকার। এই সরকারের একমেবাদ্বিতীয়ম কর্মই হল, নাগরিকদের ধৈর্য যাচাই করা।
তাই, এই জমানায় বারবার মানুষকে লাইনে দাঁড়ানোর দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কখনও দু’হাজার টাকার নোট বদলাতে ব্যাংকের সামনে, কখনও আবার ইলেকশন কমিশনের নোটিশ পেয়ে শুনানি কেন্দ্রের সামনে।
বয়স্ক থেকে প্রতিবন্ধী— সকলকে শুনানির নোটিশ পাঠানো হচ্ছে। তাঁদের শুনানিতে এসে অপেক্ষা করতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, তাতেও হেলদোল নেই কমিশনের। কেন বয়স্ক বা প্রতিবন্ধীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুনানির কাজ করছে না কমিশন, প্রশ্ন মানুষের। তাঁদের রাগের কারণ স্পষ্ট এবং সঙ্গত। যাঁদের ভোটে জিতে যাঁরা ক্ষমতার মসনদে বসেছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব নিয়ে গোল পাকিয়ে বিজেপির সেইসব নেতা মন্ত্রী থেকে শুরু করে তল্পিবাহক ইলেকশন কমিশন ওই ভোটদাতাদের হেনস্থা করার খেলায় মেতেছেন। মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে ছেড়েছেন। মরছে মানুষ, ভোটার হোক বা নির্বাচন কমিশনের আধিকারিক, সবাই একটা পরিকল্পনাবিহীন নষ্ট-নীতির শিকার।
আরও পড়ুন-প্রয়াত বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া
গৌরী মান্না। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। লাঠি নিয়ে কোনও ভাবে চলাফেরা করেন। বাড়িতে বেশির ভাগ সময়ই থাকেন শয্যাশায়ী। গত রবিবার সেই বৃদ্ধাকেও নথি যাচাই করানোর জন্য যেতে হয় শুনানিকেন্দ্রে। ছেলে প্রসেনজিৎ মান্নাকে সঙ্গে নিয়ে টোটোয় চেপে কোনও ক্রমে এসে পৌঁছতে হয়েছে অতিরিক্ত জেলাশাসকের দফতরের সামনে। অতীতে মস্তিষ্কে স্ট্রোক হয়েছিল। পরে হার্ট অ্যাটাকও হয়েছিল। ইনহেলার ছাড়া এক মুহূর্তেও চলতে পারেন না। আগে পরিচারিকার কাজ করতেন। এখন অসুস্থতা এবং বয়সজনিত কারণে সেই কাজও ছেড়েছেন। কিন্তু মহান মোদি-শাহের ক্রীতদাস কমিশন সেসব কথা শুনবে কেন?
হুগলির ওই শুনানিকেন্দ্রে রবিবার যেতে হয় ৮০ বছর বয়সি সুষেণকুমার রায়চৌধুরীকেও। অতীতে পা ভেঙেছিল। কোমর ভেঙেছিল। হৃদযন্ত্রেও সমস্যা রয়েছে বৃদ্ধের। এখন তাঁর বুকে পেসমেকার বসানো। চোখেও ঠিকঠাক দেখতে পান না। গ্লুকোমা হয়েছে। বয়সজনিত কারণে কানেও ঠিকঠাক শুনতে পান না। সেই বৃদ্ধকেও রবিবার লাঠিতে ভর দিয়ে পৌঁছোতে হয়েছে শুনানিকেন্দ্রে।
এগুলো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একটা সুপরিকল্পিত ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্ট অব্যবস্থার পরিণতি। বয়স্ক, অসুস্থ এবং শয্যাশায়ীদেরও ভোটারদের রক্ষার জন্য লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। এটি এক জঘন্য নিষ্ঠুরতা। প্রবীণ নাগরিকদেরও হুইলচেয়ারে এনে লাইনে দাঁড় করানো হচ্ছে। শুনানিতে হাজির করানো হচ্ছে। অথচ তাতে বিজেপি বা নির্বাচন কমিশনের বিবেক একটুও নাড়া খাচ্ছে না। কারণ, এটা বিজেপির অ্যাজেন্ডা যা নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
আরও পড়ুন-তৃণমূলের চাপে নতিস্বীকার কমিশনের, দাবি মেনে ব্যবস্থা নেওয়ায় খুশি অভিষেক
পরিযায়ী শ্রমিকেরা বিপদে। সশরীরে সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকের হিয়ারিংয়ে উপস্থিত থাকা অসম্ভব। সেক্ষেত্রে বাড়ির লোককে কেন শুনানিতে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না? দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ ওরা। ওদের যাতায়াতের খরচ কে দেবে? কমিশন বহন করবে? ওদের বাড়ির লোক যে ডকুমেন্ট দেখাবে, সেটাই নিয়ে যাচাই করা উচিত ছিল। কিন্তু সেটা হচ্ছে না।
ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে বাঁচতে কেউ বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন দু’দশক আগে, কেউ আবার তারও আগে। ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয়ের খোঁজে ভারতে এসে গড়ে তুলেছিলেন জীবনের নতুন ঠিকানা। কিন্তু, আজ জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সেই মানুষজনকেই ফের অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বিজেপি আর নির্বাচন কমিশনের নোংরা খেলার কারণে। এঁদের অধিকাংশই মতুয়া সম্প্রদায়ের, সঙ্গে কিছু বৈষ্ণব ও নমঃশূদ্র, যাঁরা একসময় ধর্মের কারণে নির্যাতিত হয়ে দেশ ছেড়েছিলেন। এদেশে আশ্রয়ের দুই–তিন দশক পরেও নাগরিকত্ব প্রমাণের তাগিদে অসুস্থ, অক্ষম শরীর নিয়ে শুনানির লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে তাঁদের। এঁদের সকলেরই একটাই কথা, ভোট দিয়ে যাদের ক্ষমতায় আনলাম তারাই আমাদের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে চাইছে! ভোটাধিকার চলে গেলে সমস্ত সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হব। যদি নাগরিকত্ব মেলে তা কবে মিলবে, আদৌ মিলবে কি না জানি না।
আসলে এক অদ্ভুত অদৃষ্টপূর্ব ভারতের বাসিন্দা এখন আমরা। এখানে এখন নাম-গোত্র বদলালেই আইন বদল। এ দেশে এমনই বিধি চালু করছে বিজেপি। তাই দাদরি মামলায় অভিযুক্তদের ছেড়ে দিচ্ছে উত্তরপ্রদেশ সরকার। যদিও যোগী সরকারের ওই পরিকল্পনায় বাদ সেজেছে আদালতই।
মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পরেই উত্তরপ্রদেশে ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এক গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হন মহম্মদ আখলাক। সন্দেহ করা হয়েছিল, তাদের বাড়ির ফ্রিজে গোরুর মাংস রাখা হয়েছে। এবং ওই মাংস খাওয়াও হচ্ছে। ঘটনার পর ১৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও গণপিটুনির এক অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল।
সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশ সরকার তথা যোগী সরকারের তরফে একটি আবেদন জানানো হয়, সেখানে বলা হয়, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩২১ ধারায় মামলাটি প্রত্যাহার করতে চায় রাজ্য। অবশ্য যোগী সরকারের আবেদন খারিজ করেছে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট। আদালত জানিয়েছে, সরকারের যুক্তির কোনও আইনি ভিত্তি নেই। আদালত এই আবেদনকে ‘অপ্রাসঙ্গিক ও ভিত্তিহীন’ বলে মন্তব্য করেছে। মামলার বিচার অবশ্য চলবে। আগামী ৬ জানুয়ারি পরবর্তী শুনানি।
আসলে বিজেপি কোনও দিন সত্যি সত্যি চায়নি আখলাকের হত্যাকারীরা সাজা পাক।
শুধু আখলাকই নয়, এমন উদাহরণ বহু আছে। অস্ট্রেলিয়ান মিশনারি গ্রাহম স্টেইন ও সন্তানদের হত্যার ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত মহেন্দ্র হেমব্রমকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে মূল অভিযুক্ত দারা সিং। গোধরা পরবর্তী হিংসায় বিলকিস বানোকে ধর্ষণ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত ১১ জনকে ছেড়ে দিয়েছিল গুজরাত সরকার। তারপর তাদের বীরের সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
প্রকৃতপক্ষে, মোদি জমানায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সঙ্গে বৈষম্য হচ্ছে। আর এই ঘটনায় সরাসরি দেশের শাসক দল বিজেপি ও সংঘ পরিবারের দিকে আঙুল উঠছে। মার্কিন সংস্থা ইউএসআইআরএফ পরিষ্কার জানাচ্ছে, আরএসএস-এর প্রধান লক্ষ্য হল একটি ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ গঠন। এবং ভারতকে হিন্দু জাতি হিসেবে প্রচার করা। যেখানে মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি, বৌদ্ধ, পারসি এবং অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা দ্বিতীয় শ্রেণির হয়। বিজেপিও ২০১৪ সাল থেকে সংঘের সেই আদর্শ কার্যকর করতে সচেষ্ট। আরএসএস সরাসরি নির্বাচনে প্রার্থী দেয় না। তবে তারা বিজেপির জন্য স্বেচ্ছাসেবক সরবরাহ করে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেও একজন স্বেচ্ছাসেবক। এজন্যই ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা সংক্রান্ত সাংবিধানিক সুরক্ষা থাকা সত্ত্বেও, ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক পরিবেশ গড়ে তুলছে।
এর বিরুদ্ধে বুথে বুথে লড়াই গড়ে তুলতে হবে। নইলে ভারত বাঁচবে না।

