নরেন্দ্র মোদির আসল চ্যালেঞ্জার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি নিজের কাজ এবং নিত্যনতুন চিন্তাভাবনার জোরে এই কৃতিত্বে স্বীকৃত হয়েছেন। এইটাই তাঁর পুঁজি। এই পুঁজি দুর্মূল্য নয়, অমূল্য।
দেশে আরও কয়েকজন অ-বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী আছেন। তাঁরা কতটা বিজেপি-বিরোধী তা অস্পষ্ট। ইংরেজিতে তাঁদের Fence Sitter বললে বোধহয় ভুল হবে না। রাজনীতির জুয়া খেলায় তাঁদের মস্ত সুবিধা। জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখানেই ব্যতিক্রমী। তাঁর এই সুবিধা নেওয়ার ক্ষুধা নেই। বিজেপি-বিরোধী এবং অ-কংগ্রেসি অবস্থান নেওয়ার এটা তাঁর মস্তবড় সুবিধা।
আরও পড়ুন-ধর্মীয় সার্কিট গড়ে পর্যটন
জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজ পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত। তিনি কোনও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর পুত্র বা কন্যা নন। তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করার কালে তিনি কংগ্রেসে কদর পাননি। বরং তাঁকে বিভিন্নভাবে দমিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছিল। তাঁর আইটি সেলের কর্মীদের দিয়ে গড়ে তোলা চোখধাঁধানো চারপাশ নেই। এইসব ঘাটতিকে পরাস্ত করে জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোথা থেকে কোথায় উঠে এসেছেন ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী তখন একবার কালীঘাটের পর্ণকুটিরে এসেছিলেন। মমতার শয়নকক্ষ দেখে প্রধানমন্ত্রীর চোখ কার্যত কপালে উঠে গিয়েছিল। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, ট্রেনের বাঙ্কের মতো সাইজের একটা তক্তপোষ দেশের রেলমন্ত্রীর শোবার খাট হতে পারে! এই ঘটনার সাক্ষী ছিলাম আমিও।
আরও পড়ুন-পুরুলিয়ায় ফিল্মসিটি
ফিরে আসি রাজনীতির কথায়। অন্য কয়েকটি আঞ্চলিক দল বেশ হিসাব করে ধরি মাছ, না ছুঁই পানি— এই সুবিধাবাদী কৌশল অবলম্বন করছে। সময় ও সুযোগ এলে তারা যে কোনও দিকে নাড়া বাঁধার পথ খোলা রাখছে। জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু এই দু’নম্বরি কৌশলকে আমল দিচ্ছেন না। মোদিকে বিরক্ত না করলে জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিরাপদ। তিনি সে সুযোগ চাইছেন না। তিনি সব সময়ে বিজেপি এবং মোদির বিরুদ্ধে লেলিহান। সেই কারণে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীদের পিছনে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্য অবিজেপি শাসিত রাজ্যেও সেটা চলছে। কিন্তু বাংলায় যেভাবে সিবিআই, ইডি’র মতো সংস্থাগুলি নজিরবিহীনভাবে সক্রিয় সেটা অন্যত্র নয়। লক্ষ্য তো একটাই, মোদির দরবারে জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নতজানু করা। কিন্তু রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে আজও পর্যন্ত ধমকে-চমকে ‘অগ্নিকন্যা’কে কেউ দমাতে পারেনি। অতীকে কেন্দ্রে কংগ্রেস এবং এনডিএ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর পদ ছেঁড়া চটির মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে এসেছেন বাংলার গর্ব জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন-“টেন্ডারে স্বজনপোষণ চলছে” বাঁকুড়ার প্রশাসনিক বৈঠকে কড়া বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর
তাই দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, যাকে ওয়াকিবহাল মহলের একটা অংশ অঘোষিত ‘জরুরি অবস্থা’ বলছে, এখানেও লড়াইয়ের ময়দানে মমতা একাই একশো। তাঁর মতো এত ঝুঁকি স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে কাউকে নিতে দেখা যাচ্ছে না।
এইরকম চাপের মধ্যেও তিনি মাথা ঠান্ডা রেখে রাশি রাশি সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্প নিয়েছেন। তার জন্য আন্তর্জাতিক মর্যাদাও অর্জন করেছেন তিনি। সেক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ‘অর্থনৈতিক অবরোধ’ গড়ে তুলেছে। বাংলার প্রতি অবিচার করা হচ্ছে, স্রেফ মমতাকে হেয় করার জন্য। কারণ, মোদির আসল চ্যালেঞ্জ তাে তিনিই। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে বাংলাকে টাকা না দেওয়া, বৈষম্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।
আরও পড়ুন-নির্বাচনী আদর্শ আচরণ বিধির মধ্যেই ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীকে নোটিশ নির্বাচন কমিশনের
এসব করেও মমতাকে জব্দ করা যাচ্ছে না। তিনি নতুন নতুন চিন্তাভাবনা ও আন্দোলনমুখী কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচারের আগুন জ্বালিয়ে রেখেছেন। তা নিভতে দিচ্ছেন না। এই ব্যাপারে তাঁর পাশে দাঁড়ানো দূরের কথা, মমতার দশ হাতের মধ্যেও কেউ নেই। তাঁরা নিজ নিজ রাজ্য এবং নিজ নিজ স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত। ভারতমাতার স্বার্থরক্ষায় নিজেকে বাজি রেখেছেন মমতা।
আজ থেকে ১৭ বছর আগের একটা ঘটনার কথা বলতে চাই। আমেরিকায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। সে দেশের রাজধানী ওয়াশিংটনে ঘুরছি। হোয়াইট হাউসের সামনে কয়েকমাস ধরে তাঁবু খাটিয়ে বসে আছেন এক বৃদ্ধা। ওই মার্কিন মহিলা মানবাধিকার কর্মী। নানা ইস্যুতে তাঁর প্রতিবাদ আন্দোলন। আলাপ করলাম। ভারতীয় পরিচয় দেওয়াতে তিনি জানতে চাইলেন, কোন শহরের বাসিন্দা? কলকাতা শুনেই যেটা তিনি বললেন, অনেকেই বিস্মিত হবেন! বৃদ্ধার মন্তব্য ছিল, ‘‘মিস মমতা ব্যানার্জিকে চেনেন? তিনিও তো আমার মতো প্রতিবাদী এক মহিলা।’’ সত্যি করেই তখন মমতার নেতৃত্বে বাংলা সিপিএমের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে উত্তাল।
আরও পড়ুন-বাঁকুড়ায় পর্যটনে জোর, একনজরে দেখে নেওয়া যাক কী বললেন মুখ্যমন্ত্রী
আসলে মমতা তো কোনও পারিবারিক পরিচয়ের মাধ্যমে উঠে আসেননি। মরণপণ লড়াই হল তাঁর আসল পরিচয়। আপসহীন। অন্যায়ের সঙ্গে সমঝোতা তাঁর রক্তে লেখা নেই। তাই এত চাপের মুখেও মমতা শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে আছেন। সেই কারণেই বর্তমানে জাতীয় স্তরে মমতার সম্ভাবনা সবচেয়ে উজ্জ্বল। এই বাস্তবকে অস্বীকার করার সাধ্য অন্যদের নেই।