একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। কিন্তু কোটি কোটি ভারতবাসী রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে চন্দ্রযানের (৩) ল্যান্ডার যার পোশাকি নাম ‘বিক্রম’ সফলভাবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নামতে পারবে কি না? ক’দিন আগে এইরকম একটা প্রকল্পে রাশিয়া অকৃতকার্য হয়েছে। আমাদেরও চন্দ্রযান-২ সফল হয়নি। উদ্বেগ এ কারণেই। কিন্তু ঠিক সময়ে ইসরো’র প্রধান এস সোমনাথ যখন আকাশের দিকে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুঁড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, কয়েক হাজার বিজ্ঞানী হাততালিতে, আবেগে কান্নায় কলরোল করে উঠলেন, তখন আমরা ১৪০ কোটি ভারতবাসীর মুখে ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে।’ আমরা বুঝলাম আমরা পেরেছি। আমরা বুঝেছি আমাদের বিজ্ঞানীরা পৃথিবীশ্রেষ্ঠ। আমাদের সন্তানরা আমাদের দেশকে গর্বিত করেছে— বিশ্বের মানচিত্রে, বিজ্ঞান গবেষনায় ভারত উজ্জ্বল স্থানকে আরও উজ্জ্বলতর করেছে।
আরও পড়ুন-পাকিস্তানই ফেভারিট, বললেন আজমল
অন্য কথায় যাওয়ার আগে আমি প্রথমেই বলে রাখতে চাই যে, অনেকে ইসরো’র এই সাফল্যকে চিন, রাশিয়া বা আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করছেন। একেবারেই তা নয়। ভারত এই দেশগুলির পর্যায়ভুক্ত হল তা নয়, তার চাইতে বেশি। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে ল্যান্ডার নামাতে সাহস করেনি। রাশিয়া চেষ্টা করে সফল হয়নি। ভারত সেই স্পর্ধা দেখিয়েছে এবং সফল হয়েছে।
আরও পড়ুন-ঘূর্ণিঝড়ের পর উপকূলে ১৫ কোটি গাছ বসেছে, বনমহোৎসবে মুখ্যমন্ত্রী
১৯৫৮ সালে পণ্ডিত নেহরু একটি প্রস্তাব নিয়েছিলেন সংসদে। তার শিরোনাম সায়েন্টিফিক পলিসি প্রস্তাব। ১৯৬১ সালে তিনিই সরকারের অ্যাটমিক এনার্জির হাতে মহাকাশ গবেষণার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। লক্ষ্য ছিল মহাশূন্যকে শান্তির লক্ষ্যে ব্যবহার। প্রকল্পটি দীর্ঘমেয়াদি। কিন্তু ভারতের নীতির পক্ষে সাযুজ্যপূর্ণ। ড. হোমি জাহাঙ্গীর ভাবাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পণ্ডিত নেহরু তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আপনি আপনার মতো টিম সাজান। ভবিষ্যৎ পৃথিবী বিজ্ঞানের।’’ পরের বছরই গঠিত হয় ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কমিটি ফর স্পেস রিসার্চ।’ চেয়ারম্যান করা হয় বিক্রম সারাভাইকে। এই যুবক বিজ্ঞানীর সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে। তাঁদের আমেদাবাদের বাড়িতে কবি বহুবার অতিথি হয়েছেন। শুধু তাই না, বিক্রম যখন কেমব্রিজে পড়তে গেলেন তখন সঙ্গে নিয়ে গেলেন কবি’র সুপারিশপত্র। চন্দ্রযান ৩-র ল্যান্ডারের নাম তাঁকে সম্মান জানিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘বিক্রম’।
আরও পড়ুন-এশিয়া কাপে কাল নেপাল-পাকিস্তান
১৯৬৯ সালে বিক্রম সারাভাই-এর নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ইসরো তৈরি করার পর মহাকাশ গবেষণায় এক নতুন দিগন্ত খুলে গেল। ১৯৯৯ সালেই ইসরো ঠিক করে ফেলেছিল চাঁদে ভারতের মহাকাশযান পাঠানো হবে। তৈরি হল ন্যাশনাল লুনার মিশন টাস্ক। ২০০৩ সালে স্বাধীনতা দিবসে ভাষণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী ঘোষণা করেছিলেন, ভারত তৈরি হচ্ছে মহাকাশ গবেষণার চূড়ান্ত সাফল্য প্রদর্শনের জন্য। ভারত তার নিজস্ব মহাকাশযান চাঁদে পাঠাতে তৈরি। এই প্রকল্পের নাম ছিল তখন সোমায়ন, অটলজি নাম দিলেন চন্দ্রায়ন। কবি মানুষ ছিলেন। চাঁদের অপরূপ শোভা নিশ্চয়ই তাঁকে আকৃষ্ট করেছে। ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ অনুমতি দিলেন চন্দ্রায়ন-১-এর। ২০০৪ সাল থেকেই চন্দ্র মিশন সফল করতে সরকার সাহায্য করে এসেছে।
আরও পড়ুন-
২০০৮ সালে বাইরে নয়, কোনও জনসভায় নয়, প্রথম রাজ্যসভায় এসে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন যে, আমরা চাঁদের দেশে পাড়ি দিচ্ছি। মাত্র ৪/৫ লাইনের একটি বক্তব্য। তাতে ৯০ ভাগ বিজ্ঞানীদের সাফল্য ও চিন্তার কথা। সারা সংসদ উঠে দাঁড়িয়ে ৫ মিনিট ধরে হাততালি দিয়ে হর্ষধ্বনি করেছিল। আমার সুযোগ হয়েছিল এই হর্ষমাঝে উপস্থিত থাকার। লোকসভাতেও সেই অবস্থা হয়েছিল। সেন্ট্রাল হলে আমরা মিষ্টি বিতরণ করেছিলাম। কোনও রাজনীতি নয়। দেশের জন্য, বিজ্ঞানীদের জন্য গর্বে আমাদের বুক ভরে গিয়েছিল। বিজ্ঞানের জগতে আমরা পৃথিবীর বৃহৎ দেশগুলির সঙ্গে একাসন চাই। অনেক এগিয়ে। চার বছর আগে আমরা যখন ব্যর্থ হয়েছিলাম তখন চোখের জল বাঁধ মানেনি। চোখের নোনাজলে আমাদের সন্তানরা দেওয়ালে, আকাশের গায়ে লিখেছিলেন শপথ বাক্য। ‘আমরা করে দেখাব।’ আজ আমরা সফল। চাঁদের বুকে ভারতের গৌরব টিকা জ্বলজ্বল করছে। আমাদের বিজ্ঞানীরা, ইসরো প্রতিষ্ঠানের জন্য সারা ভারত গর্বিত। এরমধ্যে আর একটা সাফল্য আছে, এত কম খরচে (মাত্র ৬১৫ কোটি) এত বড় অভিযান হয়েছে। মুম্বইয়ে একটা সিনেমা করতে এর চাইতে বেশি খরচ হয়। একমাত্র ভারতই এমন পারে।
আরও পড়ুন-নয়া মানচিত্রে অরুণাচল প্রদেশকে ফের নিজের বলে দাবি চিনের, সরব ভারত
ইসরোর সব বিজ্ঞানীরা আমাদের বীর, তাঁদের নমস্কার। কিন্তু বাঙালিদের কথা একটু আলাদা করে বলি। যাঁরা সরাসরি এই চন্দ্রযান প্রকল্পে যুক্ত। বাঁকুড়ার অনুজ, যাঁর নকশা করা ক্যামেরা ‘বিক্রম’ এখন ঘুরছে চাঁদের পিঠে, মুর্শিদাবাদের তুষারকান্তি দাস (গণিত), তোসিফুল আরা (পদার্থবিদ্যা) দু’জনেই আমার কলেজ কৃষ্ণনাথ কলেজের প্রাক্তনী। নিউটাউনের সৌম্যজিত, বীরভূমের, উত্তর দিনাজপুরের ছেলেরা রয়েছে একেবারের সামনের সারিতে। যেটা না বললেই নয়, যে, সফট ল্যান্ডিংয়ের জন্য সারা দেশের নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে মডেল সংগ্রহ করেছিল ইসরো। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেলটি প্রাধান্য পেয়েছিল চন্দ্রযান-৩ এর এই মিশনে। আমরা গর্বিত।
আরও পড়ুন-পশ্চিমবঙ্গ দিবস নিয়ে আজ বৈঠক
অনেক অনেক দিন বাদে আমরা, ভারতবাসী বিজ্ঞানের এমন কালজয়ী যাত্রায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ এবং রাজনীতি নির্বিশেষে অনাবিল আনন্দে মেতে উঠলাম। জাতির জীবনে এমন মুহূর্ত খুব কম আসে। আমরা যেন ক্ষুদ্রস্বার্থে সেটাকে ব্যবহার করে সমগ্র সময়টি কালিমালিপ্ত না করি। জয় হিন্দ।