বার্বাডোজ, ২৯ জুন : হার্দিক কাঁদছেন। রোহিত ভিড় থেকে দূরে চোখের জল মুছছেন। আমেদাবাদ দাগা দিয়েছিল। বার্বাডোজ ভুলিয়ে দিল। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারেও এত সুখ? কে জানত। সতেরো বছরে যা কোনও মুলুকে হয়নি, হল বহু ইতিহাসের সাক্ষী কেনসিংটন ওভালে। কাপ জিতল ভারত। প্রতীক্ষা, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর। হিসাব বলছে, এগারো বছর পর এটাই কোনও আইসিসি ট্রফি।
এতক্ষণ আবেগ বুকে চেপে বসেছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। কাপ নিশ্চিত হয়ে যেতেই শূন্যে ঘুসি ছুঁড়লেন। তারপর নেমে এলেন মাঠে। শেষবার। এই মুহূর্তে তিনি প্রাক্তন কোচ। রবি শাস্ত্রীদের মতো। এই দল, এই ড্রেসিংরুম পড়ে থাকবে অন্য কারও জন্য। যন্ত্রণায় লোকে হাসে। দ্রাবিড়ও তাই। তাঁর আবেগে ডুবে যাওয়ার আরও কারণ আছে। ২০০৭-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের গ্রুপ লিগ থেকে বিদায় নিয়েছিল ভারত। অধিনায়ক দ্রাবিড়। হয়তো ভাবছিলেন, কপালে কাপ থাকলে কে আটকায়!
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
শেষ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকার দরকার ছিল ১৬ রান। ওরা ১৬৯/৮ তুলে হেরে গেল ৭ রানে। হার অবশ্য আরও আগে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, যখন ক্লাসেন আউট হলেন। হার্দিক স্লোয়ারে শুধু তাঁকে ঠকাননি, রামধনুর দেশের থেকে কাপটাও কেড়ে নিলেন। পেন্ডুলামের মতো দুলেছে এই ম্যাচ। ডি’কক, ক্লাসেন, মিলার মিলে প্রায় ম্যাচ বের করে নিয়েছিলেন। কিন্তু বুমরাকে রোহিত দ্বিতীয় স্পেলে নিয়ে আসার পর থেকে আবার ম্যাচে ফিরল ভারত। সেখান থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কপাল খারাপ মার্করামদের। চোকার্স শব্দটা নামের পাশে থেকেই গেল!
কুইন্টন ডি’ককের জন্য ফাইন লেগ রেখে ট্র্যাপ সাজিয়েছিলেন রোহিত। তিনি সেই ট্র্যাপে উইকেট দিয়ে গেলেন। অর্শদীপ লেগ স্ট্যাম্পের উপর শর্ট বল দিয়েছিলেন। ডি’কক হুক মারতে গিয়ে নিজেকে তুলে দিলেন কুলদীপের হাতে। এই উইকেটই চাইছিল ভারত। ১২ রানে হেনড্রিক্স (৪) আর মার্করাম (৪) আউট হয়ে যাওয়ার পর স্টাবসকে নিয়ে দিব্যি সামলে নিয়েছিলেন ডি’কক। তিনি আউট হলে রোহিতরা স্বস্তি পাবেনই।
কিন্তু মিলার (২১) আর ক্লাসেন (৫২) ১২-১৫ ওভারের মধ্যে যে ঝড় তুলে দিলেন, তাতেই ম্যাচ তাঁদের দিকে সরে গিয়েছিল। তাঁরা যখন ম্যাচ নিজেদের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, বুমরাকে দ্বিতীয় স্পেলে আগেই আনা যেত। কিন্তু রোহিত যখন বুমরাকে আনলেন, ততক্ষণে অক্ষর এক ওভারে এক ঝুড়ি রান খেয়ে প্রায় হার ডেকে এনেছেন। ভয়ঙ্কর এই জুটি ঝড়ের বেগে ৪৫ রান তুলে দেওয়ার ক্লাসেন ঠকে যান হার্দিকের স্লোয়ারে।
আরও পড়ুন-চেন্নাই থেকে জঙ্গি ধরে নিয়ে এল এবার বাংলার এসটিএফ
কিন্তু তখনও মিলার ছিলেন। ক্রমশ ভয়ঙ্কর হচ্ছেন। বুমরা আবার ভারতকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনলেন ইয়ানসেনকে (২) বোল্ড করে। এটা ভিতরে ঢুকে এল। হেনড্রিক্সকে বোল্ড করেছিলেন আউট সুইংয়ে। বুমরা সোবার্সের মাঠে তখন বলকে কথা বলাচ্ছিলেন! শুধু দরকার ছিল পাশে কাউকে। যেটা অর্শদীপ করে দিলেন। ডেথ ওভারে আফ্রিকানদের তিনি নড়তে দেননি।
শেষদিকে দুটো পার্টনারশিপ না হলে ভারতের ১৭৬/৭ অবশ্য কিছুতেই হত না। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, বিরাট কোহলি ৫৯ বল কাটিয়ে না গেলে এই রানটা আসত না। টুর্নামেন্টে ৭৫ রান ঝুলিতে নিয়ে শনিবার কেনসিংটন ওভালে নেমেছিলেন বিরাট। মার্কো ইয়ানসেনের বলে ৭৬ রান করে তিনি যখন ফিরে যাচ্ছেন, বিরাট আবার কিং কোহলি হয়ে গেলেন।
বিরাট কেন রান পাচ্ছে না, সেটা নিয়ে ক্রিকেট দুনিয়া হামলে পড়েছিল। কল্পনা করুন ফাইনালে টপ অর্ডারের গণ ব্যর্থতায় শামিল হয়ে বিরাটও ১০-১৫ করেছেন! তাহলে কোথায় থাকত ভারতের রান! ইউরোতে রোনাল্ডো এখনও গোল পাননি। পর্তুগাল কোচ মার্টিনেজের কোনও মাথাব্যথা নেই। জানেন তাঁর হিরো বড় ম্যাচের প্লেয়ার। খেলে দেবে। বিরাটও তাই। বাকিরা রোজ খেলবেন। তিনি কিং কোহলি, দল যখন সংকটে খেলে দেবেন।
আমেদাবাদে গতবছর ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারতের হারে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের খোঁচা দিয়েছিলেন। সব ম্যাচ জিতে ফাইনালে হেরেছিল ভারত। এখানে সেই এক পরিস্থিতি ছিল। অপরাজিত থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে নেমেছিলেন রোহিতরা। কিন্তু পাওয়ার প্লে-র মধ্যে ৩৪ রানে ৩ উইকেট চলে যাওয়ার পর আমেদাবাদের ছবি সামনে আসছিল। ১৭ বছর আগে প্রথম টি-২০ বিশ্বকাপ। তারপর শূন্য। ভয় তো লাগবেই।
আরও পড়ুন-বৃষ্টি হলেও আর্দ্রতার জেরে চলবে অস্বস্তি
রোহিত যেন আগে থেকে তৈরি ছিলেন টস জিতলে ব্যাটিং নেবেন। বলছিলেন, এখানে আগেও খেলেছি। ভাল উইকেট। দেখে তো ব্যাটিং ট্র্যাক মনে হচ্ছে। তিনি খেয়াল করেননি, ম্যাচের আগে পিচ রিপোর্ট করতে এসে ইয়ান বিশপ কিন্তু বলেছিলেন যে উইকেটে ক্যারি, বাউন্স আছে। বোলাররা সুবিধা পাবে। সেটাই হল। কেশব মহারাজ একেবারে শুরুতেই রোহিতকে (৯) তুলে নেন। এরপর ঋষভও তাঁর শিকার (০)। পরিস্থিতি আরও খারাপ হল রাবাডা সূর্যকে (৩) তুলে নেওয়ার পর।
এই গোটা অধ্যায় উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে দেখলেন বিরাট। সেই ভয়ঙ্কর ব্যাডপ্যাচ ফিরে এসেছে কি না চর্চার মধ্যেই আস্তিনের ভিতর থেকে আসল বিরাটকে বের করে আনলেন। পঞ্চাশ অবধি রান আ বল। আসলে ইনিংসটা গুছিয়ে নিলেন। কারা যেন বলে টি-২০ ক্রিকেটে কোহলির স্ট্রাইক রেট খারাপ। প্রথম ৩৭ বলে বাউন্ডারি নেই। ৭৬ রানের ইনিংসে হাতে গোনা চার-ছয়। এসব নিয়েও যখন ভারতকে পৌনে দু’শোতে নিয়ে গেলেন, তাহলে বিরাটের স্ট্রাইক রেট চর্চার আর দরকার আছে?
যে দুটো পার্টনারশিপ ভারতকে খাদের ধার থেকে টেনে তুলেছে, তার একটা অক্ষর (৪৭) আর বিরাটের ৭২। পরেরটা বিরাট আর শিবম দুবের (২৭) জুটিতে ৫৭। অক্ষর এদিন ৩১ বলে ৪৭ রান করে গিয়েছেন। একটা সময় রবীন্দ্র জাদেজার ছায়ায় চাপা পড়তেন। এদিন খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে স্টাবকে (৩১) ফেরালেন। জাদেজা এদিন ২ রান করেছেন।