ভারতের অস্কার জয়গাথা

নাটু নাটু আর দি এলিফ্যান্ট হুইস্পারার্স। এখন মুখে মুখে এ-দুয়ের কথা। অস্কারের মঞ্চে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা ছিনিয়ে নেওয়ার পর, এই দুটিকে ঘিরেই আমাদের যাবতীয় আবেগের আবর্তন। সেই অবসরে ইতিহাসের পাতা উল্টে এরকম গৌরব মুহূর্তের কথা জানালেন সুবল সরদার

Must read

অস্কারের মঞ্চে ভারতের বিজয় ইতিহাসের শুরু ১৯৮৩-তে। ভারতের প্রথম অস্কার জয় ‘গান্ধী’ সিনেমা দিয়ে। পোশাক-বিন্যাসে অস্কার বিজেতা হন ভানু আথাইয়া। সাজসজ্জার পরিকল্পনা কীভাবে উন্নত শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছয় সেটা দেখতে হলে দর্শকদের দেখতেই হবে ‘গান্ধী’ সিনেমা।

আরও পড়ুন-ভরসার ভেলা, সুস্থ পথ চলা ভ্যাকসিন

এই ছবির আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু পোশাক-বিন্যাস। এখানে পোশাক নিছক ড্রেস অফ সিনেমা নয়, ফেস অফ সিনেমা। ‘গান্ধী’ সিনেমার পোশাক-পরিকল্পনায় গাম্ভীর্য, আভিজাত্য, নান্দনিক সৌন্দর্যের নিগূঢ় মেলবন্ধন ঘটে যা দেখে বিস্ময় লাগে চোখে, মনে দাগ কাটে। বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক আ্যটেনবারো গান্ধীজির জীবন নিয়ে ‘গান্ধী’ সিনেমা পরিচালনা করেন। অভিনয় করেছেন বলিউডের ক্যানডিস বার্গেন এবং এডোয়ার ফক্স। পোশাক-বিন্যাসে পোশাক-শিল্পী ভানু আথাইয়া। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস এবং সহিষ্ণু আন্দোলন জনমানসে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করে, এটাই হচ্ছে ছবির প্রতিপাদ্য বিষয়। পিরিয়ড ড্রামার ক্ষেত্রে পোশাকের গুরুত্ব সমধিক। ভানু সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন ‘গান্ধী’তে।

আরও পড়ুন-আজ ৩০ থেকে ৪০ কিমি বেগে ঝোড়ো হাওয়া, ঝড়ে বিপর্যস্ত ট্রেন পরিষেবা

অস্কারের বিজয় রথের চাকা গড়িয়ে চলে। তার ধারক হয়ে ওঠেন ‘পথের পাঁচালী’র বিশ্ববন্দিত পরিচালক সত্যজিৎ রায়। সাল ১৯৯২। তিনিই ভারতীয় সিনেমা জগতে অস্কারের ইতিহাস লিখলেন। পরিচালক হিসেবে বিশ্বের সেরাদের সেরা তিনি। তাঁর পরিচালিত সিনেমা ‘পথের পাঁচালী’ বিশ্বের মহান শিল্পের অন্যতম। সর্বকালের সবার প্রিয় ছবির মধ্যে অন্যতম। কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’র অবলম্বনে এই হরিহর, সর্বজয়া তাদের মেয়ে দুর্গা এবং ছেলে অপু— এই কেন্দ্রীয় চরিত্র নিয়ে গল্প আর্বতিত হয়। আমাদের শৈশব খুঁজে পাই অপু, দুর্গার মধ্যে। তাদের গ্রাম্য, সরল জীবন বড় দুঃখ-কষ্টের। রোম্যান্টিক কবি পি বি শেলী বলেছেন ‘sweetest songs are those that tell of saddest thought’। খুবই দুঃখের বলেই হয়ত ‘পথের পাঁচালী’ খুবই সুন্দর। দুর্গার আকস্মিক মৃত্যু হৃদয়বিদারক, হৃদয় খাঁ-খাঁ করে। দৈববলে সে যদি বেঁচে যায়। দুঃখের চেয়ে দ্বিগুণ আনন্দ সৃষ্টি হয় দর্শকদের মনে। সময় বড় নিষ্ঠুর। দর্শকদের চোখের জলে দুর্গার বিসর্জন হয়। সেই সত্যজিৎ রায় জীবনকৃতি সম্মান পেলেন অস্কারের সৌজন্যে।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

২০০৯ সালে এ আর রহমান অস্কার জয় লাভ করেন ‘স্লাম ডগ মিলিয়েনিয়ার’ ছবিতে ‘জয় হো’ গানের জন্য। সেই সঙ্গে গুলজারও অস্কার জয় করেছেন ওই একই ছবি ‘জয় হো’ গানের জন্যে। রসুল পুকুট্রি ওই একই ছবিতে সাউন্ড মিক্সিং-এর জন্যে অস্কার জয়ী হন। ছবির পরিচালক ড্যানি বয়েল, অভিনয় করেছেন হলিউড, বলিউডের অভিনেত্রী, অভিনেতা অনিল কাপুর-সহ দেবী প্যাটেল, ফিদা পিন্টৌ। ছবির পটভূমি তিন পথশিশুর জীবন-দুঃখের কথা। সেখান থেকে মুক্তির জন্যে তাদের অদম্য লড়াইয়ের এক লোমহর্ষক কাহিনি হচ্ছে ‘স্লাম ডগ মিলিয়েনিয়ার’ এর প্রতিপাদ্য বিষয়।

আরও পড়ুন-দ্বিচারী কংগ্রেস, বিকল্প নীতিতে লড়বে তৃণমূল

এর পর এ-বছর। ‘নাটু নাটু’র জয়ে আমরা উচ্ছ্বসিত, গর্বিত। গানের সঙ্গে নাচের সমন্বয়ে শিল্পসৌন্দর্য কেমন হয় তা ‘আর আর আর’-এ দেখা যায়। গান এই ছবিতে নাচ হয়ে ঝড় তোলে দর্শকদের মনে। নয়ন হৃদয়ের মধ্যে গিয়ে আকুল করে প্রাণ। নাচ যদি দৈহিক সৌন্দর্যের অনন্য প্রকাশ ভঙ্গিমা হয়, গান সৃষ্টিশীল মননশীলতার সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। গান আর নাচে মোহিত হতে হয় এই ছবিতে। সেরা মৌলিক গানের জন্যে সুরকার এম এম কিরাবানি এবং কণ্ঠশিল্পী চন্দ্র বোস অস্কার পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁরা গানের ভুবন ভরিয়ে দেন ভারতীয় গানের জাদুতে। ভারতীয় গানের বিশ্বজয় বিস্ময় উদ্রেগ করে বইকি! তখন সুরের মূর্ছনায় ডুব দেয় লস অ্যাঞ্জেলেস-সহ সারা বিশ্ব। ওই ছবির দুই মহাতারকা হচ্ছেন দুই নৃত্যশিল্পী রামচরণ তেজা এবং এন টি আর জুনিয়র। পরিচালক এস এস রাজামৌলি। ছবির পটভূমি রাজা এবং ভীম হচ্ছে ভারতীয় মল্লযোদ্ধা— যারা অত্যচারী ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে ক্রসেড ঘোষণা করেছিল।

আরও পড়ুন-দ্বিচারী কংগ্রেস, বিকল্প নীতিতে লড়বে তৃণমূল

সেরা তথ্যচিত্র ‘দি এলিফ্যান্ট হুইসপারার্স’। এর জন্যে পুরস্কৃত হলেন পরিচালক কার্তিকী গনজালভেস এবং প্রয়োজক গুনীত মোঙ্গা। ৪০ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবির কেন্দ্রবিন্দু রাজু নামে এক অনাথ হস্তিশাবক। বিষয় তামিলনাড়ুর মেদুমালাইয়ের এক হস্তী-পুনর্বাসন কেন্দ্র। সেখানকার দুই কর্মী বোম্মান আর বেল্লিকে মা-বাবার মতো ভালবাসে সদ্য-মা-হারা হস্তিশাবক রাজুকে। অনাথ বন্যের আর মানুষের নিটোল ভালবাসার এক আখ্যান নিয়ে তৈরি ‘দি এলিফ্যান্ট হুইসপারার্স’। গুনীত মোঙ্গা— ভারতের ইতিহাসে তিনিই প্রথম প্রযোজক হিসেবে অস্কার বিজেতা।

আরও পড়ুন-বাংলায় ফিরল টাটা

‘সেরা আন্তর্জাতিক ফিচার ছবি’কে অস্কারের সবচেয়ে সম্মানজনক বিভাগ বলে মনে করা হয়। ২০২০ সালের আগে পর্যন্ত এই বিভাগের নাম ছিল ‘সেরা বিদেশি ভাষার ছবি’ (বেস্ট ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ফিল্ম)। এই বিভাগে এখনও পর্যন্ত ভারতের তিনটি ছবি মনোনীত হয়েছিল। কিন্তু অস্কার তারা আনতে পারেনি। ছবি তিনটির নাম ‘মাদার ইন্ডিয়া’ (১৯৫৭), ‘সালাম বম্বে’ (১৯৮৮) এবং ‘লগান’ (২০০১)।
২০২৩ সাল মনে থাকবে জোড়া অস্কার জয়ের জন্যে। তাই লস অ্যাঞ্জেলেসের রজনী ছিল ভারতের কাছে অস্কার রজনী। আমাদের কাছে অন্যতম স্মরণীয় দিন। এভাবে লস অ্যাঞ্জেলেসের ৯৫তম অস্কার আসর আমাদের কাছে গর্বের এবং আনন্দের দিন হয়ে ওঠে।

Latest article