বেশ কিছুদিন ধরেই আমরা দেখছিলাম এবং শুনছিলাম আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার কিছু ঘটনা। সেখানে সরকারের বিগত দিনে নেওয়া একাধিক অর্থনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের মাশুল দিয়ে অস্বাভাবিক হারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির (Inflation) ফলে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। যার পরিণামে সে-দেশের রাষ্ট্রপতিকে পর্যন্ত ক্ষুব্ধ জনতার রোষে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মাহেন্দ্রা রাজাপক্ষের বাড়িতে ক্ষুব্ধ জনতা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে এবং গতকালের একটি ভিডিও সারা পৃথিবীর মানুষকে শিহরিত করেছে। সেখানকার কৃষিমন্ত্রী জনস্টন ফার্ন্দানকে গাড়ি-সহ লেকে ফেলে দিচ্ছে সেখানকার জনগণ। আর এই সিঁদুরে মেঘে অশনিসংকেত দেখছেন ঘরপোড়া গরু আপামর ভারতবাসী। এমন একটা সময়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি যেখান থেকে ঠিক আট বছর আগে আমাদের দেশের সরকার যখন ক্ষমতায় এসেছিল তখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরি দেবেন।
উল্টে ২০১৪ সালের তুলনায় ২০২২ পর্যন্ত শুধুমাত্র নরেন্দ্র মোদির জমানায় এই সাত-সাড়ে সাত বছরে কাজ হারিয়েছেন প্রায় ১২ কোটিরও বেশি মানুষ। এই তথ্য দিয়েছে The Centre for Monitoring Indian Economy (CMIE)। বলা হচ্ছে ভারতের প্রায় ৯০ কোটি জন্যসংখ্যার মাত্র ৪০ শতাংশ মানুষ বর্তমানে কোনও না কোনও কাজে নিযুক্ত রয়েছেন। আর ৪৩ কোটি মানুষ হতাশ হয়ে কাজের খোঁজ করাই বন্ধ করে দিয়েছেন। এই ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে পিপল রিসার্চ অন ইন্ডিয়া’স কনজিউমার ইকোনোমির সমীক্ষায়।
আরও ভয়ঙ্কর তথ্য হল যে, ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র ২০ শতাংশ মানুষের আয় ২০১৫-’১৬ সালের তুলনায় ২০২০-’২১ সালে প্রায় ৫৩ শতাংশ কমেছে। আর উল্টোদিকে একইভাবে সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশের আয় বেড়েছে ৩৯ শতাংশ। অর্থাৎ গরিব মানুষের আয় আরও কমছে এবং ধনীদের আয় আরও বাড়ছে। ভারতের প্রায় ২৮ জন মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি যাঁরা দেশের বিভিন্ন ব্যাঙ্কের টাকা, কো-অপারেটিভের টাকা, সাধারণ মানুষের গচ্ছিত টাকা আত্মস্যাৎ করে বেরিয়ে গেছেন— সেই তছরুপের পরিমাণ প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। যে তালিকায় নীরব মোদি, বিজয় মালিয়া, মেহুল চোকসিরা আছেন। যাঁরা একটার পর একটা সংস্থাকে দেউলিয়া করেছেন, পথে বসিয়েছেন। ভারতের মানুষের ওপর অর্থনৈতিক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার সুদের হার কমিয়ে দিয়েছেন। ব্যাঙ্কে ফিনান্সিয়াল রিসোলিউশন অ্যান্ড ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স (FRDI) বিল আনতে চলেছেন। যার ফলে আপনার সারা জীবনের সঞ্চয়ও আর নিরাপদ, নিশ্চিত থাকবে না। গোদের উপর বিষফোড়া হিসেবে এলআইসির মতো লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ারমূল্য কম দেখিয়ে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার৷ কার্যত সরকারি মদতে একটি পরিকল্পিত লুঠের নীলনকশা বাস্তবায়িত হচ্ছে আজ গোটা দেশ জুড়ে।
এই সময় দাঁড়িয়ে আমরা যদি আরও লক্ষ্য করি, যেসব জিনিসকে মূল্যবৃদ্ধির (Inflation) সরাসরি নিয়ন্ত্রক হিসেবে চিহ্নিত করা হয় বলে আমরা জানি, যেমন রান্নার গ্যাস, পেট্রোল, ডিজেল ইত্যাদি সেগুলোর প্রত্যেকটির দাম আকাশছোঁয়া। আজ গৃহস্থের রান্নার গ্যাস ১০২৬ টাকা প্রতি-সিলিন্ডার, পেট্রোল ১১৫.১২ টাকা লিটার, ১ লিটার ডিজেল কিনতে হচ্ছে ৯৯.৮৩ টাকায়। এর থেকেও ভয়ঙ্কর সমস্যা হল গরিব মানুষদের, যাঁদের একটা সময় রান্নার জন্য উজ্জ্বলা গ্যাসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মোদি সরকার। প্রত্যেক মানুষ একটা করে সিলিন্ডার পেয়েছিলেন। যাঁরা সিলিন্ডার পেয়েছিলেন তাঁরা এখন সেটা আর রিফিল করাতে না পেরে ঘুঁটে বা কাঠ-কয়লায় ফিরে গেছেন। আবার অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল কেরোসিনের উপরে। সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে গরিবের জ্বালানি কেরোসিন তেলের। ১ লিটার কেরোসিন কিনতে হচ্ছে এখন ৮৩ টাকা লিটারপিছু। রান্নার গ্যাসের দাম (Inflation) বেড়েছে বলে কেউ যদি কেরোসিন কিনতে চায় তাহলে ১৪.২ কেজি রান্নার গ্যাসের জন্য আপনাকে গুনতে হবে ১০২৬ টাকা এবং একই পরিমাণ কেরোসিনের দাম পড়বে ১১৭৮ টাকা মানে ১২০০ টাকার কাছাকাছি! অর্থাৎ গরিব মানুষের দুবেলা-দুমুঠো অন্নের জন্য যেটুকু জ্বালানির দরকার হয় সেই পথটাও বন্ধ করে দিয়েছে এই সরকার।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলে পেট্রোপণ্যের দাম (Inflation) বাড়বে বলে একটা মহল থেকে আশঙ্কা করা হলেও দেখা গেল দাম বাড়া তো দূরঅস্ত্, উল্টে ভারত রাশিয়ার থেকে সস্তায় ক্রুডঅয়েল কিনবে বলে চুক্তি করল এই যুদ্ধের মধ্যেই। এখন যদি আমরা দেখি, ২০১৪ সালের মনমোহন সিং সরকারের সময় আজকে যাঁরা দেশের সরকারে আসীন তাঁরা স্লোগান দিয়েছিলেন— ‘‘পেট্রোল ডিজেলের দাম বাড়ছে কেন, মনমোহন সিং জবাব দাও।” কিন্তু সেইসময় পেট্রোলের লিটার হয়েছিল ৭১ টাকা। আর তখন আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুড অয়েলের দাম ছিল ১১৯ ডলার ব্যারেল-প্রতি। আর আজকের দিনে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুড অয়েলের দাম যেখানে ১০৩ ডলার প্রতি-ব্যারেল সেখানে পেট্রোল কিনতে হচ্ছে ১১৫ টাকারও বেশি দামে! সর্বত্র একটা কপটতা, মিথ্যাচার।
এই অর্থনৈতিক সংকটকালীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা কিন্তু আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। শ্রীলঙ্কাতেও আমরা সাম্প্রতিক অতীতে জাত-ধর্মের নামে আক্রমণ দেখেছি। উগ্র জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলে অন্যকে আক্রমণ করতে দেখেছি। একদলীয় শাসনের পক্ষে শ্রীলঙ্কা মত দিয়েছিল। ফলে প্রজাতন্ত্রের জায়গায় রাজতন্ত্র কায়েম হয়েছিল। আজ ভারতের ছবিটাও সেই একইরকম লাগছে। সুপ্রিম কোর্ট থেকে রাজ্যপাল— সর্বত্র নিজেদের লোক ঢুকিয়ে দেওয়ার রাজনীতি আজ সংবিধানের মূল ভিত্তিকেই আক্রান্ত করেছে। এমনকী ভারতের পূর্বতন নির্বাচন কমিশনার সুনীল অরোরাকেও বক্তৃতা করতে দেখা গেছে আরএসএসের শিক্ষক সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের মঞ্চে। এই সর্বগ্রাসী, মানুষের কণ্ঠরোধকারী রাজনীতি আমরা শ্রীলঙ্কার বুকেও দেখেছি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভয়ঙ্কর উগ্র সাম্প্রদায়িকতা। সেখানে যাঁরা এই রাজনীতির প্রবর্তক ছিলেন তাঁদের আজ দেশ থেকে পালাতে হচ্ছে। আমরা চাই ভারত বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রজাতন্ত্রী দেশ হিসেবে তার গণতান্ত্রিক পরিসরে স্বমহিমায় থাকুক। কিন্তু যেভাবে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে, গরিব মানুষের অন্নের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, মিড-ডে মিলের বরাদ্দ কমিয়ে দিচ্ছে সরকার, ৮০০টিরও বেশি জীবনদায়ী ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে তাতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে সমস্ত কিছুই। আজ আলু, পেঁয়াজ, তৈলবীজকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে সরিয়ে দিয়েছে কেন্দ্র। এগুলোর উপর মজুতের ঊর্ধ্বসীমা আইন উঠিয়ে দেওয়ায় মজুতদাররা যত খুশি মজুত করছেন। কালোবাজারিদের রমরমা আজ দেশ জুড়ে, ফলশ্রুতিতে এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি (Inflation)। সাধারণ মানুষকে সরকার খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এরপর যদি সাধারণ মানুষ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ভাষায় বলে ওঠেন, ‘‘রাজা তোর কাপড় কোথায়!” তখন আর একটা মাহেন্দ্রা রাজাপক্ষকে আমাদের দেখতে হবে না তো!
কেন্দ্রীয় সরকারের বোঝার সময় হয়েছে। তাঁদের উচিত পেট্রোল-ডিজেলের দামের ওপর থেকে অস্বাভাবিক হারে যে শুল্ক আদায় করছেন অবিলম্বে তা কমানো এবং রান্নার গ্যাসের দাম এখুনি অন্তত সিলিন্ডার-প্রতি ৪০০-৫০০ টাকা কমিয়ে এনে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া। নইলে কিন্তু আবারও ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পুনরাবৃত্তি দেখতে চলেছে দেশ অন্নের জন্য গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী।
‘‘কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে, বড্ড বেশী মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে।”