পড়ার গল্প, শোনার গল্প

Must read

গল্প পড়তে ভালোবাসেন বাচিকশিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। অডিও-বুক বা বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে ভালোবাসেন শোনাতেও। রহস্য-রোমাঞ্চ, অলৌকিক, রোমান্টিক, কিশোর-পাঠ্য, ঐতিহাসিক পটভূমিতে লেখা বিভিন্ন স্বাদের গল্প। কলেজস্ট্রিট, বইমেলায় ঘুরে ঘুরে বই কেনেন। প্রতিষ্ঠিতদের পাশাপাশি নতুন লেখকদের বই। পছন্দের গল্প পেলেই শোনান শ্রোতাদের। তখন একাই হয়ে ওঠেন বিভিন্ন চরিত্র। তাঁর সঙ্গে কথা বললেন অংশুমান চক্রবর্তী

####

প্রশ্ন : আপনি বাংলা সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক। শ্রোতাদের গল্প শোনানোর ইচ্ছা কীভাবে মনের মধ্যে জন্ম নিল?

উত্তর : ছোটবেলা থেকেই আমি গল্প পড়তে ভালোবাসি। অন্যদের শোনানোর কথা তখন মনে হয়নি। একটা সময় যখন কিছু মানুষ আমার কণ্ঠস্বরের, কথা বলার প্রশংসা করলেন, তখন ভাবলাম কিছু শুনিয়েও তো মানুষকে আনন্দ দেওয়া যায়। এটা বিনোদনের একটা পরিপূর্ণ উপকরণ। মনে হল, যে-গল্পটা পড়ে আমার ভালো লাগলো, সেই গল্পটা তো অন্যদেরও শোনানো যায়। এর ফলে আরও কিছু মানুষ বাংলা সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হবেন। গল্প পড়ার প্রতি তাঁদের আগ্রহ জন্মাবে। সেই ভাবনা থেকেই গল্প পাঠ করে শোনানো শুরু। প্রথমে ঘরোয়া পরিবেশে। পরে বাইরে। একটা জিনিস লক্ষ্য করতাম, যখন পড়ছি তখন মানুষ আগ্রহ নিয়ে শুনছেন। তারপর গল্প পড়ে শোনানোর সুযোগ এলো একটি এফ এম চ্যানেলে। প্রতি শুক্রবার দুপুরে একটি করে গল্প পড়তাম। পরে অনুষ্ঠানটি স্থানান্তরিত হল রেডিও অন টিভিতে। তখন বাংলা সিনেমার গল্পগুলো শোনাতাম। সঙ্গে থাকতো সেই সিনেমার গান। অনুষ্ঠানের নাম ‘ছায়াছবির গান গপ্পো’। মূলত উত্তমকুমারের সিনেমার গল্পগুলোই শোনাতাম। এরজন্য আমাকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হতো। সিনেমাগুলো দেখতে দেখতে সংলাপগুলো লিখে নিতাম। তারপর সামান্য সম্পাদনা করে শ্রোতাদের উপহার দিতাম। এই অনুষ্ঠানটি দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। অনেকেই বলতেন, সিনেমাটাই যেন নতুন করে দেখছি। যেটা আমার কাছে চ্যালেঞ্জিং ছিল সেটা হল আমি একাই বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করতাম। নিজের কণ্ঠস্বর দিয়ে প্রতিটি চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতাম। প্রায় ৪২-৪৩টা বাংলা ছবির গল্প আমি শ্রোতাদের শুনিয়েছি।

প্রশ্ন : সিনেমার গল্প থেকে বেরিয়ে অন্য গল্প শোনানো শুরু করলেন কখন?

উত্তর : একবার আমি একটা শুটিংয়ের কাজে মুম্বই গিয়েছিলাম। ফেরার পথে ট্রেনে পড়তে শুরু করলাম একটি বিখ্যাত পত্রিকার রহস্য-রোমাঞ্চ বিশেষ গল্প সংখ্যা। সেখানে ছিল জয় গোস্বামী, অনিরুদ্ধ ধর প্রমুখের গল্প। পড়তে পড়তে চমকে উঠলাম। মনে হল, প্রতিটি গল্প নিয়েই দুর্দান্ত সিনেমা হতে পারে। তখন ভাবলাম, শুক্রবারের অনুষ্ঠানে এই সংখ্যা থেকেই গল্প পড়বো। চ্যানেল কর্তৃপক্ষকে বিষয়টা জানালাম। তাঁরা রাজি হলেন। অনুষ্ঠানে আমি বললাম, এই গল্পগুলো নিয়ে কোনো ছায়াছবি হয়নি। তবে আগামীদিন কোনো পরিচালক আগ্রহী হতেই পারেন। এইভাবে পাশাপাশি শুরু হল সিনেমার বাইরের গল্প পড়া। এতে কিছুটা হলেও আমার চাপ কমলো। অনুষ্ঠানের নামকরণ করা হল ‘গান গপ্পো’। তখন দেখতাম, লোকে বাংলা সিরিয়াল ছেড়ে এই গল্পগুলো শুনছেন। অনুষ্ঠানের শেষে আমরা শ্রোতাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলতাম। অসংখ্য শ্রোতা জানাতেন তাঁদের ভালোলাগার কথা। শ্রোতাদের মধ্যে কিছু বিখ্যাত মানুষও থাকতেন। অনেকে জানাতেন, এই গল্পটা আমার পড়া। আজ শুনলাম। অনেকে আবার গল্প পাঠ শুনে লেখকের অন্য গল্প পড়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। আসলে আমি গল্প পড়তে খুব ভালোবাসি। নানা স্বাদের গল্প। হাতের কাছে যা পাই, তা-ই পড়ি। রহস্য-রোমাঞ্চ, অলৌকিক, রোমান্টিক, কিশোর-পাঠ্য, ঐতিহাসিক পটভূমিতে লেখা গল্প। পছন্দ হলেই শ্রোতাদের শোনাই। সে নতুনই হোক বা পুরোনো। সারা বছর ধরেই চলে আমার গল্প পড়া। ভালো গল্পের অন্বেষণ।

প্রশ্ন : কলেজস্ট্রিট বইপাড়ায় এবং বইমেলায় দেখেছি, আপনি ঘুরে ঘুরে বই কিনছেন। তাই তো?

উত্তর : একদম তাই। আমি দীর্ঘদিন ধরেই কলেজস্ট্রিট বইপাড়ায় এবং বইমেলায় ঘুরে ঘুরে বই কিনি। নতুন বইয়ের পাশাপাশি পুরোনো বই। পড়ি বিভিন্ন পত্রপত্রিকা। এই মুহূর্তে পড়ছি এবারের শারদ-সংখ্যাগুলো। একটি ঘটনার কথা বলি। একদিন কলেজস্ট্রিটে একজন পরিচিত ভদ্রলোকের বাড়িতে গেছি। গিয়ে শুনলাম তিনি বেরিয়েছেন। আধঘন্টা পর ফিরবেন। তখন আমি সেখানে না বসে চলে গেলাম পুরোনো বইয়ের দোকানে। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ আমার চোখে পড়ল মন্মথ রায়ের একাঙ্ক নাটকের সমগ্র। শতাধিক নাটক আছে। কিছু নাটক দুই-তিন পাতার। পড়লে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়ার পর মনে হলো বইটা সংগ্রহে রাখতেই হবে। দাম জানতে চাইলাম। দোকানদার বললেন, একশো টাকা। শুনে আমি মনে মনে দমে গেলাম। কারণ সেই মুহূর্তে আমার কাছে একশো টাকা নেই। বাস ভাড়া বাদ দিয়ে পকেটে থাকবে চল্লিশ টাকা। বললাম, চল্লিশ টাকায় দেবেন? দোকানদার বললেন, এই বই চল্লিশ টাকায়? বলছেন কী? আমি বললাম, জানি, কম বলছি। কিন্তু আমার কোনো উপায় নেই। আপাতত এর বেশি দিতে পারবো না। আমার কথা শুনে দোকানদার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ঠিক আছে, নিয়ে যান। একজন ভালো মানুষের কাছে বইটা যাক। যিনি বইটার কদর করবেন। মনে হল, দোকানদার আমাকে চিনে ফেলেছেন। তখন আমি টিভিতে খবর পড়ি। যাইহোক, এইভাবে আমি কলেজস্ট্রিটের পুরোনো বইয়ের দোকান ঘুরে অনেক ভালো ভালো বই কিনেছি। পাশাপাশি কিনেছি নতুন বইও। আর একবার খুব কম দামে কিনেছিলাম ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত কুমারেশ ঘোষ সম্পাদিত ‘যষ্ঠীমধু’ পত্রিকা। ছিল এক বছরের পুরো সংকলন। বইটায় যা মেটিরিয়াল ছিল তাতে এক হাজার টাকা দাম হতে পারতো। আমি পেয়েছিলাম একশো টাকায়। হাসির গল্প, প্রবন্ধ, ছড়া, চুটকি ঠাসা। তখন আমি একটি রেডিও চ্যানেলে শনিবার সকালে ‘হাসি রাশি রাশি’ নামে একটা অনুষ্ঠান করতাম। তার জন্য প্রচুর হাসির গল্প, চুটকির দরকার পড়তো। বইটা দারুণ কাজে লেগেছিল।

প্রশ্ন : কখনো কোনো সাহিত্যিক আপনার গল্প-পাঠ শুনে প্রশংসা করেছেন?

উত্তর : বহুবার ঘটেছে এইরকম ঘটনা। সমরেশ মজুমদারের একটা বই ছিল ‘কইতে কথা বাধে’। সেটা ঠিক গল্পের নয়, বিভিন্ন সাহিত্যিককে খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা। ধরা পড়েছে ভালো-মন্দ বিভিন্ন ঘটনা। সেই বই থেকে আমি একদিন পাঠ করেছিলাম সন্তোষকুমার ঘোষের একটি অংশ। সেই অংশে আছে ক্যানসারে আক্রান্ত সন্তোষকুমারকে সমরেশদা হাসপাতালে দেখতে গেছেন। কেবিনের মধ্যে দুজনের কথোপকথন। পাঠের দিন সমরেশদা স্টুডিওয় এসেছিলেন। হঠাৎ দেখি, উনি চোখ মুছছেন। অনুষ্ঠান শেষে আমার হাতদুটো ধরে বললেন, এটা তুমি কী করলে? স্টুডিওর মধ্যে হাসপাতালের কেবিনকে এনে বসিয়ে দিলে? তাছাড়া সেইদিন হাসপাতালে তুমি তো উপস্থিত ছিলে না। তাহলে কীকরে বুঝতে পারলে মুহূর্তটা কীরকম ছিল? শারীরিক কষ্ট নিয়ে সন্তোষদা কীভাবে কথা বলেছিলেন, তুমি কীকরে জানলে? আমি তো চোখের জল ধরে রাখতে পারছি না। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

প্রশ্ন : মতি নন্দীও একবার আপনার পাঠের প্রশংসা করেছেন। তাই না?

উত্তর : হ্যাঁ। মতি নন্দীর একটি গল্প পড়ে আমি রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। নাম ‘গলিত সুখ’। তবে গল্পটা ছিল বেশ বড়ো। কিন্তু ঠিক করেছিলাম, যে-ভাবেই হোক, শ্রোতাদের শোনাতেই হবে। সাদামাটা একটা গানের মাস্টারের গল্প। সেটাই রহস্যে বাঁক নিল। পড়ে মনে হয়েছিল, ঠাণ্ডা মাথায় একটা ভয়ঙ্কর জায়গায় পৌঁছে যেতে বোধহয় মতি নন্দীই পারেন। অনুষ্ঠানের আগে আমি মতি নন্দীকে জানিয়েছিলাম গল্পটা পড়বো। যদি শোনেন। আনন্দের কথা, উনি শুনেছিলেন অনুষ্ঠানটি। ভরিয়ে দিয়েছিলেন প্রশংসায়। এইভাবে আমি রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের গল্প যেমন পড়েছি, তেমন সমসাময়িক বহু লেখকের গল্প পাঠ করেছি। অদ্রীশ বর্ধন, অনীশ দেব, স্বপ্নময় চক্রবর্তী থেকে শুরু করে সৈকত মুখোপাধ্যায়, অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী, হিমাদ্রীকিশোর দাশগুপ্ত, সায়ন্তনী পুততুণ্ড, অনন্যা দাশ প্রমুখ। মনে পড়ছে, সৈকত মুখোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে একবার বাংলা আকাদেমি সভাঘরে তাঁর একটি গল্প আমি পাঠ করেছিলাম। সৈকত শুনে প্রশংসা করেছিলেন।বাংলার পাশাপাশি বিদেশি লেখকদের গল্পও আমি পাঠ করেছি। পড়েছি প্রায় হারিয়ে যাওয়া লেখকের গল্প। যেমন পাঁচকড়ি দে। তিনিই বাংলা সাহিত্যে প্রথম গোয়েন্দা চরিত্র এনেছিলেন।

প্রশ্ন : এখন তো প্রচুর অডিও-বুক প্রকাশিত হচ্ছে। অনেকেই গল্প পাঠ করছেন। কোন ধরনের গল্প শ্রোতারা বেশি শুনছেন?

উত্তর : রহস্য-রোমাঞ্চ, অলৌকিক গল্পের চাহিদাই এই মুহূর্তে বেশি। এখন আমি একটি এফএম চ্যানেলে গল্প পাঠ করছি। পাশাপাশি গল্প পড়ছি বিভিন্ন অডিও-বুক-এ। বহু বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করছে অডিও-বুক। যেগুলো জনপ্রিয় হচ্ছে। বয়স্ক মানুষ, যাঁরা দৃষ্টি শক্তি কমে যাওয়ার কারণে বই পড়তে পারেন না, তাঁরা অডিও-বুক শুনছেন। অডিও-বুক এবং চ্যানেলের অনুষ্ঠানগুলো শুনে বহু মানুষ বিভিন্ন লেখকের বই কিনছেন। পড়ছেন। এরফলে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে বাংলা বই। এটা আনন্দের।

Latest article