সাম্প্রদায়িক টিপু সুলতানকে নাকি সেক্যুলার হিরো বানানো হচ্ছে?

১৭৫০ সালের আজকের দিনে নাকি টিপু সুলতান জন্ম নেন। আর তাঁর সম্পর্কে শিরোনামের কথাগুলো শোনা গিয়েছিল এই ২০১০-এও। মাঘ কৃষ্ণ চতুর্থী, কলিযুগ বর্ষ ৫১১১১-এ। চমকে ওঠার কিছু নেই। এভাবেই সাল গণনা করেন যাঁরা তাঁরাই বলেছিলেন এবং বলে চলেন এমন কথা। সেবার বলেছিলেন টিপু সুলতানের জীবন ও অর্জনের উপর তিন দিনের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে, মহীশূরে । সেই বক্তব্যের সত্যাসত্য বিচার করছেন আকসা আসিফ

Must read

প্রথমেই পরিষ্কার করে জানিয়ে রাখি, শিরোনামে প্রতিফলিত মূল্যায়নের সঙ্গে ইতিহাসের ছাত্রী হিসেবে আমি সহমত নই। ইতিহাসবিদ কেট ব্রিটলব্যাঙ্ক-এর মতো আমি এবং আমার মতো লক্ষ লক্ষ ভারতবাসী জানেন ও মানেন, টিপু সুলতান কোনও দানব ছিলেন না, জাতীয়তাবাদী বা স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন না… তিনি ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ রাজা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অস্ট্রেলিয়ান ইতিহাসবিদ কেট ব্রিটলব্যাঙ্ক ‘টাইগার : দ্য লাইফ অফ টিপু সুলতান’ (Tipu Sultan) বইয়ের লেখক এবং টিপুর শাসনকে ঘিরে বর্তমান রাজনীতিতে যে মিথ এবং বাস্তবতা রয়েছে সে-সম্পর্কে খোলাখুলি আলোচনা করতে পছন্দ করেন।
মনে রাখতে হবে, টিপু সুলতান প্রযুক্তি ও শিল্পে ইউরোপীয়দের সাথে তাল মেলানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। তিনি আসলে মোদি সরকারের মেক ইন ইন্ডিয়া কর্মসূচির জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারতেন। কিন্তু হননি। কারণ, মোদি-শাহ সেটা চাননি।

নিঃসন্দেহে, টিপুর (Tipu Sultan) পৃথিবী এবং আজকের পৃথিবী অনেক আলাদা। তাও তিনি মহীশূরের বাণিজ্য ও শিল্পের বিকাশে দুর্দান্ত শক্তি এবং দূরদর্শিতা প্রদর্শন করেছিলেন, নিঃসন্দেহে আজকের রাজনীতিবিদ এবং সরকারের মধ্যেও সচরাচর এমন গুণাবলি দেখা যায় না। অথচ গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী বিজেপির মতো তাঁর সমালোচকরা সর্বদা তাঁর বিরোধিতাকারীদের উপর তাঁর নির্যাতনকে আরও বাড়িয়ে দেখান এবং তাঁকে মূলত একটি হিন্দু রাজ্যের একজন মুসলিম শাসক হিসেবে দেখেন। আজকের ভারতের পরিস্থিতি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত এবং ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে উৎপন্ন মনোভাব দ্বারা প্রভাবিত, যার মূলে রয়েছে এমন ভাবনার অবস্থান যেটার সঙ্গে ঐতিহাসিক টিপুর কোনও সম্পর্ক নেই। ব্রিটিশ রাজত্বকালে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান, এবং টিপুকে হত্যার ন্যায্যতা প্রমাণ করার জন্য ব্রিটিশরা তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে শয়তান হিসেবে আখ্যায়িত করার ফলে এই ধারণা তৈরি হয়েছে যে টিপু ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে নির্যাতন করতেন। আসলে এটি কখনও ঘটেনি, যদিও আমি জানি যে যারা এই বিশ্বাসে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন তারা এটা শুনে খুশি হবেন না। টিপু তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য এবং মহীশূরের শত্রুদের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করার জন্য মানুষকে শাস্তি দিয়েছিলেন— এটি ধর্মীয় নির্যাতন নয় এবং এটিকে এভাবে বর্ণনা করা ভুল। না, একথা আমি বলছি না, বলছেন অস্ট্রেলিয়ান ইতিহাসবিদ কেট ব্রিটলব্যাঙ্ক ‘টাইগার : দ্য লাইফ অফ টিপু সুলতান’ বইয়ে। কিছু ঐতিহাসিক যুক্তি দেন যে টিপু একজন ধর্মনিরপেক্ষ শাসক ছিলেন। আসল কথাটা অন্য। তাঁর উপাসনালয় ধ্বংস ধর্মীয় প্রকৃতির চেয়ে রাজনৈতিক ছিল বেশি।

আরও পড়ুন-নীতীশের শপথের আগেই তুমুল খেয়োখেয়ি চলছে গেরুয়া শিবিরে

বুঝতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষতার আধুনিক ধারণা আঠারো শতকের ভারতে প্রযোজ্য নয়। টিপু যে পৃথিবীতে বাস করতেন তা ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিপূর্ণ ছিল। দক্ষিণ ভারতে সেই সময়ে জীবিত যে কেউ এমন একটি পৃথিবীর কল্পনাও করতে পারতেন না যেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস কোনও ভূমিকা পালন করত না। তবে এর অর্থ এই নয় যে টিপুর মতো একজন শাসক কেবল ধর্মীয় ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতেন। তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাস্তববাদী বা রাজনৈতিক উদ্বেগ দ্বারা পরিচালিত হত, যে কারণে এটি আধুনিক মনের কাছে ধর্মনিরপেক্ষ বলে মনে হতে পারে। প্রাক-আধুনিক ভারতের সমস্ত শাসকের মতো, তিনি কেবল নিজের ধর্ম নয়, সকল ধর্মের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে উপহার এবং জমি দান করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর অনেক প্রজা তাঁর জন্য শোক প্রকাশ করেছিলেন, যাঁরা ব্রিটিশদের শাসনের চেয়ে তাঁর শাসনকে বেশি পছন্দ করেছিলেন।

যারা টিপুকে ঘৃণা করে, যারা তাঁকে একজন দানব বলে যে বক্তব্যটি সমালোচনার বাইরে মেনে নিয়েছে, তাদের অন্যভাবে বিশ্বাস করানোর সম্ভাবনা কম, এমনকী যদি অকাট্য প্রমাণও উপস্থাপন করা হয়, তাহলেও। আমরা কি বলব যে টিপুর রাজত্বকালে শৃঙ্গেরিতে মঠ আক্রমণকারী মারাঠারা কি এই কাজের জন্য দানব ছিল? অবশ্যই না। এটি একটি রাজনৈতিক কাজ ছিল, ঠিক যেমন টিপুর নায়ার এবং কানাড়া খ্রিস্টানদের শাস্তি দেওয়া রাজনৈতিক ছিল।

১৭৯২ সালের পর টিপু আরও স্পষ্টভাবে ধার্মিক হয়ে ওঠেন, কিন্তু এর কারণ ছিল তিনি ভয় পেতেন যে তিনি ঈশ্বরকে অসন্তুষ্ট করেছেন এবং তাঁকে সন্তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন। এর সাথে তাঁর অমুসলিম প্রজাদের প্রতি মনোভাবের পরিবর্তনের কোনও সম্পর্ক ছিল না, যাঁদের সাথে তিনি সর্বদা ন্যায্য আচরণ করতেন। ১৭৯২ সালে তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের শেষে, তাঁকে একটি অপমানজনক চুক্তি স্বাক্ষর করতে হয়েছিল যার ফলে তাঁকে বিশাল অঞ্চল ছেড়ে দিতে হয়েছিল এবং তার দুই ছেলেকে মাদ্রাজে জিম্মি করে পাঠাতে হয়েছিল, যাতে বিশাল ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা যায়— যে কারও ভাষায় এটি একটি বিপর্যয়। তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে টিপু হয়তো ভেবেছিলেন যে তিনি কোনওভাবে ঈশ্বরকে অসন্তুষ্ট করেছেন। টিপু যে হুমকির মুখোমুখি হয়েছিলেন তা বাহ্যিক ছিল, অভ্যন্তরীণ নয়, এবং তাঁর প্রজাদের সাথে আচরণ পরিবর্তন করার কোনও কারণ ছিল না, তাদের বিশ্বাস যাই হোক না কেন।

Latest article