থরের সবুজায়ন কি সত্যিই চিন্তার

ধু-ধু বালুরাশিতে এক টুকরো সবুজের ছোঁয়া। আমাদের অতি-পরিচিত থর মরুভূমির সবুজায়ন। আপাতদৃষ্টিতে এটি সুখকর খবর হলেও ভু-বিজ্ঞানীদের কপালে দেখা যাচ্ছে চিন্তার ভাঁজ। কিন্তু কেন? এরই উত্তর খুঁজলেন প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

Must read

আমাদের ভারতের রাজস্থান ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধ প্রদেশ জুড়ে রয়েছে থর মরুভূমি। এই তিন জায়গায় মোট ২ লাখ বর্গকিমি অঞ্চল জুড়ে রয়েছে এই মরুভূমি। বৃহত্তম মরুভূমির তালিকায় থর রয়েছে ২০ নম্বর স্থানে। উষ্ণ ক্রান্তীয় মরুভূমি হিসেবে থরের স্থান নবমে। এরকম এক উষ্ণ, শুষ্ক মরুভূমির সবুজায়ন তাও কি সম্ভব, আর যদি সম্ভব হয়েও থাকে তা কি আমাদের জন্য খুব একটা লাভদায়ক ফল হবে? নাকি এই সবুজায়ন গোটা ভারতের আবহাওয়া বদলের এক অশনি সঙ্কেত? এইসব প্রশ্ন আবহাওয়াবিদ তথা বিজ্ঞানীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।

আরও পড়ুন-চোরের বদলে বিচারকের বাড়িতেই হানা পুলিশের! যোগী প্রশাসনের কীর্তিতে হতবাক আদালত

থরের সবুজায়নের চেষ্টার ইতিহাস
উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিশাল এলাকা জুড়ে থাকা থরের গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা হয় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা মানুষকে অতিষ্ঠ করে তোলে। আর সারা বছর ধরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ থাকে মাত্র ১৫০ মিলিমিটার যা মুম্বই বা কলকাতায় কয়েক ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণের সমান। থরের জলবায়ুর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে ১৭০০ সাল থেকে ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত অন্তত ১৫ বার অনাবৃষ্টির ফলে খরার কবলে পড়ে থর। ফলে এই মরুভূমির শুষ্কতা এবং রুক্ষতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। স্বাধীনতার পর অবশ্য সেই অবস্থা খানিকটা বদলাতে শুরু করে। প্রথমে ঠিক করা হয় পাঞ্জাবের নদীগুলি থেকে কোনও খাল কেটে যদি থরের দিকে আনা যায়, কিন্তু সেখানে মূল সমস্যা ছিল পাকিস্তান, কারণ পাঞ্জাবের নদীর জল থর মরুভূমিতে আনতে গেলে তা পাকিস্তানের কিছু অংশের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং এই খালের দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ৬৫০ কিমি। তবে আমাদের ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহওরলাল নেহরুর উদ্যোগে ও হাইড্রোলিক ইঞ্জিনিয়ার কানওয়ার সাইনের পরিকল্পনায় পাঞ্জাবের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত নদীর জল থরে টেনে আনার জন্য প্রস্তাব করা হয় একটি সেচ খালের মাধ্যমে। সাইন অনুমান করেছিলেন যে, বিকানের ও জয়সলমেরের উত্তর-পশ্চিম কোণে মরুভূমির ২০ লক্ষ হেক্টর জমিতে পাঞ্জাবের নদীগুলির জল এনে সেচ করা যেতে পারে। এই মর্মে ১৯৫৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু জলচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যেখানে বলা হয় শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী এবং তাদের শাখানদীগুলির উপর পূর্ণ অধিকার থাকবে ভারতের। আর এর পরই ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘ সেচখাল ‘ইন্দিরা ক্যানাল’ তৈরির পরিকল্পনা করা হয়, যা রাজস্থানের অন্তর্গত থরের এলাকায় চাষবাষের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে থর-কে সবুজায়ন করার চেষ্টার ফলে ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০২ সালের মধ্যে থরে সবুজের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ শতাংশ। আগে যেখানে প্রায় ১২.৭ শতাংশ স্থানে চাষ হত এখন সেটি বেড়ে ২৪ শতাংশ জায়গায় হতে শুরু করে। শুধু তাই নয় থরকে সবুজ করার লক্ষ্যে তারা প্রোসুপিস জুলিফ্লোরা (বিদেশি বাবুল) নামক এক দক্ষিণ-আমেরিকার উদ্ভিদকে এখানে রোপণ করে। যা ধীরে ধীরে গোটা মরুভূমিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

আরও পড়ুন-প্যান্ট্রিকার নেই কেন সব দূরপাল্লার ট্রেনে? কেন্দ্রকে তোপ পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির

চিন্তার কারণ
এতক্ষণের করা এই আলোচনা পর্যালোচনা থেকে কোথাও কোনও চিন্তার কারণ আছে বলে মনে হল না। কিন্তু যদি বলি যে কারণে আমাদের স্বাভাবিক অঞ্চলের সবুজায়ন নষ্ট হচ্ছে বাতাসে দূষণ ছড়াচ্ছে, আন্টার্কটিকার বরফ গলছে সেই বিশ্ব উষ্ণায়নই দায়ী মরুভূমির সবুজায়নের জন্য তাহলে হয়ত কপালটা আমরা একটু হলেও কুঁচকাব— তাই না? ব্যাপারটা একবার গোড়া থেকে বোঝা যাক। আসলে থর অতি-উষ্ণ আবহাওয়াযুক্ত স্থান হওয়ায় এটি উষ্ণ বাতাস সৃষ্টির জন্য একটা কম-বায়ুচাপযুক্ত অঞ্চল তৈরি করে আর এই কম-বায়ুচাপযুক্ত অঞ্চলের দিকে ভারত মহাসাগর থেকে আসা ঠান্ডা বাতাস ধেয়ে আসে আর এর ফলেই ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে বৃষ্টি হয় তবে থরে এই বাতাস প্রবেশ করতে পারে না কারণ আরাবল্লি পর্বতমালা। কিন্তু সম্প্রতি গুয়াহাটির কটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক ভূপেন্দ্রনাথ গোস্বামী জানাচ্ছেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বঙ্গোপসাগরে এমন কিছু উচ্চচাপযুক্ত অঞ্চলের সৃষ্টি হচ্ছে যার ফলে যে-বায়ু উত্তর ভারতের দিকে যাওয়ার কথা ছিল তা থরের দিকে গিয়ে সেখানে বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছে। এরকমভাবে চলতে থাকলে থর সবুজ হলেও ভারতের বেশিরভাগ অংশে বৃষ্টির আকাল পড়বে। আসলে পৃথিবী যত বেশি উষ্ণ হচ্ছে ততই সরে যাচ্ছে ‘ইন্টারট্রপিক্যাল কনভারজেন্স জ়োন বা আন্তঃক্রান্তীয় অভিসারী অঞ্চলের সীমানা। আবহাওয়া দফতরের গত ৫০ বছরের তথ্য বলছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নিরক্ষীয় ভারত মহাসাগরে উষ্ণ জলের সম্প্রসারণের ফলে গ্রীষ্মকালে পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাত হচ্ছে এবং তা ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতে এর পরিমাণ কমেছে ১০ শতাংশ। ভারতের এরকম চলতে থাকলে তথ্য বলছে ২০৫০ সাল নাগাদ ভারতের ৩০টি শহর খরার প্রকোপে পড়বে।

আরও পড়ুন-ওয়াকফ বিক্ষোভে নিজেদের রাজ্যেই বেসামাল বিজেপি, এবার কি ত্রিপুরায় আফস্পা দাবি করবেন বাংলার বিজেপির নেতারা?

পঙ্গপালের আক্রমণ
পঙ্গপাল আসলে মরু অঞ্চলের শুকনো আবহাওয়া বিশেষ পছন্দ করে। কিন্তু ডিম পাড়ে ভিজে বাতাসযুক্ত আবহাওয়ায়। পূর্ণবয়স্ক হওয়ামাত্র বংশবৃদ্ধি করে। তার জন্য মরু অঞ্চলের ভিজে আবহাওয়া জরুরি। অসময়ের বৃষ্টি বা অতিবৃষ্টিও আচমকা বাড়িয়ে দেয় পঙ্গপালের বংশবৃদ্ধি। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ২০২০ সালে ভারতে একবার পঙ্গপালের দল হানা দিয়েছিল, সেটি এসেছিল পূর্ব আফ্রিকার সোমালিয়া, ইথিয়োপিয়ার মতো দেশ থেকে। লোহিত সাগর পেরিয়ে ইরানের মরুভূমি থেকে আফগানিস্তান-পাকিস্তান হয়ে তারা পৌঁছেছিল রাজস্থানের থর মরুভূমিতে এবং সেই সময়কার তথ্য অনুসারে এরা আফ্রিকাতে নিজেদের বংশবিস্তার করেছিল এবং খাবারের খোঁজে হানা দিয়েছিল আফগানিস্তান-পাকিস্তান ও ভারতে কারণ এদের খাবার হল দানাশস্য আর তাই এরা এক বছরে প্রায় ভারতের ১ লক্ষ ৭০ হাজার হেক্টর ফসল নষ্ট করে দিয়েছিল। এবার ভেবে দেখা দরকার যে যদি আফ্রিকা থেকে এসে এরা ভারতের ফসল নষ্ট করতে পারে তবে ভারতের মধ্যে থর মরুভূমিতেই যদি প্রচুর পরিমাণে এরা বংশবৃদ্ধি করতে থাকে তবে থরের লাগোয়া অঞ্চলগুলি যেখানে প্রচুর পরিমাণে শস্যের ফলন হয় সেখানে এরা কীভাবে তাণ্ডবলীলা চালাবে তা বোঝাই যাচ্ছে। তাই থরের এই সবুজায়ন আপাতদৃষ্টিতে ভাল হলেও অদূর ভবিষ্যতে তা যে একটি টাইম বোমা ছাড়া আর কিছুই নয় তা আশা করি আমরা সকলেই অনুধাবন করতে পারছি।

Latest article