ত্রিপুরায় কি নয়া ভোর আসন্ন?

সিপিএমের সন্ত্রাস দেখেছে উত্তর-পূর্বের এই ছোট্ট রাজ্যটি। দেখেছে অন্তর্দ্বন্দ্বে দীর্ণ কংগ্রেসের ব্যর্থতাও। সেদিনের সেই হার্মাদরাই এখন জার্সি বদলে গেরুয়া শিবিরে।

Must read

সিপিএমের সন্ত্রাস দেখেছে উত্তর-পূর্বের এই ছোট্ট রাজ্যটি। দেখেছে অন্তর্দ্বন্দ্বে দীর্ণ কংগ্রেসের ব্যর্থতাও। সেদিনের সেই হার্মাদরাই এখন জার্সি বদলে গেরুয়া শিবিরে। তারাই রুখতে চাইছে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে নতুন সূর্যোদয়। ত্রিপুরার রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণে
জয়ন্ত ঘোষাল

ত্রিপুরার আজকের এই ভয়াবহ সন্ত্রাস দেখে আমার কয়েক দশক আগের একটা ঘটনা মনে পড়ছে। ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তী। ভোটের ঠিক একদিন আগে ভয়াবহ সন্ত্রাস শুরু হল রাজ্যজুড়ে। সিপিএমের এক বিশাল ক্যাডার বাহিনী বোমাবাজি মারামারি এমনকী খুনোখুনিতেও মেতে উঠল। এর মধ্যে জঙ্গি সংগঠন টিএনভি তাদের বাঙালি নিধন অব্যাহত রাখল।

আরও পড়ুন-ভোট শুরুর আগেই উত্তপ্ত আগরতলা

সিপিএম অভিযোগ করছে এই সমস্ত কিছুই করাচ্ছেন বাইরে থেকে এসে কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা সন্তোষমোহন দেব। তিনি তখন রাজীব গান্ধীর ক্যাবিনেটের অন্যতম মন্ত্রী। আর কংগ্রেস অভিযোগ করছে, সিপিএমের ক্যাডার বাহিনীই টিএনভি কর্মী হয়েছে। শাসক দলের অধীনে যে জঙ্গি সংগঠন তৈরি হয়েছে সেটাও সিপিএমেরই উপজাতি সংগঠন থেকে আসা লোকজনদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল। ছোট রাজ্যটা সেদিন কিন্তু রক্তাক্ত হয়ে গেছিল। একটা হিংসার আবহাওয়া দেখেছিলাম।

আরও পড়ুন-গোয়ায় প্রতিবাদ, অনশন

আজ এত বছর পর বিজেপি যখন শাসক দল, তখন সেই সীমান্তবর্তী ছোট রাজ্যটিতে আবার ভয়াবহ সন্ত্রাস শুরু হয়েছে। শাসক দলের ছাতার তলায় যে বিজেপি কর্মীরা রয়েছে তারাই উত্তর ত্রিপুরার ধর্মনগর কৈলাসহর থেকে দক্ষিণ ত্রিপুরার প্রত্যন্ত বিলোনিয়া গ্রাম পর্যন্ত একটা সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করতে চাইছে। আটকাতে চাইছে তৃণমূল কংগ্রেসকে। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের ভোটের সময় দিল্লি থেকে নেতাদের নিয়ে গিয়ে প্রচারে লিপ্ত ছিল এবং তৃণমূল তখন তাদের বহিরাগত বলেছিল। এ কথা বলা হয়েছিল এ জন্য নয় যে যারা তখন বাংলায় এসেছিলেন তাঁরা অবাঙালি, তাঁদের বহিরাগত বলা হয়েছিল কেননা তাঁরা বঙ্গসংস্কৃতি জানেন না বা বঙ্গ সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছেন, সেজন্য।

আরও পড়ুন-দাবি, প্রতিবাদ, আমন্ত্রণে আদর্শ প্রশাসক জননেত্রী

সুতরাং বাঙালির পরিচয় যে সত্তার জন্য, সেই সত্তার ওপরের আঘাতের কারণেই এই অভিযোগ তৃণমূল কংগ্রেসের তরফ থেকে তোলা হয়েছিল তখন। আজ ত্রিপুরায় যখন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যাচ্ছেন, সেখানে কাজ করছেন, সুস্মিতা দেব, কুণাল ঘোষ, ব্রাত্য বসু প্রমুখ নেতারা যখন সেখানে সক্রিয়, সেই সময় বিজেপি অভিযোগ করছে যে বাইরে থেকে এসে ত্রিপুরাকে লন্ডভন্ড করা হয়েছে।

নৃপেন চক্রবর্তী যখন ত্রিপুরা গিয়েছিলেন তখন তিনিও কলকাতা থেকে গিয়েছিলেন। তখন দশরথ দেবের গণমুক্তি পরিষদ বলেছিল যে, বাঙালি নেতাকে কলকাতা থেকে পাঠানো হচ্ছে, উপজাতিরা তা মেনে নেবে না। এসবই এখন ইতিহাস। আজ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু বাঙালি এবং উপজাতি সমাজের যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করে উন্নয়নের পথে ত্রিপুরাকে নিয়ে যেতে নতুন বার্তা নিয়ে যাচ্ছেন।

আরও পড়ুন-পূজারাদের নেটে বোলার দ্রাবিড়

মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব যদি সত্যিই উন্নয়নমুখী হতেন তাহলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়িতে বিজেপি কর্মীরা পাথর ছুড়ে তাঁর যাত্রাপথ ভন্ডুল করার চেষ্টা করলে তিনি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতেন। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যখনই ত্রিপুরায় প্রচারে যাচ্ছেন তখনই তাঁকে বাধা দেওয়া হচ্ছে। পুলিশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। চপারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। পদে পদে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
কেন?
তার মানে বিজেপির মনে হচ্ছে কোথাও শাসক দল হিসেবে তাদের মধ্যে একটা অবক্ষয় এসেছে। এর ফলে যে রাজনৈতিক পরিসরটা ফাঁকা হচ্ছে, রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হচ্ছে, বোধহয় এবার তৃণমূল সেই রাজনৈতিক জায়গাটা দখল করে নেবে।

আরও পড়ুন-পুরভোট : আইনি পরামর্শ নিয়ে এগোচ্ছে কমিশন

সবচেয়ে বড় সমস্যা তো বিজেপি দলের ভিতরে। যে আরএসএস নেতা সুনীল দেওধর ত্রিপুরায় বিজেপিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারিগর ছিলেন আজ তাঁকেই ওখান থেকে সরে যেতে হয়েছে। যদিও তিনি সম্প্রতি এসে বিপ্লব দেবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, জনসমক্ষে দেখানো হয়েছে যে তিনি এখনও বিপ্লব দেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ, কিন্তু আসলে ত্রিপুরাবাসীরা সকলেই জানেন যে বিপ্লব দেব অন্য কারও মতে চলেন না। তিনি দিল্লির শীর্ষ নেতৃত্বের কথায় চলেন।

আরও পড়ুন-এসএসসি গ্রুপ ডি কর্মী নিয়োগে হাইকোর্টের নির্দেশ সিবিআই তদন্তে স্থগিতাদেশ

কিন্তু এই বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব ত্রিপুরার দলের এমএলএদের সামলাতে পারছেন না। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সমীর বর্মনের পুত্র সুদীপ বর্মন, যিনি এই মন্ত্রিসভায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য, সেই সুদীপ সাংবাদিক বৈঠক করে বলছেন যে এই সন্ত্রাসের আবহাওয়া ভাল নয়। প্রশ্ন তুলছেন, এই হিংসা কেন হচ্ছে? অতিথি হচ্ছে নারায়ণ। তাঁরা এলে তাঁদের প্রতি এই ধরনের আচরণ করা হচ্ছে কেন? অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিক বৈঠক করে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে কোনও বিজেপি নেতাকে গ্রেফতার করা হয়নি।

একজন বিজেপি নেতার নাম বলুন যিনি কারাগারে গেছেন। দিলীপ ঘোষ কারাগারে গেছেন? বা বিজেপির অন্য নেতারা কেউ কারাগারে গেছেন? এমনকী কোনও জেলার সভাপতি কারাগারে গেছেন? পশ্চিমবঙ্গে যদি বিরোধী দল হিসেবে বিজেপি নেতাদের কাউকে জেলে পোরা না হয়ে থাকে তবে তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভানেত্রীকে ত্রিপুরার জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হল কোন অপরাধে? এই প্রশ্নই তুলেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এখানে ত্রিপুরার বিষয়ে একটা কথা উল্লেখযোগ্য। এটা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রোজেক্ট। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় স্থিতধী।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর মাস্টার স্ট্রোক, বাণিজ্য সম্মেলনের উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ঠান্ডা মাথায় যে কাজটা করছেন সেটা কিন্তু রাজনৈতিক। সেটা কিন্তু সরকার ফেলার খেলা নয়। আজ কিন্তু ত্রিপুরার বহু বিক্ষুব্ধ বিধায়ক সমবেতভাবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। তাঁরা চাইছেন যে অবিলম্বে বিপ্লব দেবের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে একটা বিকল্প সরকার গঠন করা হোক। তাতে ত্রিপুরার মানুষ মুক্তি পাবে। এই পুরো বিপ্লব দেব বিরোধী অভিযানে ত্রিপুরার স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের একাংশ শামিল।

একাধিক সংবাদপত্র ও তাদের সম্পাদকরা আছেন। কিন্তু অভিষেক তাঁদেরকে কিছুটা হতাশ করে দিয়ে বলেছেন যে এই সরকার ফেলার খেলায় তিনি আস্থা রাখেন না। আজকে যদি ছলে বলে কৌশলে বিক্ষুব্ধ বিধায়কদের সাহায্য নিয়ে বিপ্লব দেবকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় তাহলে একটা নতুন সরকার গঠন হতে পারে। কিন্তু সেটা গণতন্ত্রের জন্য শুভ দৃষ্টান্ত নয়। অর্থবল বাহুবল দিয়ে এইসব কাজ বিজেপি করে। এই কাজ তৃণমূল করবে না। বরং এই অভিযান চলবে। জনসভা হবে শত বাধা সত্ত্বেও।

২০২৩-এর বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত এই লড়াই চালিয়ে তারপর যথাযোগ্য জবাব দিতে হবে বিপ্লব দেবকে। তারপর নতুন সরকার গঠন হবে। সুতরাং রাজ্যপাল শপথ গ্রহণ করিয়েছেন যে মন্ত্রিসভাকে সেই মন্ত্রিসভাকে গদিচ্যুত করিয়ে একটা নতুন সরকার গড়ে ক্ষমতা দখল, এই রাজনীতিটা কিন্তু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক দর্শন নয়।

কাজেই ত্রিপুরা এখন সরগরম। কিন্তু ত্রিপুরার মানুষ বহুদিন পর আবার এরকম সন্ত্রাস দেখছে। মানুষ সিপিএমের সন্ত্রাস দেখেছে। সিপিএমের সেই সন্ত্রাসের জন্য তাদের ওপর থেকে মানুষ আস্থা সরিয়ে নিয়েছিল। সেটা কিন্তু রাতারাতি হয়নি, বেশ কিছুদিন ধরেই হয়েছিল। কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু কংগ্রেসের সময় দেখা গেছিল যে সিপিএমের ক্যাডার বাহিনীর একটা বড় অংশ কংগ্রেসের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। আর সেই সরকার ক্ষমতায় টিকতে পারেনি অভ্যন্তরীণ কলহের কারণে। সুধীর মজুমদার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, সমীর বর্মন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তাঁরাও কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। আবার লড়াই বেধেছে। আবার সন্ত্রাস শুরু হয়েছে। আর সেই রাজনৈতিক শূন্যতাটা দখল করেছে বিজেপি। বিজেপি নিজেও কিন্তু সেই একই ভাবে একই দোষে অভিযুক্ত।

আরও পড়ুন-বিজেপির উস্কানিতে আশান্তি দুবরাজপুরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এল পুলিশ

আজ কিন্তু বিজেপির মধ্যে এসে বেনোজল ঢুকেছে। সিপিএমের সেই সমস্ত ক্যাডার বাহিনী, হার্মাদ বাহিনী তারা কংগ্রেস ঘুরে ফের বিজেপিতে ঢুকেছে। বিজেপিতে ঢুকে তারা যে সন্ত্রাস শুরু করেছে তার মূল আক্রমণের লক্ষ্য কিন্তু সিপিএম বা কংগ্রেস নয়। কেননা সিপিএম বা কংগ্রেসের রাজনৈতিক পরিসর মুছে গেছে কার্যত ত্রিপুরা রাজ্য থেকে। সুতরাং রায় গোবিন্দমাণিক্যের ত্রিপুরায় আবার রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ আবার দেখছে বিজেপির সন্ত্রাস। এই সন্ত্রাস কিন্তু বিজেপির দুর্বলতার পরিচয়, শক্তির লক্ষণ নয়।

তৃণমূল সরকার যে গতিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ত্রিপুরায় এগোচ্ছে তাতে বিপ্লব দেবের বিজেপি সন্ত্রস্ত। তাই বিজেপি রুখতে চাইছে এই অভিযান।
কিন্তু বিজেপি কি শেষরক্ষা করতে পারবে? নাকি ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে আবার ত্রিপুরায় আসবে নতুন পরিবর্তন!

Latest article