আমি চিনতাম তাঁর বাবাকে। এলাকার দাপুটে সিপিএম নেতা ছিলেন। দাপট এতটাই ছিল যে, পুলিশ-প্রশাসন এবং পার্টিতে তিনিই শেষ কথা বলতেন। জগদ্ধাত্রী পুজোর নিমন্ত্রণে এক বিশিষ্ট ব্যক্তির বাড়িতে গিয়েছিলাম। শনিবার সেখানেই সংশ্লিষ্ট নেতার সূত্রে এসে আলাপ করলেন। আমরা কয়েকজন রাজ্যের আসন্ন ৬টি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন নিয়ে আলোচনা করছিলাম।
সদ্য আলাপ হওয়া যুবক আলোচনায় যোগ দিয়ে বলেই দিলেন, ‘সিপিএম ক্রমশ নিজেকে প্রহসনের পার্টিতে পরিণত করছে।’ কিন্তু কীভাবে? তাঁর যুক্তি হল, ‘বিগত বিধানসভা নির্বাচনে বামেরা শূন্য হয়ে যাওয়ার পর থেকে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কর্তা-ব্যক্তিরা দিশেহারা হয়ে গিয়েছেন। নিজেদের অস্বিত্ব রক্ষার জন্য কখন কাকে ধরছেন, আর কাকে ছাড়ছেন, তা বোধহয় নিজেরাই জানেন না। তাতে নিজেদের দেউলিয়া রাজনীতিটাই মানুষের সামনে সামনে প্রকাশ করে দিচ্ছেন!’
কংগ্রেসের নীতি এবং আদর্শের বিরোধিতার মধ্যে দিয়ে, এদেশে কমিউনিস্ট তথা বাম রাজনীতির উত্থান। পঞ্চাশের দশকে কেরলে কংগ্রেস সরকারকে নির্বাচনের মাধ্যমে উৎখাত করে এই উত্থানের সূচনা হয়েছিল। ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ দেশের প্রথম কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী হন। ষাটের দশকে সেই পরিবর্তনের হাওয়ায় পশ্চিমবঙ্গেও রাজ্যপাট বদল হয়। ক্ষমতা দখল করে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে বামেরা। অবশ্য সেই সময়েই কমিউনিস্ট পার্টিতে ভাঙনও দেখা দেয়। তৈরি হয় সিপিআই ভেঙে সিপিএম। ক্রমশ আরও অনেক গোষ্ঠীতে কমিউনিস্টরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভাগ হয়ে যায়।
১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর কেবল পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা দেশের বাম রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে আসে সিপিএমের হাতে। জ্যোতি বসুকে সামনে রেখে সেই অভিযান এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, প্রধানমন্ত্রী পদেরও দাবিদার হয়ে ওঠে তারা। সেটা অবশ্য শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। জ্যোতিবাবুর পরবর্তী প্রজন্মের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তো ঔদ্ধত্যের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। এ রাজ্যে জমি আন্দোলনের সময় মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে বুদ্ধদেববাবু বলেছিলেন, ‘কেন্দ্রের সরকারকে আমরা উঠতে বললে উঠবে, বসতে বললে বসবে।’ অর্থাৎ দিল্লির মসনদের নবাবরা তাদের হাতের পুতুল। যখন তখন তাদের ওঠবোস করানোর ক্ষমতা সিপিএমের আছে। আসলে লোকসভার এমপি সংখ্যার নিরিখে, বামেরা সেইসময় ছিল ক্ষমতার দাঁড়িপাল্লার বাটখারা!
পরবর্তী সময়ে সিপিএম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক গণ-আন্দোলনের জেরে বিধ্বস্ত হল। ক্ষমতাচ্যুতই কেবল নয়, মা-মাটি-মানুষের সরকারের তাড়ায় শেষমেশ তারা গর্তে ঢুকে গেল। তা না হলে, বিধানসভায় তাদের আসন শূন্য হয়? আর সেই শূন্যতাই সিপিএমকে দিশাহীন করে দিয়েছে। নানা গবেষণা চলছে। যে কংগ্রেসের বিরোধিতার মধ্যে দিয়ে কমিউনিস্টদের জন্ম, তাকেই জোটসঙ্গী করে ভোটের লড়াইয়ে নামল সিপিএম।
বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনের ফলে তাদের সব লম্ফঝম্প তলিয়ে গেল। বিধানসভা ভোটের আগে প্রচারের ঢাকে বোল তুলে বলা হয়েছিল, কংগ্রেস-বামজোট রাজ্যে সরকার গড়বে। কিন্তু সেগুড়ে বালি! সরকার গড়ার কথা যে পাগলের প্রলাপ ছিল তা জোট নেতৃত্বের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। সেই জোট ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনেও মুখ থুবড়ে পড়ল।
আরও পড়ুন- মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে নতুন ভূ-মানচিত্র পশ্চিমবঙ্গের
আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন মা-মাটি-মানুষের সরকার বাংলায় উন্নয়নের যে রথ ছুটিয়ে দিয়েছেন, তাকে থামানো যাচ্ছে না। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের সংগঠনও পাকাপোক্তভাবে এগিয়ে চলেছে। এই যৌথ নেতৃত্বকে মোকাবিলা করার কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছে না সিপিএম। বিরোধী, রাজনীতিই এরা ভোঁতা হয়ে গিয়েছে।
তাই আসন্ন বিধানসভার ৬টি আসনের উপনির্বাচনে সিপিএম নতুন গবেষণায় নেমেছে। মাত্র একটি আসনে তারা নিজেরা লড়ছে। সেটি হল, বাঁকুড়ার তালডাংরা। বাকি ৫টি আসন ছেড়ে দিয়েছে বামফ্রন্টের শরিক দলগুলির পাশাপাশি ‘চিরশত্রু’ সিপিআই (এমএল) লিবারেশনকে। বামফ্রন্টের এক শরিক নেতা ঠাট্টা করে বলছিলেন, ‘এতো মরণকালে হরিনাম!’ যে কংগ্রেসের সঙ্গে গলা জড়াজড়ি করে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সরকার গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল সিপিএম, সেই জোটসঙ্গীকে এবারের নির্বাচনে দূরে ঠেলে দিয়েছে তারা।
রাজনৈতিক মহল নিশ্চিত, সিপিএমের ঘুরে দাঁড়ানোর সর্বশেষ গবেষণায় দলও শূন্যই হবে। বিগত বিধানসভার নির্বাচনে তালডাংরা এবং নৈহাটি কেন্দ্রে সিপিএম কিছুটা ভোট পেয়েছিল। যথাক্রমে ১১.৬ এবং ১০ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল তাদের। নৈহাটির মতো লালপার্টির একসময়ের দুর্ভেদ্য দুর্গে নকশালদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ তাদের চােখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সিপিএম বর্তমানে এ রাজ্যে কোথায় অবস্থান করছে। প্রবন্ধের শুরুতে সিপিএম নেতার পুত্রের কথাটি ফের মনে পড়ছে, ‘সিপিএম ক্রমশ নিজেকে প্রহসনের পার্টিতে পরিণত করছে!’
আর প্রধান বিরোধী দল বিজেপির কথা যত কম আলোচনা করা যায় ততই ভাল। কারণ, পদ্মশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নিজেরাই রাজ্যপার্টিকে ‘খরচের খাতায়’ ফেলে দিয়েছেন। বিরোধী দল হিসাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কোনও চেষ্টা তাদের নেই। অনবরত অন্তর্দ্বন্দ্ব গেরুয়া শিবিরকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আসন্ন ৬টি কেন্দ্রের উপনির্বাচনে তাদের দখলে থাকা উত্তরবঙ্গের মাদারিহাট হাতছাড়া হতে পারে। বিজেপির কোনও নেতাই একান্তে বুক ঠুকে বলতে পারছেন না, তাঁরা এই ছয় কেন্দ্রের মধ্যে কোথাও জোড়াফুলকে জব্দ করতে পারবেন। তাই সিপিএমের মতোই তাদেরও অগ্নিপরীক্ষা। সেই পরীক্ষা হল, ভোটের শতকরা হিসাবের কোনও হেরফের হয় কি না।