রুচিরা ইদানীং ভীষণ অ্যাসিডিটির সমস্যায় ভুগছে। কিছু খেলেই জিভটা টক। খালিপেটে একগ্লাস উষ্ণ গরম জলে লেবু চিপে এক চামচ মধু মিশিয়ে সকালটা শুরু করে। তারপরে সারাদিন মেপে খাওয়া। তা হলে এতটা অম্বলের কারণ কী?
রোজ অফিসে লাঞ্চের পর একটা গোটা ফল না খেলে রমিতার যেন ভাতটাই হজম হয় না। কোনওদিন আপেল, কোনওদিন অন্য কোনও ফল। কথায় বলে ভরা পেটে ফল খুব উপকারী। কিন্তু ক’দিন ধরে ফল তো দূরের কথা, দুপুরের খাবারটাই আর ঠিকমতো খেতে পারছে না রমিতা। সারাক্ষণ পেটটা ফেঁপে রয়েছে। এমনিতেই ওর পেটে একটা সমস্যা আছে। তাই খুব বুঝেশুনে খাওয়াদাওয়া করে ও। তাহলে এমনটা হবে কেন!
রাই পুতুলকে রোজ দই-কলা আর কর্নফ্লেক্স খাইয়ে স্কুলে পাঠায়। দুধটা পুতুল খেতে পারে না। দই-কলা-কর্নফ্লেক্সটা খুব এনজয় করছিল পুতুল। রাইয়েরও শান্তি। কিন্তু সেদিন স্কুলে আনতে গিয়ে রাই ক্লাস টিচারের থেকে জানতে পারল পুতুল নাকি ভীষণ বমি করেছে। কোনওভাবে হয়তো অ্যাসিড হয়ে গেছে। পরেরদিন মেয়ে স্কুল থেকে ফেরার পর টিফিনবক্স খুলে দেখল সে টিফিন খায়নি। বলল, মাম্মা আমার পেটটা খুব ভরে আছে। কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে!
আরও পড়ুন-জঙ্গলমহলের সবুজদ্বীপে ইকো পার্ক নয়া রূপে
এমন ঘটনা তো আমাদের জীবনের রোজনামচা। ইদানীং খাওয়াদাওয়া বিষয়টাই খুব চর্চায়। ইউটিউব ফেসবুকে চোখ রাখলেই বোঝা যায়। বিয়েবাড়ি, রেস্তোরাঁ প্রোমোশন, নতুন কোন ফুড লঞ্চ তার প্রোমোশন, ক্যামেরার সামনে বসে কাঁড়ি কাঁড়ি খাবার গলাধঃকরণ। ভোজনরসিক বাঙালির নতুন পেশা বিয়েবাড়ি, পৈতেবাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে চর্বচোষ্য খাওয়া এবং ভিডিও করা। এ তো গেল একশ্রেণির খাদ্যরসিক, অন্য শ্রেণিটি হলেন স্মার্ট ফুডিরা। তাঁরাও খান, খাবার নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে থাকেন। তাঁরাই ডাক্তার আবার তাঁরাই ডায়েটেশিয়ান। তাঁদের পরামর্শে অনেকেই নিজে নিজেই বেছে নিচ্ছেন ডায়েট প্ল্যান আর শুরু করে দিচ্ছেন। আগুপিছু না ভেবেই সকালে উঠে খালি পেটে একগ্লাস লেবুজল বা স্মুদি খেয়ে দিনটা শুরু করে ফেলছেন। লাঞ্চ সেরেই বসে যাচ্ছেন গোটা ফল নিয়ে। ওজন কমাতে সারাদিন ধরে টকদই শসা বা শুধু ফ্রুট জ্যুস খেয়েই গোটা দিন কাটিয়ে দিচ্ছেন। এখন আবার ষোলো ঘণ্টার ফাস্টিং বা উপোসের ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে। আসলে যেমন খাবার কম বা বেশি খেলেই হল না আবার তেমনই যে কোনও খাবার যে কোনও সময় খেলে নিলেও হল না। অনেকেই এটা জানেন না যে খাবারের একটা নির্দিষ্ট যেমন পরিমাপ আছে তেমনই কোন খাবারটা কোন খাবারের পর খাওয়া উচিত এবং উচিত নয় তারও একটা যথাযথ নিয়ম আছে। কার আলু সহ্য হয় না তো কারও মুলো। জানতে হবে খাবারের সবটা সেই সঙ্গে নিজের শরীরের গড়ন।
বিশিষ্ট আয়ুর্বেদাচার্য ডাঃ প্রদ্যোতবিকাশ কর মহাপাত্র এই নিয়ে বললেন, শাস্ত্র এবং আয়ুর্বেদ অনুযায়ী সব খাবারই ভাল কিন্তু শুধুমাত্র সংযোগদোষে তা ক্ষতিকর হয়ে যায়। কিন্তু কেন? তাহলে কী খাব বা কোনটার পর কী খাব না এগুলোও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ!
আরও পড়ুন-আসানসোলে নাইট সার্ভিস বাস চালু করতে উদ্যোগী পুরনিগম
খাবারের মিস ম্যাচ
খাবার খেতে গিয়ে আমরা ভাবি পেট ভর্তি হয়ে গেলেই বুঝি হয়ে গেল, ব্যাপারটা তা নয়। সেই মিস ম্যাচ হলেই বিপদ। শাস্ত্রে তিন ধরনের আহারের উল্লেখ রয়েছে— সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক আহার। তার মধ্যে সেগুলোই হল সাত্ত্বিক আহার যা আমাদের আয়ু বৃদ্ধি করে, মনের অবস্থানকে উন্নত করে, ভাল চিন্তা করতে শেখায়। আয়ুসত্যবলারোগ্য অর্থাৎ সঠিক খাবার বল দেয়, আরোগ্য দেয়। সুখপ্রীতিবিবর্ধনা অর্থাৎ সুখ দেয়, প্রীতি সৌহার্দ দেয়। যেমন জল, দুধ, ঘি, অন্ন এগুলো নাকি হিত দ্রব্য। এই দ্রব্য মানুষের পক্ষে সাত্ম্য। এগুলোই সাত্ত্বিক আহার।
অহিতকর দ্রব্য হল অগ্নি, ক্ষার এবং বিষ। অর্থাৎ অত্যধিক কটু বা ঝাল, অত্যধিক টক বা অম্ল, অত্যধিক ক্ষার, অতি উষ্ণ, অতি তীক্ষ্ণ, অতি রুক্ষ বা শুকনো ইত্যাদি। রাত পেরনো খাবার অর্থাৎ বাসি। কিন্তু বিষয়টা হিত এবং অহিতের নয়। আমরা অনেক সময় হিতকর দ্রব্যও ঠিকমতো বুঝে খাই না। এটাকেই সংযোগবিরুদ্ধ আহার সোজা ভাষায় মিস ম্যাচ।
পুতুলের জলখাবারে দই আর কলাটাই ছিল যত নষ্টের গোড়া। এই খাবার দুটোই হল গুরুপাক অর্থাৎ সংযোগবিরুদ্ধ আহার ফলে সকালে প্রথমেই ওটা খেলে হজমের গোলমাল হবেই হবে।
আবার রমিতার পেটের ক্রনিক সমস্যা রয়েছে তাই ওর জন্য ভরা পেটে ফল একদম নয়, খেলে বিপদ আরও বাড়বে বই কমবে না।
রুচিরা একদম খালি পেটে রোজ লেবুর, মধুর জল খায় আর রোজ অ্যাসিড হয় তাই লেবু-মধুর জলটা খেলেই হল না, বুঝে খেতে হবে। সম্পূর্ণ খালি পেটে না খাওয়াই ভাল।
শুরুয়াৎ তেতো দিয়েই হোক না
যে কোনও খাবার তেতো দিয়ে শুরু করলে হজমি রস বা উৎসেচক আরও ভাল করে নিঃসরণ হয়। তাই ভাতপাতে যুগে যুগে প্রথম তেতো খাবার চল ছিল। এখন তা ধীরে ধীরে অস্তমিত। এখন সর্বত্র প্রচলিত কথাটি হল স্টার্টার। সেই স্টার্টারে পকোড়া, ফুচকা, চাট আরও কত কী! বাড়িতেও এখন রোজ ক’টা পরিবার শুক্তো বা উচ্ছে চচ্চড়ি খান? তেতো লিভারের স্টিমুলেশন হিসেবে কাজ করে, অ্যাপিটাইজার হিসেবে কাজ করে, খিদে বাড়ায়, লিভার ভাল রাখে কিন্তু আমরা আজ আর সে সবের ধার ধারি না। তাই স্টার্টারে ভেজিটেবল স্যুপ থাকুক প্রথম পাতে।
আরও পড়ুন-তিন প্রকল্পের সূচনা করলেন এসডিও
এসব খাবার একসঙ্গে পেটে নয়
ঘি, মাংস, পায়েস গুরুপাক। আবার, ঘি আর মধু একসঙ্গে বিষময়। মাংসের এবং খিচুড়ির পরে পায়েস কখনওই খাওয়া উচিত নয়।
শাক খাওয়ার পরে মাংস খাওয়াও নিষিদ্ধই অর্থাৎ গুরুদ্রব্যের সঙ্গে আরও বেশি গুরুদ্রব্য মেশালে শরীর বিষময় হওয়ার সম্ভাবনা।
তেলে যখন পেঁয়াজ-রসুন কষানো হয় তখন সেটা কড়াপাক হয়ে যায় এবং পেটে গিয়ে তা বিষময়। এর থেকে গ্যাস্ট্রাইটিসের সম্ভাবনা থাকে, লিভারে চাপ পড়ে। দিনে দিনে লিভার দুর্বল হতে থাকে। কিন্তু শুধু রসুন বা পেঁয়াজের হাজার গুণ।
পালং শাক আর তিল একসঙ্গে নয়।
গোলমরিচ আর মাছ একসঙ্গে খাওয়া উচিত নয়।
দুধ কখনওই মাংস এবং মাছের সঙ্গে খাওয়া উচিত নয়। এগুলি একসঙ্গে খেলে আমাদের দেহে টক্সিনের মাত্রা বেড়ে যায়।
হলুদ, ছাতা-ধরে যাওয়া মাশরুম সরষের তেলে রান্না নয়।
ঘি, তরমুজ, পেয়ারা, শসা, বেরি এবং চিনাবাদাম কখনওই ঠান্ডা জল দিয়ে খাওয়া উচিত নয়।
ভাতের পরে কলা নয়।
মুড়ির সঙ্গে আম নয়।
আরও পড়ুন-সেই হার মহামেডানের
কী এড়াবেন কখন এড়াবেন
শাস্ত্র বলছে নক্তমদধিমুঞ্চিত অর্থাৎ রাত্রে দই খাবে না। দই হল গুরু, মন্দ হিম, স্নিগ্ধ, অভিসন্ধজনক আহার তাই দই খেলে আমবাত হয়। যাকে আমরা চলতি ভাষায় বলি রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস।
শীতল পানীয় নৈব নৈব চ। যত কম খাবেন তত ভাল।
ডাল যেগুলো ভাঙলে দু’আধখানা হয়ে যায় সেগুলো কম খেতে হবে। না হলেই হজমের গোলমাল আর তার সঙ্গে বাড়বে গা-হাত-পায়ে ব্যথা-বেদনা, বাড়বে অর্শ।
খাওয়ার আগে আর খাওয়ার পরে কখনওই অনেকটা জল খেয়ে ফেলবেন না।
দিনে আনি দিনেই খাই
সূর্য আমাদের সব খারাপকে শুষে নেয়। তাই দিনের বেলায় বা দুপুরবেলা পিত্তের প্রাবল্য থাকে আর রাত্রিবেলা কফের প্রাবল্য দেখা দেয়। সুতরাং দিনের বেলায় দই, ঘি, মাছ, মাংস— এইসব গুরুদ্রব্য খেলে ক্ষতি নেই কারণ সহজে হজম হবে। কিন্তু রাত্রিবেলা অর্থাৎ রাত হল কফের কারক অর্থাৎ আয়ুর্বেদের ভাষায় অভিসন্ধজনক। অর্থাৎ শরীরে যে স্রোত বা চ্যানেল রয়েছে তাতে কফের সঞ্চার হয়ে ভারী হয়ে যায়। হজম হতে দেরি হয় এবং পরবর্তীতে তা রোগের কারক হয়ে দাঁড়ায়। আর সূর্য, আমাদের পরম বন্ধু তাই সূর্য যখন থাকে আকাশে তখন পিত্তের সঞ্চরণ ভাল হয়, এনজাইম সিক্রেশন ভাল হয় ফলে খাবার হজম হয়ে যায়।
রাতে হাল্কা খাবার খেতে হয় কারণ পিত্ত কম ক্ষরণ থাকে। উৎসেচক বা হজমিরস তৈরি হয় না তাই ভারী খাবার না খেলেও আপনি থাকবেন যুগ যুগ জিও।
আরও পড়ুন-বিধ্বংসী স্টার্ক, ফিরল গোলাপি আতঙ্কও
আহার, বিহার, উপচার
মিথ্যা আহার বা ফল্টি ডায়েটরি রেজিমেন, মিথ্যা বিহার অর্থাৎ লাইফস্টাইল বা জীবনযাত্রা উন্নত হওয়া দরকার এবং মিথ্যা উপাচার অর্থাৎ ভুল ওষুধ খাওয়া, ভুল ব্যায়াম ইত্যাদি পেটের অ্যাসিড পেপসিন মিক্সচার এবং যা উৎসেচক ক্ষরণ হয় তাকেই পাচক অগ্নি বা জঠর অগ্নি বলি। একে ভাল রাখা আমাদের দায়িত্ব কিন্তু সংযোগবিরুদ্ধ আহারে অর্থাৎ উল্টোপাল্টা খাবারে এই অগ্নি বিষমাগ্নি, মন্দাগ্নিতে পরিণত হয়। এতে শরীরে বায়ু বেড়ে যায় পিত্ত কমে যায়। আর তীক্ষ্ণাগ্নি হয় যখন শরীরে পিত্ত বেড়ে যায়। বিভিন্ন মশলা এই পিত্তকে বাড়িয়ে তোলে। তাই সবার আগে বেশি তেল, মশলার খাবার, বাসি-পচা খাবার, শুষ্ক, রসাল খাবার খাওয়া বন্ধ করা উচিত।