কোনও রাজ্যের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পরিমাপের জন্য মোট রাজ্য দেশীয় উৎপাদন বা Gross State Domestic Product (GSDP) হল গুরুত্বপূর্ণ সূচক। সময়ের সাথে সাথে অর্থনীতির এই সূচক রাজ্যের উন্নতির মাপকাঠি বিচার করে। GSDP বাড়ার পিছনে কিছু কারণ থাকে, সেগুলো হল পরিকাঠামো উন্নয়ন, সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়, উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি এবং সরকারি নীতি। এর বাইরেও বেশ কিছু কারণ আছে যেমন আমদানি ও রফতানি, ডিজিটালাইজেশনের সরলীকরণ ইত্যাদি।
পরিকাঠামো উন্নয়ন বলতে আমরা বুঝি রাস্তাঘাট, রেলপথের সম্প্রসারণ, সমুদ্র বন্দরের উন্নতিকরণ যা ব্যবসা বাণিজ্য, পরিবহনে ও উৎপাদনে সহায়তা করে। সামাজিক ক্ষেত্র বলতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এছাড়া প্রান্তিক মানুষের জন্য সামাজিক কিছু ভাবনা। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বিশেষত বলতে বোঝায় শিল্পের উন্নয়ন এবং কত পরিমাণ লগ্নি হল ইত্যাদি। সরকারি নীতি কয়েকটি বিষয়-এর ওপর নির্ভর করে যেমন, বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি, সাধারণ মানুষের কাছে ডিজিটাল ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা। আগামীতে কি হবে সেটা বলার থেকে এখন পর্যন্ত কী হয়েছে সেটা মনে হয় মানুষের কাছে বেশি কার্যকর। কিছু পরিসংখ্যান দেখে নেওয়া যাক, ২০২৪-২৫ (প্রথম আ্যডভান্স এস্টিমেট) সালে GSDP বৃদ্ধি পেয়েছে ৬.৮০ শতাংশ, যেখানে সর্বভারতীয় বৃদ্ধির হার ৬.৩৭ শতাংশ। শিল্প ক্ষেত্রে বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৭.৩ শতাংশ, যেখানে জাতীয় বৃদ্ধির হার ৬.২ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে কৃষি ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ৪.২ শতাংশ, যেখানে জাতীয় বৃদ্ধির হার ৩.৮ শতাংশ। পরিষেবা ক্ষেত্রে (সার্ভিস সেক্টর) বৃদ্ধির হার ৭.৮ শতাংশ, জাতীয় ক্ষেত্রে তা ৭.২ শতাংশ।
রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ ২০১০-১১ সাল থেকে ২০২৪-২৫ সালে দিগুণ এর বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সর্বাগ্রে গিয়ে এফেক্ট পড়েছে বেকারত্বের হারে। ভারতে ২০২৫ এর জানুয়ারী মাসে বেকারত্বের হার ছিল ৭.৯৩ শতাংশ CMIE (Centre for Monitoring Indian Economy)-এর রিপোর্টের ভিত্তিতে। যেখানে পশ্চিমবঙ্গের বেকারত্বের হার প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ৪.১৪ শতাংশ। এমন প্রবণতা ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে তৃতীয় কোয়ার্টারেও প্রায় এক ছিল। যেখানে ভারতে বেকারত্বের হার ছিল ৮.১ শতাংশ সেখানে পশ্চিমবঙ্গে ৩ শতাংশেরও কম ছিল। বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে এই বছর ২০২৫-এ শিল্প ক্ষেত্রে সর্বমোট ১৯ লক্ষ কোটি টাকার প্রস্তাব এসেছে তার মধ্যে ১৪ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে বাকি ৫ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প পাইপ লাইনে রয়েছে। বাণিজ্য সম্মেলনের প্রতিফলন শালবনি-তে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে শুরু হয়ে গেছে। যেখানে প্রায় ১৫০০০ জনের কর্মসংস্থান হবে। পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক অবস্থান অন্যান্য রাজ্যের থেকে অনেকটা আকর্ষণীয়। পাহাড়, মালভূমি, জঙ্গল, নদী কি নেই! এবং এই ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধা ব্যবহার করে ব্যপকভাবে লজিস্টিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। প্রাথমিক ভাবে ৪টি করিডর তৈরি করা হবে যার প্রকল্প ব্যয় হবে ৪৪০০ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন-চক্রান্ত ফাঁস হবেই, মে মাসেই মুর্শিদাবাদে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী
জঙ্গলমহলে অর্থাৎ পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে ‘জঙ্গল সুন্দরী কর্মনগরী’র জন্য ২৪৮৩ একর জমি শিল্পের জন্য বরাদ্দ হয়েছে যেখানে ৭২০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিন ফিল্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট্স স্থাপিত হতে চলেছে যার মাধ্যমে বিনিয়োগ হবে প্রায় ১৬০০০ কোটি টাকা। কয়েকটি সাধারণ বিষয় যেখানে সরকারের কোনও লাভ নেই বা ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতি নেই, তেমন কোনও প্রকল্প সরকার ভাবে না। মানবিক মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ভেবেছেন অর্থাৎ আমি মাতৃদুগ্ধ ব্যাঙ্কের কথা বলছি। কোনও শিশু যদি জন্মের পর মাতৃহারা হয় তাহলে সেই শিশুর দুধের অভাব মেটানোর জন্য মাতৃদুগ্ধ ব্যাঙ্কের ভাবনা। যেখানে মা-রা তাদের দুগ্ধদান করতে পারেন। যদিও পশ্চিমবঙ্গে প্রসব-এর সময় মৃত্যুহার নেই বললেই চলে। কিছুদিন আগের একটি প্রতিবেদন ‘বেঙ্গল মিনস্ বিজনেস’-এ আমি শিল্পের নানান দিকের ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম, তারই রাশ টেনে রিলায়েন্স কোম্পানির সিইও তরুণ ঝুনঝুনওয়ালার কথায় ‘শিল্প এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বাংলার পুনর্জন্ম হয়েছে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর নেতৃত্বে ওয়েস্ট বেঙ্গল এখন বেস্ট বেঙ্গল’।
পশ্চিমবঙ্গে রিলায়েন্সের বিনিয়োগের পরিমাণ এখন ৪.৫ বিলিয়ন পাউন্ড যা আগামী দশকে দিগুণ হতে চলেছে। লাগাতার উন্নয়নের গতিতে ভর করে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৯২ লাখ মানুষকে দরিদ্র থেকে মুক্ত করা গেছিল, কিন্তু ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে সেই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১.৭২ কোটি। যা এককথায় অভূতপূর্ব। ভবিষ্যতে GSDP যে আরও উন্নতি হবে তার কয়েকটি ইঙ্গিত দিয়ে রাখি, সেগুলো হল দেওচা-পাঁচামি কোল মাইনিং-এর থেকে কয়লা উত্তোলন, উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরে তেল ও গ্যাস-এর উত্তোলনের কাজ শুরু হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন হতে চলেছে সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের হাত ধরে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৪৬ শতাংশ বেকারত্ব হ্রাস করা গেছে।
আরও পড়ুন-হৃষিকেশে র্যাফটিং করতে গিয়ে নৌকা উল্টে তলিয়ে গেলেন যুবক
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ডিজিটাল ক্ষেত্রে ও যে পারদর্শী হয়ে উঠেছে সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এর জন্য কৃতিত্ব দাবি করতে পারে বাংলা সহায়তা কেন্দ্র। রাজ্যে বাংলা সহায়তা কেন্দ্রের মাধ্যমে ডিজিটাল লেনদেন গত এক বছরে দ্বিগুণের কাছাকাছি বেড়েছে। ২০২৩ সালে যেখানে ওই কেন্দ্রগুলির মাধ্যমে ১৬৯ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল। বাংলা সহায়তা কেন্দ্রগুলি থেকে বিভিন্ন পরিষেবা দিয়ে রাজ্য সরকার সদ্যসমাপ্ত আর্থিক বছরে প্রায় ৪৯২ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে। তার মধ্যে মার্চ মাসেই সর্বোচ্চ ৬৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে সব মিলিয়ে বিএসকে-গুলির মাধ্যমে মোট ১ কোটি ৮৯ লক্ষ পরিষেবা প্রদান করা হয়েছে। এইসব পরিসংখ্যান দেখে কেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য মাননীয়া-কে ডাকা হয়েছে তা হয়তো বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা না। যাই হোক ভারতবর্ষের এগিয়ে যাওয়ার জন্য বাংলার এগিয়ে যওয়াটা সবথেকে বেশি দরকার। মেধা, বুদ্ধি, উন্নয়ন— সব দিক থেকেই পশ্চিমবঙ্গ এগিয়ে আছে, ভবিষ্যতেও এগিয়ে থাকবে।