ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (Ishwar Chandra Vidyasagar) ‘সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা’ প্রকাশিত হলে এক পণ্ডিত তাঁর সঙ্গে দেখা করে বলেন, “মশায়, আপনি ব্যাকরণের রেলরোড করেছেন বলে আপনাকে দেখতে এসেছি। রেলরোডে যেমন ছ-মাসের পথ ছ-দিনে যাওয়া যায় আপনার উপক্রমণিকা পড়ে সেইরকম ছ-মাসের ব্যাকরণ ছ-দিনে শেখা যায়।” এই উদ্ধৃতিটির মধ্যে আমার ব্যক্তিগত পছন্দের শব্দ হল ‘রেলরোড’। মাতৃভাষা (বা প্রথম ভাষা) ছাড়া অন্য কোনও ভাষা (দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা) শেখার ক্ষেত্রে এই ‘রেলরোড’ কেমন হতে পারে, পৃথিবীর শিক্ষাবিদরা সেই নিয়ে আজও গবেষণা করছেন, সমীক্ষা চালাচ্ছেন, নতুন নতুন পথের সন্ধান দিচ্ছেন।
এই রকম অজস্র উদাহরণের মধ্যে আপাতত একটি দৃষ্টান্ত এখানে হাজির করি। কলম্বিয়ার বোগোটা শহরের একটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে সমীক্ষাটি চালানো হয়। এই স্কুলের প্রায় সব ছাত্রই কলম্বিয়ান এবং স্প্যানিশভাষী পরিবারের। এই স্কুলে দুটি মেথড একইসঙ্গে প্রয়োগ করা হল। কিছু শিক্ষার্থীকে নিয়ে যাওয়া হল এমন ক্লাসে, যেখানে ইংরেজি ভাষা শেখানো হয় শুধুই ইংরেজিতেই। ইমারশন মডেলের অনুসরণে ইংরেজি পরিবেশে একেবারে একেবারে ডুবিয়ে রাখা হল। অন্য ক্লাসে ইংরেজি শেখানোর জন্য সাহায্য নেওয়া হল তাদের প্রথম ভাষার, কিন্তু সে সাহায্য অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত এবং প্রয়োজনসাপেক্ষ। এই সমীক্ষায় বছরখানেক বাদে দেখা গেল যে প্রথম ভাষার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে তুলনামূলক ভাবে এগিয়ে গেছে সেই ক্লাসের শিক্ষার্থীরা। অর্থাৎ এই ক্লাসে এমন একটা ‘রেলরোড’ পাতা হয়েছিল, যেটা অন্য ক্লাসে অনুপস্থিত ছিল।
কিন্তু এত বছর আগে এই ‘রেলরোড’-এর কথা কীভাবে মাথায় এল বিদ্যাসাগরের (Ishwar Chandra Vidyasagar)! রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় একদিন এসে হাজির হন বিদ্যাসাগরের বাসায়, যখন তাঁর ভাই দীনবন্ধু উচ্চস্বরে মেঘদূত পাঠ করছেন। এই পাঠ শুনে রাজকৃষ্ণের শখ হল সংস্কৃত শেখার এবং সে-কথা তিনি জানালেন বিদ্যাসাগরকে। বিদ্যাসাগর রাজি হলেন সংস্কৃত শেখাতে, কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর মনে পড়ে নিজের অভিজ্ঞতাও। তিনি যখন মুগ্ধবোধ মুখস্থ করতেন, তখন তার একবর্ণও তিনি বুঝতে পারতেন না, অনেক পরে সেসব তাঁর ধাতস্থ হয়। সুতরাং, এইভাবে যদি রাজকৃষ্ণকে সংস্কৃত ব্যাকরণের পাঠ দেন, তাহলে প্রবল সমস্যার মুখে পড়তে হবে। সেইদিনের মতো তিনি বিদায় জানালেন রাজকৃষ্ণকে। পরের দিন যখন রাজকৃষ্ণ আসেন, তিনি খেয়াল করেন, কয়েকখানা ফুলস্ক্যাপ কাগজে বাংলা বর্ণমালায় মুগ্ধবোধের সারাংশ বিদ্যাসাগর লিখে রেখেছেন।
আসলে ঠিক কী ঘটালেন বিদ্যাসাগর? রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন বাংলা ভাষার খুঁটিনাটি। এইটিই তাঁর মাতৃভাষা, বা প্রথম ভাষা। তিনি শিখতে চলেছেন আর-একটি ভাষা, যেটি আদতে তাঁর কাছে তৃতীয় ভাষা। সেই ভাষার শিক্ষা যে প্রথম ভাষা শিক্ষার মতো হবে না, দীর্ঘদিন আগেই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বিদ্যাসাগর তা বুঝতে পেরেছিলেন। আর বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তিনি সাহায্য নিলেন প্রথম ভাষার, তিনি পাতলেন বাংলা ভাষার ‘রেলরোড’।
আরও পড়ুন- কুৎসিত-নির্লজ্জ-নোংরা রাজনীতি ইডির
এই রেলরোড কীভাবে ‘ছ-মাসের পথ ছ-দিনে’ অতিক্রম করল, তার প্রমাণ রয়েছে বিহারীলাল সরকারের সাক্ষ্যে। “রাজকৃষ্ণবাবু আমাদিগকে বলিয়াছেন,— ‘ইহাই উপক্রমণিকা ব্যাকরণের সূত্রপাত। উপক্রমণিকা ব্যাকরণের পূর্ব্বাভাস এইখানেই তাঁহার মস্তকে প্রবেশ করে। আমি সেই ফুলস্কেপ কাগজে লিখিত ব্যাকরণের সারাংশ এবং তাৎকালিক ব্যাপটিস্ট প্রেসে মুদ্রিত একখানা সংস্কৃত গ্রন্থ পড়িতে আরম্ভ করি। মাস দুই তিন পড়িয়া আমি ব্যাকরণের আভাস কতকটা আয়ত্ত করিয়া লই। তিন-চারি মাসের পর আমি মুগ্ধবোধ পড়িতে আরম্ভ করি।’ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শিক্ষা দিবার প্রণালীর গুণে এবং স্বকীয় অসাধারণ অধ্যবসায়ে ও পরিশ্রমবলে রাজকৃষ্ণ বাবু ছয় মাসের মধ্যে মুগ্ধবোধ পড়া সাঙ্গ করেন।”
রাজকৃষ্ণ তো তখন পরিণতমনস্ক ছাত্র, ফলে এই ‘রেলরোড’-এর মাহাত্ম্য বুঝতে তাঁর বিশেষ সময় লাগেনি। তাই এই পদ্ধতিতে শেখানোর ভার তিনি তুলে নিলেন নিজের হাতেই। যে ফুলস্কেপ কাগজগুলি থেকে তিনি শিখেছিলেন, তা ছড়িয়ে দিতে চাইলেন পৃথিবীময়। ১৮৮৯ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন উপক্রমণিকা, ‘Introduction to Sanskrit Grammar in Bengali. Translated into English with additions by Rajkrishna Banerji’। তৃতীয় ভাষা শেখানোর ক্ষেত্রে শুধু আর প্রথম ভাষা নয়, প্রয়োজনে দ্বিতীয় ভাষারও সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
এই বইয়ের ভূমিকায় খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলে বসলেন রাজকৃষ্ণ, “But the facilities (বিদ্যাসাগরের বাংলা ভাষার নেওয়া সাহায্য, অর্থাৎ সেই রেলরোড), afforded by this work, are not available to foreigners or to natives of other Provinces of India, by reason of its Bengali dress. Translation of it have, accordingly, been made into the vernaculars of same of the other provinces…” অর্থাৎ রাজকৃষ্ণ যেন করজোড়ে অনুরোধ করছেন অন্য দেশের এবং এই দেশের অন্য ভাষাভাষী মানুষের কাছে, যদি দ্রুত শিখতে চান সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ, তাহলে পাতুন এই ‘রেলরোড’।
সংস্কৃত ব্যাকরণ শেখানোর ক্ষেত্রে, প্রথম ভাষার সাহায্য এতটাই কার্যকর হয়েছিল যে, অনেকেই একে বাংলা ব্যাকরণ বলে ভুল করেছিলেন। এর একটা কারণ, সেই সময় বাংলা ব্যাকরণের সঙ্গে এক করে দেখা হত সংস্কৃত ব্যাকরণকে। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য বৈয়াকরণ নকুলেশ্বর বিদ্যাভূষণ তো এই পথেই ভুল বুঝেছিলেন উপক্রমণিকাকেও। তিনি জানিয়েছেন যে, তাঁদের ছাত্রবস্থায় বিদ্যাসাগরের উপক্রমণিকাকেই তাঁরা ‘বাংলা ব্যাকরণ বলিয়া’ পাঠ করতেন এবং ছাত্রজীবনের পর তিনি যখন বাংলা ব্যাকরণ সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে আলোচনা করেন, তখন বিদ্যাসাগর বাংলা ব্যাকরণ হিসাবে নিজের উপক্রমণিকার অনুপযোগিতার কথা তাঁকে বলেন। অর্থাৎ বিদ্যাসাগর উপক্রমণিকাকে বাংলা ব্যাকরণের বিকল্প বলে মনে করতে পারেননি। এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন অবশ্য উঠতে পারে। প্রথম ভাষার হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে যে অতি-নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়, তা কি উপক্রমণিকায় লঙ্ঘিত হয়েছে? বিদ্যাসাগর কি খেয়াল করেননি এই বিপদসংকেত? এই সমস্যার সমাধান তিনি অবশ্য পরে করেছেন। ব্যাকরণ কৌমুদীর তৃতীয় ভাগ প্রকাশের পর তাঁর মনে হয় যে, “বাঙ্গালা ভাষায় সংকলিত সূত্র অপেক্ষা অল্পাক্ষরগ্রথিত সংস্কৃত সূত্র অনায়াসে অভ্যাস করা ও স্মরণ করা যাইতে পারে। তাঁহাদের অনুরোধ যুক্তিযুক্ত বোধ হওয়াতে এইভাবে সংস্কৃত সূত্র সন্নিবেশিত হইল।” সংস্কৃত শেখাতে গিয়ে তা পুরোটাই প্রথম ভাষার মাধ্যমে শিখিয়ে ফেলা যে যুক্তিযুক্ত নয়, একসময়ে যে প্রথম ভাষার সাহায্যের হাত ছাড়িয়ে নিতেই হয়, ভাষাবিজ্ঞানের এই সূক্ষ্ম বিচার সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর (Ishwar Chandra Vidyasagar) অবহিত ছিলেন।
রামগতি ন্যায়রত্নও মনে করতেন যে, “…সংস্কৃত ব্যাকরণের দ্বারে যে ভীষণমূর্ত্তি ব্যাকরণ দণ্ডায়মান ছিল, তাহাকে দেখিয়া কেহই নিকটেই ঘেঁষিতে পারিতেন না… বিদ্যাসাগর সেই পথ পরিষ্কার করিয়া দিয়াছেন।” ‘রেলরোড’ যে প্রকৃত প্রস্তাবে এই ভীষণমূর্তি ব্যাকরণকে পরাজিত করে আধুনিক ভাষাশিক্ষার রথ চালিয়ে দিল, এই কারণেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে সমসাময়িক ভাষাবিজ্ঞানীদের সঙ্গেই একাসনে বসানো যায়, এতটাই তিনি প্রাসঙ্গিক, আজও।