পটভূমিকায় রামগিরি
‘আর মাত্র চারমাস পরেই কার্তিক মাসে দেব উত্থানী একাদশী। সেই দিন ঘটবে অভিশাপ মোচন। শেষ শরতের মনোরম প্রকৃতি, বিমল জ্যোৎস্নায় বিধৌত রজনীতে দীর্ঘ বিরহের পরে আসবে প্রিয় মিলনের পরম লগ্ন।’ এই বিরহগাথা কমলিকা অরুণেশ্বরের শাপমোচন অন্তে গন্ধর্ব চিত্ররথ আর প্রেয়সী মধুশ্রীর মিলনের গল্প নয়। এ-আখ্যানের জন্ম হয়েছে কমবেশি দু’হাজার বছর আগে এক মহাকবির কলমে। সেই অমর প্রেমকাব্য সাহিত্যে, পাঠে যতটা অমর, সাধারণ মানুষের কাছে ততটাই দূরে। বিরহী যক্ষের মনের উচাটন, কবি-কল্পনায় নবজলধর মেঘের বয়ে চলার পথ উপমায় সিদ্ধহস্ত কবির যথেচ্ছ অনুপম উপমা, কবির তৎকালীন ভৌগোলিক দক্ষতার উপর ভিত্তি করে একের পর এক সুন্দর স্থানের বর্ণনা নতুন পাঠককে একাধিক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। মহাকবি কালিদাস রচিত মেঘদূত আসলে কী জাতীয় কাব্য— প্রেম-বিরহ, প্রকৃতিপাঠ নাকি ভ্রমণকথা?
আরও পড়ুন-বাড়ি-বাড়ি পানীয় জল পৌঁছে দিতে জোরকদমে কাজ শুরু
অনেককাল আগের কথা
দেবী সরস্বতীর বরপুত্র মহাকবি কালিদাসের অমর প্রেমকথা সংস্কৃত ভাষার কাব্যগ্রন্থ ‘মেঘদূতম’। খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর কাছাকাছি কোনও সময় ছিল কালিদাসের যুগ। দু’হাজার বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও আকাশে বর্ষার মেঘ আসতে শুরু করলেই মনে গুঞ্জায় এক শব্দবন্ধ, ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’। মেঘদূতম-এর সঙ্গে আমাদের পরিচয় এইটুকু। একশো আঠারো শ্লোকের মন্দাক্রান্তা ছন্দে রচিত এই কাব্যগ্রন্থের শুরু এক দীর্ঘনিঃশ্বাস দিয়ে, শেষ একরাশ আশা দিয়ে আর মাঝের খানিকটা সময় যেন চলমান জীবনচিত্র। কিছু প্রিয় স্মৃতি কিছু আঘাত দীর্ণ ক্ষত, কিছু বাস্তবের ওঠাপড়া নিয়ে এক অনন্ত সাইনিউসইডাল কার্ভ।
কেন এই বিরহগাথা
কাব্যের শুরুতে দেখা যাচ্ছে কুবেরের ভৃত্য এক যক্ষ তার নবপরিণীতা স্ত্রীকে নিয়ে মেতে থাকায় কর্তব্যকর্মে কিছু অবহেলা করেছিল। অলকাপতি কুবের তাকে শাপ দেন— একবছর সে যক্ষসুলভ সমস্ত ক্ষমতা হারিয়ে রামগিরি পাহাড়ে মানবজীবন যাপন করবে। আটমাস কেটে যাওয়ার পর আষাঢ়ের প্রথম দিন থেকে কাহিনির শুরু। এই সময়ের সঙ্গে অদ্ভুত সমাপতন বিষ্ণুর শয়ন একাদশী। আবার কবির লেখনীতে, অভিশাপ শেষ হবে আর চারমাস পরে, বিষ্ণুর উত্থান একাদশীতে। মাঝের সময়টুকু মানুষের জীবন চলবে কারও নিয়ন্ত্রণবিহীন, প্রকৃতির স্বাভাবিক ছন্দে। ঠিক এই সময়কেই কবি বেছে নিচ্ছেন তাঁর লেখার সঠিক সময় হিসেবে। খরার মরশুম কেটে আকাশে নতুন মেঘের আগমন ঘটেছে। বিরহী যক্ষ মেঘকে অনুরোধ করছে যক্ষ নির্ধারিত পথে উড়ে উড়ে অলকাপুরী গিয়ে তার প্রিয়ার কাছে খবর পৌঁছে দিতে। আশা দিতে, আর মাত্র চারমাস পরেই হবে শাপমোচন, আসবে পিয়া মিলন লগন।
তুমি কি শুধুই প্রেমকথা
একঝলকে দেখলে মেঘদূত এক সরস প্রেমকাব্য। এর দুটি খণ্ড। পূর্ব মেঘ আর উত্তর মেঘ। নির্বাসিত বিরহী কামজর্জর যক্ষ বর্ষার মেঘ দেখে উতলা। মানুষের খেটে খাওয়া জীবন, বর্ষার মেঘ দেখলে চাষের কথা মনে আসবে। কিন্তু দেবযোনিদের সব সুখের ললিত জীবন। মেঘ দেখে প্রিয়ার জন্য মন উতলা হল যক্ষের। সে মেঘকে দূত হওয়ার জন্য অনুরোধ করছে— শুধু প্রিয়ার কাছে বার্তা পৌঁছলেই হবে যে সে বেঁচে আছে, আর চারমাসের অপেক্ষায় শেষ হবে এই বিরহ। এখানেই কাব্যের কাব্যিক মোচড়। মানুষ খেটে খায়, কল্পনায় আনে এক দারুণ সুখের জীবন হল স্বর্গ, যেটা শুধু দেবভোগ্য। কিন্তু ললিত চর্চা, বিরহ বেদনা, কাব্য শুধু মানুষই পারে রচনা করতে। তাই দেবযোনিকে মনুষ্যযোনি নিতে হয় দুঃখ বওয়ার জন্য। দ্বিতীয় ভাগ, উত্তর মেঘ অংশে রয়েছে, দূত হয়ে মেঘ তো অলকাপুরীতে পৌঁছল। সেখানে সে যা যা দেখবে— অলকাপুরীর বর্ণনা, প্রোষিতোভর্তিকা যক্ষ প্রিয়ার রূপ বর্ণনা, শেষে মেঘের জন্য শুভেচ্ছা বার্তা, সে যেন তার প্রিয়া বিদ্যুতের সঙ্গে কোনওদিনও বিচ্ছিন্ন না হয়।
মেঘপিয়নের ব্যাগের ভিতর
রামগিরি সেই পুণ্যস্থান, দণ্ডকারণ্যের অংশ যেখানে বনবাসকালে মা সীতার পদধূলি পড়েছে। সেখান থেকে মেঘ সোজা উত্তরে যাবে। সেখানে আম্রকূট পর্বত রয়েছে। এই আম্রকূট পরিবর্তিত অমরকণ্টক।
রেবাং দ্রক্ষ্যস্যুপলবিষমে বিন্ধ্যপাদে বিশীর্ণাং
ভক্তিচ্ছেদৈরিব বিরচিতাং ভূতিমঙ্গে গজস্য।।
হাতির পায়ে পায়ে পাথর সরে যে এলোমেলো বিচিত্র নকশা হয়, গরমে রেবার জল কমে বালিতে সেরকম আঁকিবুঁকি ফুটে উঠেছে। অমরকণ্টকের পর আসবে বিন্ধ্যপর্বতের বর্ণনা। সেখান থেকে দৃশ্যমান রেবা বা নর্মদা নদীর দৃশ্যমান রূপ।
এরপর মেঘ যাবে দশার্ণ দেশে বা মালব রাজ্যে যার রাজধানী বিদিশা নগরী। মধ্যপ্রদেশের বিদিশা নগরী আজ পরিচিত তার সাঁচি স্তূপের জন্য। কালিদাসের বর্ণনায় বিদিশার পাদবাহিনী নদী বেত্রাবতী। আর তাকে আজ আমরা চিনি বেতোয়া নামে।
বর্ণনায় বিন্ধ্যপর্বত থেকে বের হয়ে সিন্ধু নদী সোজা উত্তরে গেছে পড়ে, ভূগোলে ধাক্কা খাওয়ার পর টিকাকাররা জানাবেন বিন্ধ্য পর্বত থেকে উৎপন্ন কালীসিন্ধু নদীর কথা যা চম্বলের উপনদী, বলা যায় মালওয়া অঞ্চলের নদী এটি। মেঘ মালব্য অঞ্চল পেরিয়ে চলেছে অবন্তী রাজ্যে। অর্থাৎ মধ্যপ্রদেশ পেরিয়ে ছুঁয়েছে মহারাষ্ট্রকে। অবন্তী রাজ্যের রাজধানী উজ্জয়িনী। শিপ্রানদীর তীরে উজ্জয়িনীতে দ্বাদশ জ্যোতিরলিঙ্গের অন্যতম মহাকালের মন্দির। কালিদাসের গন্ধবতী নদী বর্তমানের রুদ্রসাগর। কালিদাসের বর্ণনায় মহাকালের আরতি আজও সমানভাবে বিখ্যাত।
কালিদাসের বর্ননায় আসে পুরাণকথা। মহাকাল শিব, যিনি ধ্বংসের দেবতা, তিনি গজাসুরকে বধ করে তার চামড়াটি পরিধান করেন, যা তাঁর শক্তি ও পরাক্রমের প্রতীক। প্রতিবার ভস্ম আরতির পর শিব এই পরিধানে নৃত্য শুরু করেন, থামেন নিজে শান্ত হলে। মেঘ যদি সামান্য বর্ষণ শুরু করে তাহলে শূলপাণী সহজে শান্ত হতে পারেন এটাই ছিল কালিদাসের প্রার্থনা।
মেঘ আরও খানিক গেলে গম্ভীরা নদী দেখতে পাবে। গম্ভীরা নদী, যা উটাঙ্গন নদী নামেও পরিচিত, ভারতের একটি বর্ষাজলপুষ্ট নদী যা রাজস্থান রাজ্যে উৎপন্ন হয় এবং উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের জালালপুরের কাছে যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়। দু’হাজার বছর আগের বর্ণনা আজও মিলে যাচ্ছে খুব সহজেই।
মেঘ চলবে দেবগিরির পথে। অতীতে এটি দেবসেনাপতি কার্তিকের অবস্থান হলেও বর্তমানে এটি দৌলতাবাদ। অজন্তা, ইলোরা হয়ে দৌলতবাদ দুর্গ সব ভ্রমণপিয়াসীর প্রিয়। মেঘের পথে এসেছে চর্ম্মন্বতী বা চম্বল নদীর দৃশ্যপট। চম্বল পেরিয়ে আরও উত্তরে গেলে প্রাচীন বাণিজ্য নগরী দশপুরের উল্লেখ রয়েছে লেখায়। নাসিক শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে, দশপুর কেবল একটি সমৃদ্ধ ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহরই নয়, বরং একটি ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিল। গোবিন্দগুপ্তের শিলালিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দত্তভট্ট এখানে একটি স্তূপ এবং একটি বিহার নির্মাণ করেছিলেন।
মেঘ এবার পৌঁছে যাবে সরস্বতী ও দৃশদ্বতী নদীর মধ্যবর্তী দেশ ব্রহ্মাবর্ত অঞ্চলে। এই অঞ্চল হল কুরুক্ষেত্র অঞ্চল। এখন থেকে মেঘের গতি হলে হরিদ্বার অভিমুখে। বর্ণনায় কঙ্খল, ব্রহ্মকুণ্ড গঙ্গার ফেনিল জলরাশি বর্তমান হরিদ্বারের অন্যতম আকর্ষণ। অলকাপুরী যেতে হলে অর্থাৎ হিমালয়ের ছোঁয়া পেতে গেলে হরিদ্বার তো আসতেই হবে। হরিদ্বার থেকে হিমালয়ের শিখর পেরিয়ে তিব্বতে কৈলাস পর্বত আর মানস সরোবর। মেঘ তার গন্তব্যে পৌঁছে গেছে—কৈলাস পর্বতের কোলেই অলকাপুরী।
উত্তর মেঘ
উত্তর মেঘ অংশে রয়েছে অলকাপুরীর বর্ণনা, নির্বাসিত যক্ষের মনসচক্ষে প্রিয়ার রূপ বর্ণনা, কাব্যের রস, নানা উপমা ইত্যাদি।
আরও পড়ুন-২১ জুলাই মহাসমাবেশ: প্রস্তুতি বৈঠক তৃণমূলের, তৈরি বাংলা
পথচলা এক অনন্ত বিরহ
এই প্রাচীন কাব্যগ্রন্থের পরতে পরতে রয়েছে এক আদ্যন্ত ভ্রমণকাহিনি। এক অখণ্ড ভারতের রূপরেখা। কালিদাসের দেশ উজ্জয়িনী থেকে মানস সরোবর পর্যন্ত ভ্রমণের দু’হাজার বছর প্রাচীন প্রি-গুগল ম্যাপ। থেকে হিমালয় পর্যন্ত প্রাচীন ভারতের এক খণ্ড কিন্তু অনন্য চিত্রে সমুজ্জ্বল এই ক্ষুদ্র গীতিকাব্য। কেতকীবেষ্টিত উপবন, পাখিদের নীড়, গ্রামচৈত্য, উজ্জয়িনী, অবন্তী, বিদিশা প্রভৃতি নগর, বিন্ধ্যা, কৈলাস, দেবগিরি প্রভৃতি পর্বত এবং রেবা, শিপ্রা, বেত্রবতী ইত্যাদি নদী, সুপ্ত নগরসৌধ, পরিত্যক্ত রাজপথ, হর্ম্যবাতায়ন থেকে ভেসে আসা পুরবধূদের কেশ সংস্কারধূপের ঘ্রাণ— সব মিলিয়ে অতীত, অবলুপ্ত ভারতের এক সজীব চিত্র। কাব্যে ধ্বনিত হয়েছে সর্বকালের মানুষের অতলস্পর্শ বিরহ। এক অর্থে প্রতিটি মানুষই নির্বাসিত, বিরহী যক্ষ। ‘মানুষেরা এক-একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো, পরস্পরের মধ্যে অপরিমেয় অশ্রুলবণাক্ত সমুদ্র’।
বিরহ ছুঁয়ে যায় বারে বারে
রামগিরি পর্বত শিখরের বিরহী যক্ষের আকুলতা দু’হাজার বছর পরেও ছুঁয়ে যায় সেই মানব ঠাকুর কবিকে। প্রশ্ন তুলেছেন কেন প্রেমের মধ্যে আসে বিরহের যন্ত্রণা।
‘কেন প্রেম আপনার নাহি পায় পথ?
সশরীরে কোন্ নর গেছে সেইখানে,
মানসসরসীতীরে বিরহশয়ানে,
রবিহীন মণিদীপ্ত প্রদোষের দেশে
জগতের নদী গিরি সকলের শেষে।’
কবিমনে প্রভাব ফেলেছে এই প্রেমের বাধা। লেখনীতে তাই বারবার ঘটেছে বেদনার প্রকাশ। কখনও এই বিচ্ছেদের বেদনা ছড়িয়ে পড়েছে কমলিকার মনে, অরুণেশ্বরের গান্ধর্বীকলার নৃত্যে।
কখনও সময়ের সঙ্গে রামগিরি পাহাড় হয়ে গেছে শিলং শহর। মেঘদূতের ছোঁয়ায় লেখা হয় অনন্ত প্রেমকথা। সেখানে প্রিয়ার কানে কানে প্রেমিক বলেন ‘for god’s seek, hold your tongue and let me love’ আর প্রিয়া শোনে— দোহাই তোদের এতটুকু চুপ কর ভালোবাসিবারে মোরে দে অবসর। বৈষ্ণব পদাবলীর রাধাবিরহের মতো এক সীমাহীন হাহাকারের মধ্যে শেষ হয় এক শেষের কবিতা।
মনখারাপের দিস্তা
কালিদাসের ‘মেঘদূত’ বিরহী যক্ষের মনের ব্যথা। মনকষ্টে সে জড় মেঘকে জীবন্ত প্রাণী মনে করে তার প্রিয়ার কাছে দূত করে পাঠাতে চায়। মেঘদূত কালিদাসের উপমার রসসিক্ত এক প্রেমকাব্য। মেঘদূত ভ্রমণবিলাসীর কাছে উজ্জয়িনী থেকে কৈলাসযাত্রার বিস্তারিত তথ্য। মেঘদূতম মহাকবি কালিদাসের অমর সৃষ্টি।
শুধু আষাঢ়ের প্রথম দিনটিতে নয়, মেঘদূত মনে পড়ে প্রতি বর্ষায়, প্রতিটি ভ্রমণে প্রতিটি বিরহে। অনেক মানুষ হয়তো নামটুকু ছাড়া সেভাবে জানেনই না মেঘদূত। শুধু কাব্যের দ্বিতীয় পঙ্ক্তির শুরুটুকু ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’ অমর হয়ে গেছে কোনওভাবে।