বাংলাকে পর্যুদস্ত করা অতই সহজ!

বাংলা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্রতাও বিজেপি-বিদ্বেষের অন্যতম কারণ। আমিষ, মুখ্যত মাছ সহযোগে আমিষ খাবার বাঙালির শুধুমাত্র খাবারের বিষয় নয়। লিখছেন সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক প্রিয়ঙ্কর দাস

Must read

বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশের দিকে ছুটে যাচ্ছে বছর চব্বিশের এক যুবক, তাঁর পিছনে তাক করা আছে বিএসএফের রাইফেল। বাংলাদেশমুখী দৌড়ের অন্যথা হলে কড়া হুঁশিয়ারি আছে গুলি খাওয়ার। যুবকের নাম আমির শেখ, মালদহের কালিয়াচকের বাসিন্দা। সাথে আছে ভারতের মাটিতে জন্মের শংসাপত্র ও আধার কার্ড। এই নির্লজ্জ ঘটনাটি ঘটার তিন মাস আগে রাজস্থানের প্রতাপনগরে নির্মাণ শ্রমিকের কাজে যান আমির, সেখানে বাংলাদেশি সন্দেহে রাজস্থান পুলিশ তাঁকে আটক করে বিনা বিচারে জেলে দু-মাস আটকে রাখে, বেদম প্রহারও চলে। অবশেষে রাজস্থান থেকে বিমানে কলকাতায় নিয়ে এসে গাড়িতে করে বেনাপোল সীমান্তে নিয়ে যাওয়া, তারপরই সেই শিহরন জাগানো নির্দেশ, ‘এবার সোজা দৌড়ো, না হলে গুলি খাবি!’ এ দৌড়ের ব্যবধানের মধ্যে আছে নিজভূমে পরবাসী হয়ে যাওয়া, আছে বিজেপির খেয়াল খুশিমতো ভারতীয় ও ভারতীয়ত্বের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেওয়া। দীর্ঘ কুড়ি দিন বাংলাদেশের সাতক্ষীরার জেলে থাকার পর অবশেষে বসিরহাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে ফেরে আমির।
এই করুণ বাস্তব প্রতিচ্ছবি কেবল রাজস্থানে কাজ করতে যাওয়া বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকের ক্ষেত্রে নয়, দিল্লি, মহারাষ্ট্র, গুজরাত-সহ সমস্ত বিজেপি-শাসিত রাজ্যেই বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের সাথে চলছে বিনা কারণে যথেচ্ছ ধরপাকড় ও পুলিশি অত্যাচার। এখানেই থেমে থাকেনি ভারতীয় জনতা পার্টি, ধরপাকড়কে আইনি রক্ষাকবচ দিতে তারা বলবৎ করেছে অভিবাসন ও বিদেশি আইন। এই আইনে স্রেফ সন্দেহের বশে কাউকে গ্রেফতার করার অধিকার দেওয়া হয়েছে পুলিশকে এবং পদমর্যাদা— যিনি হেড কনস্টেবল হলেই চলবে। প্রশ্ন এসে যায় আইন পাশের আগেই যেখানে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর যথেচ্ছ অত্যাচার হয়েছে স্রেফ সন্দেহের বশে, সেখানে আইনি সুরক্ষা এনে বৈধতা প্রদান করা হলে সেই সন্দেহের তীব্রতা কতখানি বৃদ্ধি পাবে! ভারতীয় জনতা পার্টির এই বাংলা ও বাঙালিদের প্রতি সন্দেহের ও বিদ্বেষের কারণগুলোকে গভীরে তলিয়ে দেখা খুব প্রয়োজন।

আরও পড়ুন-পেট্রোল-ডিজেল নয়, চলবে ব্যাটারিতে, থ্রি হুইলার-এর উদ্বোধন একলাখি গাড়ির ঘোষণা

বিজেপি কেন বাংলা ও বাঙালি বিদ্বেষী?
বিজেপির মতাদর্শগত ভিত্তি হিন্দুত্বের উপর ভর দিয়ে রয়েছে, বিজেপির মডেলটিকে এককথায় ‘হিন্দি-হিন্দু- হিন্দুস্তান’ মডেল বলা যায়। এই মডেল উত্তর ভারতীয় হিন্দি ভাষাকে জাতীয় রাষ্ট্রের অন্যতম মানদণ্ড বলে মনে করে। এই ভিত্তির রসদের উৎস সংগ্রহ করতে গেলে বিনায়ক দামোদর সাভারকারের হিন্দুত্ব : ‘হু ইজ এ হিন্দু’ গ্রন্থটির কথা বলতে হয় যেখানে হিন্দি ভাষাকে ভারতের ন্যাচারাল লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে। এই একরৈখিক মতাদর্শের চাষ যাঁরা বর্তমানে করছেন তাঁরা যে বাংলা ভাষাবিদ্বেষী হবেন সেটাই তো স্বাভাবিক!
বাংলার রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে যদি আতশকাঁচের তলায় এনে দেখা যায় তাহলে একটা বিষয়ে পরিষ্কার হবে যে, বাংলার রাজনীতির প্যাটার্ন তার নিজস্বতা রেখেছে স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও। যে নিজস্বতার মধ্যে কেন্দ্রীয় রাজনীতির শিখিয়ে পরিয়ে দেওয়া প্রায় নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতি কিন্তু এই ধারার উজ্জ্বল ফসল, সেখানেই ভারতীয় জনতা পার্টির আক্রোশ। তাঁরা বাংলার রাজনীতিকে কেন্দ্রীয় সর্বস্ব ছকে গড়ে তুলতে চেয়েছিল, কিন্তু প্রতি সময়েই ব্যর্থ হয়েছেন।
বাংলা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্রতাও বিজেপির বিদ্বেষের অন্যতম কারণ। আমিষ খাবার, মুখ্যত মাছ সহযোগে আমিষ খাবার বাঙালির শুধুমাত্র খাবারের বিষয় নয়। মাছ বাঙালির সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, বিভিন্ন সময়ে বাঙালি নিজস্ব খাদ্যের উপর বিজেপির নেতা মন্ত্রীদের ব্যঞ্জনাযুক্ত ও অবমাননাকর মন্তব্যগুলো বাঙালির অস্মিতাকে ধাক্কা দেয়। ২০২২ সালে বিজেপির এমপি থাকাকালীন অভিনেতা পরেশ রাওয়ালের মন্তব্য ছিল, ‘যদি বাঙালি রোহিঙ্গারা আপনাদের সঙ্গে এসে থাকতে শুরু করে, তাহলে গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে কী করবেন? বাঙালিদের জন্য মাছ রান্না করবেন?’ প্রকৃত অর্থে উত্তর ভারতের উচ্চজাতের মানুষের সমাহার কেন্দ্রিক দল বিজেপি জাতিবাদের বেশিরভাগ নিয়মের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত হওয়া বাঙালিদের সাংস্কৃতিক বৈরিতার চোখে দেখে।
ধর্মীয় সমন্বয় বনাম গোঁড়া হিন্দুত্ববাদ, বাঙালি বনাম বিজেপির বিভাজিকাকে স্পষ্টতর করে। বাঙালির ধর্মীয় চেতনায় বাউল, সুফিবাদ, ভক্তিবাদের  প্রবাহ এবং বিভিন্ন মনীষীদের আগমনে হিন্দু মুসলমানের বিভাজন অনেক ফিকে হয়ে গিয়েছে। ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় আচারেও সমন্বয়ের এক সুন্দর রূপ দেখতে পাওয়া যায় বাংলায়। সাভারকারের হিন্দুত্ববাদে ভারতবর্ষের মাটিকে তাদের জন্যই সংরক্ষণ করার কথা বলা হয়েছে যাদের ‘পিতৃভূমি’ ও ‘পুণ্যভূমি’ উভয়ই ভারতবর্ষের ভূমি। এই সংরক্ষণ মুসলমান ও খ্রিস্টানদের বহিরাগত করে দেয়। বাঙালি সংস্কৃতি যেখানে সংযোজনে বিশ্বাস রাখে, সেখানে বিজেপির মতাদর্শ বিয়োজনে আস্থাশীল।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

বাঙালি জাতিসত্তার বিরুদ্ধে এই আক্রমণের মুহূর্তে আমরা কোথায় আশ্রয় পাব? উত্তর একটাই— বাঙালি জাতিসত্তার আশ্রয় প্রদানকারী হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লির আজাদ হিন্দ কলোনিতে প্রথম যখন বাঙালি শ্রমিকদের পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করা হচ্ছিল তখন রাজ্যসভা ও লোকসভার আধ ডজন এমপিদের পাঠিয়ে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন বাঙালি পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানোর। সারা দেশের মধ্যে প্রথম পশ্চিমবাংলায় চালু হয়েছিল পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ উন্নয়ন পর্ষদ যা মমতা বন্দোপাধ্যায়ের মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল এবং সেই পর্ষদের চেয়ারম্যান তথা রাজ্যসভার এমপি সামিরুল ইসলাম বিজেপি-শাসিত রাজ্যে যেখানে পরিযায়ী শ্রমিকেরা হিংস্রতার শিকার হচ্ছেন সেখানে ছুটে যাচ্ছেন এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের আইনি সহায়তা করা হচ্ছে পর্ষদের তরফ থেকে। ভিনরাজ্যে বিজেপি-শাসিত পুলিশের হাতে নিপীড়িত হওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার চালু করেছে শ্রমশ্রী প্রকল্প, যা ২২ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান করবে। বাঙালি অস্মিতার বিরুদ্ধে লেলিহান শিখা জ্বেলেছে বিজেপি। তার বিরুদ্ধে আমরা দেখেছি আবেগময় অথচ কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অঝোর বৃষ্টিধারার মধ্যেও মুখ্যমন্ত্রী হেঁটেছেন কলকাতার রাজপথে। সেদিন প্রতিটি নিষ্প্রাণ বৃষ্টিকণাও বুঝেছিল বাঙালির গরিমাকে বাঁচিয়ে রাখার যদি কোনও নিশ্চিন্ত ঠিকানা থাকে তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Latest article