ঘরে আসেন প্রবাসীরা
দুর্গাপুজো হয় হাওড়ার বাউড়িয়া অঞ্চলে। হাতেগোনা কয়েকটি। কালীপুজোও হয়। তুলনায় একটু বেশিই। সেইসঙ্গে হয় অন্যান্য পুজোও। তবে সবথেকে বেশি হয় জগদ্ধাত্রী পুজো। একশোর মতো। বাড়ির পুজো যেমন আছে, তেমন আছে ক্লাব এবং সার্বজনীন পুজো। ছোট্ট অঞ্চলে এতগুলো জগদ্ধাত্রী পুজো (Jagadhatri Puja), কম কথা নয়!
জাতীয় সড়কের পাশেই পাঁচলা মোড়। সেখান থেকে একটি পাকা রাস্তা চলে গেছে বাউড়িয়া স্টেশনের দিকে। রাস্তার দু-ধারে হয় বেশকিছু জগদ্ধাত্রী পুজো। পাশাপাশি জগদ্ধাত্রী পুজো হয় বাসুদেবপুর, বেলকুলাই, রঘুদেবপুর, সন্তোষপুর, বুড়িখালি, বৌলখালি, বেনেখালি প্রভৃতি গ্রামের ভিতরেও। গঙ্গানদী তীরবর্তী কল-কারখানা এলাকাতেও হয় কয়েকটি পুজো। জগদ্ধাত্রী পুজো উপলক্ষে এইসময় নতুন সাজে সেজে ওঠে বাউড়িয়া। মূলত নবমী-দশমীর দিন। ঘরে আসেন প্রবাসীরা। অনেকেই কেনেন নতুন জামাকাপড়।
চোখে পড়ে দীর্ঘ লাইন
একটা সময় ছিল শুধুই সাবেক পুজো। কয়েক বছরে কিছু পুজোয় লেগেছে থিমের ছোঁয়া। কম বাজেটের পুজো যেমন আছে, তেমন আছে বড় বাজেটের পুজো। আকর্ষণীয় প্রতিমা, চোখ ধাঁধানো মণ্ডপ, আলোকসজ্জা দেখার জন্য ঢল নামে দর্শনার্থীদের। স্থানীয় মানুষজনেরা তো বটেই, জগদ্ধাত্রী পুজো দেখার টানে ছুটে আসেন দূর-দূরান্তের বহু মানুষ। দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথে বাউড়িয়া স্টেশনে নেমে রাতভর ঠাকুর দেখেন। কোনও কোনও মণ্ডপের সামনে চোখে পড়ে দীর্ঘ লাইন। মাইকে বাজে গান। খোলা থাকে দোকান, খাবারের স্টল। রীতিমতো জমজমাট।
বর্তমানে প্রধান উৎসব
স্থানীয় বাসিন্দা দীপক জানার সঙ্গে কথা হল। তিনি বললেন, ‘একটা সময় বাসুদেবপুর গ্রামে কয়েকটি জগদ্ধাত্রী পুজো হত। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে আশেপাশের এলাকায়।’ আরও এক স্থানীয় বাসিন্দা অনিমেষ সামন্ত জানালেন, ‘বর্তমানে জগদ্ধাত্রী পুজোই (Jagadhatri Puja) এখানকার প্রধান উৎসব।’
জোরকদমে চলছে পুজো-প্রস্তুতি। তৈরি হচ্ছে প্রতিমা। বাঁধা হচ্ছে মণ্ডপ। কয়েকটি পুজো সম্পর্কে খোঁজ নিলাম।
পায়ে পায়ে বাসুদেবপুর
বাউড়িয়ার বাসুদেবপুরের সবচেয়ে প্রাচীন পুজোটি হল আদিতলার। এবার ১৯৫ বছরে পা রেখেছে। মণ্ডপে শোভা পাবে সাবেক প্রতিমা। নিয়ম মেনে হয় পুজো। বহু মানুষ আসেন। প্রামাণিক পাড়ার পুজোটিও বেশ প্রাচীন। জানা যায়, বিপ্লবীরা উদ্যোগ নিয়ে শুরু করেছিলেন।
বাসুদেবপুর দাসপাড়া জগদ্ধাত্রী পুজো কমিটির পুজোর এবার ৫৫তম বছর। কমিটির সদস্য অনিয়েক চক্রবর্তী জানালেন, ‘মণ্ডপটি তৈরি হচ্ছে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাওড়ার পানিত্রাসের বসতবাটির আদলে। থাকছে সৃজনশীল অনুষ্ঠান। আশা করি এবারও ভিড় হবে।’
বাসুদেবপুর নাথপাড়ার জগদ্ধাত্রী পুজোর এবার ৮৪তম বছর। শোভা পাবে সাবেক প্রতিমা। বাসুদেবপুর তরুণ সমিতির পুজোও দেখার মতো। এখানকার পাড়ুই বাড়ির পুজো ৩৩তম বছরে পা রেখেছে। পরিবারের পক্ষ থেকে কিছু মানুষদের হাতে তুলে দেওয়া হবে উপহার সামগ্রী। নবোদয় ক্লাবের পুজো হয় আগুনখালি শ্মশান মাঠে। এলাকার অন্যতম নামী পুজো। বসে মেলা। জমে ভিড়। বাসুদেবপুর কেএনপিসি হাই স্কুলের মাঠেও জগদ্ধাত্রী পুজো উপলক্ষে মেলা বসে।
জমজমাট বুড়িখালি
বুড়িখালি অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পুজো দিশারী ক্লাবের পুজো। সাবেক প্রতিমা প্রধান আকর্ষণ। সম্পাদক দীপক ঘোষ জানালেন, ‘এবার পুজোর ৪৮তম বছর। নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো হয়। সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত।’
বাউড়িয়া স্টেশন শান্তি সমন্বয় কমিটি ও বান্ধব সমিতির পুজোও আয়োজিত হয় সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত। এই দুটি মণ্ডপেও দেখা যাবে সাবেক প্রতিমা।
বুড়িখালির অন্যতম নামী পুজো জনকল্যাণ প্রতিষ্ঠান ও ব্যায়ামাগারের পুজো। এবার ৩৮ বছর। শুভাশিস সামন্ত জানালেন, ‘আমাদের পুজোর থিম মুক্ত বিহঙ্গ। থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বসবে মেলা। এবারও নামবে জনজোয়ার।’
বুড়িখালি হাইস্কুল সংলগ্ন বিবর্তন ক্লাবের পুজোও বেশ পুরোনো। শুভেন্দু সামন্ত জানালেন, ‘আমাদের এবারের প্রতিমার রূপদান করছেন গোপাল পাল। পুজো উপলক্ষে অন্যান্য বছরের মতো এবারও প্রসাদ বিতরণ করা হবে।’
বুড়িখালির মুক্তি সংঘ, প্রাপ্তি সংঘ, বিবেকানন্দ পল্লির জগদ্ধাত্রী পুজো (Jagadhatri Puja) দেখার জন্যও নামে মানুষের ঢল।
আরও পড়ুন- অপ্রতিরোধ্য সেনানায়ক
বৌলখালির দিকে
বাউড়িয়া স্টেশন থেকে বৌলখালি পর্যন্ত এলাকায় সাড়ম্বরে আয়োজিত হয় বেশকিছু জগদ্ধাত্রী পুজো। ২৮ বছরে পা রেখেছে অমর সংঘের পুজো। দেবজ্যোতি ঘোষ জানালেন, ‘সপ্তমী থেকে দশমী, আমরা জগদ্ধাত্রীর আরাধনা করি। প্রতিদিন লোক সমাগম হয় ভালই।’
বেনেখালি স্থানীয় যুবকবৃন্দের জগদ্ধাত্রী পুজোর এবার ৩৩ বছর। আদিত্যনারায়ণ ঘোষ জানালেন, ‘আমাদের মণ্ডপটি দেখার মতো হচ্ছে। শোভা পাবে অঠেরো ফুটের সাবেক প্রতিমা।’
উজ্জ্বল সংঘের পুজো আয়োজিত হয় সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত। দর্শনার্থীদের ভিড় দেখা যায়। এ ছাড়াও বুড়িখালি শীতলাতলা, মঙ্গলদীপ, সমাজ কল্যাণ সমিতি, থ্রি স্টার নাট্যগোষ্ঠী, ঝংকার, বাউড়িয়া শিশু উদ্যান, বৌলখালি আগ্রহী সংঘের পুজো মণ্ডপেও উপচে পড়ে ভিড়। কবিগুরু আপন সংঘ জগদ্ধাত্রী পুজো উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারও আকর্ষণীয় আতশবাজি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে।
দ্বিতীয় চন্দননগর
জগদ্ধাত্রী পুজো ঘিরে এইরকম উন্মাদনা চন্দননগর ছাড়া সম্ভবত আর কোথাও দেখা যায় না। সেই কারণেই বাউড়িয়াকে বলা হয় ‘দ্বিতীয় চন্দননগর’। পুজোয় দিনে সপরিবারে ঘুরে আসতে পারেন। হালকা শীতের আমেজ মেখে এক মণ্ডপ থেকে আরেক মণ্ডপে এগিয়ে যেতে ভালই লাগবে।