গণিত হোক বা দর্শন, প্রতীক বিনা চিন্তার প্রগতি অসম্ভব। জগন্নাথ-ভাবনাতেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। আপাতভাবে তা অনুভূত না হলেও, অনুসন্ধানী প্রজ্ঞার কাছে এই অনুভব সদা অনাবৃত। কিংবদন্তির কন্দরে, পুরাণ কথার পরানে, জগতের নাথ জগন্নাথের প্রতীকী তাৎপর্য সংশ্রিত নিঃসংশয়ী প্রত্যয়ে। শুধু তাকে খুঁজে নিতে হয়, চিনে নিতে হয়, বুঝে নিয়ে জড়িয়ে ধরতে হয়।
জগন্নাথ বিগ্রহ নির্মাণের জন্য কাঠ ভেসে এসেছে সমুদ্রে। সাগরের বুকে ভাসমান কাঠের গুঁড়ি ভাসতে ভাসতে পুরীর সৈকতে এসে ঠেকেছে। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে সে সংবাদ পৌঁছে দিলেন রাজভৃত্যরা। সমুদ্র মানে অন্তহীন জলরাশি, যা যুগপৎ অস্তিত্ববাহী এবং অনস্তিত্বের দ্যোতক। ঋকবেদের সূক্ত যেমনটা বলেছে, এ তেমনই। ‘নাসাদাসিস নঃ সদাসিৎ তদানীম নাসিদ রজ ন ব্যামাপ্রো’। কাঠের গুঁড়ি ভাসতে ভাসতে সমুদ্রের কূলে এসে পৌঁছাল। অতলের বুকে ভাসতে ভাসতে সমতল ছুঁল। নিরাকার ব্রহ্মর সাকার রূপ নির্মাণের উপকরণ হয়ে উঠল।
আরও পড়ুন-পেনাল্টি পাইনি, ফুঁসছে জার্মানি
বস্তুটা ছিল কাঠের গুঁড়ি। শিকড় ও শাখাছাড়া, আদি ও অন্ত বর্জিত, মূল ও বিস্তারহীন, একটা গুঁড়ি মাত্র। ঠিক পরম আত্মার মতো। যাঁর উদ্ভবের বৃত্তান্ত ও পরিণত প্রকাশ, দুই-ই আত্মার মতো অব্যক্ত। সেই আত্মাস্বরূপ গুঁড়িটাকে দেহরূপ বিগ্রহে পরিণত করতে চাইলেন ইন্দ্রদ্যুম্ন। কাঠের গুঁড়ির প্রতীকী তাৎপর্যে বুঝিয়ে দেওয়া হল যা তৈরি হতে চলেছে, তা আসলে কী। সেটা অবশ্যই মানবের আত্মা।
প্রথম পর্যায়ে কাঠের গুঁড়ির আবির্ভাব যদি রহস্যে আকীর্ণ হয়, তবে শেষে শিল্পীর উধাও হয়ে যাওয়াটাও কম রহস্যপূর্ণ ঘটনা নয়। এবং এই ঘটনা উপনিষদে ও পুরাণে কথিত সৃষ্টিতত্ত্বের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ।
ব্রহ্মকে জানলে জ্ঞাতা ব্রহ্ম হয়ে যান। তাহলে যিনি ব্রহ্মকে রূপদান করছেন, সেই শিল্পীও কর্মসূত্রে ব্রহ্মকে পুরোপুরি জেনে ফেলেছেন। এই কর্মপ্রয়াসের সূত্রেই হয়ে উঠছেন ব্রহ্মজ্ঞ । ফলে, যেখানে চক্ষু বাক্য মন যেতে পারে না, যে অবস্থায় তাকে না পেয়ে মন সহ বাক্য আসে ফিরে, ব্রহ্মর সেই বসতভূমেই অনিবার্যভাবে চলে যান ব্রহ্মজ্ঞ কারিগর। এমন এক জগতে ফিরে যাওয়াটা জগন্নাথ-শিল্পীর অনিবার্য নিয়তি। জগন্নাথের কারিগর যিনি, সেই অনন্ত মহারাণাকে মূর্তি নির্মাণের পর আর দেখতে পাওয়া যায় না। যাবে কী করে? ব্রহ্ম তো সৃষ্টিতেই মিশে যান। সৃষ্টিকার্য সম্পন্ন হওয়ার পর অদৃশ্য হওয়াটাই তো তাঁর স্বাভাবিক পরিণতি। জগন্নাথের দারুমূর্তি নির্মাণের পর অনন্ত মহারাণার উধাও হয়ে যাওয়াটা আসলে সৃষ্টি রহস্যের সঙ্গে সামজ্ঞস্যপূর্ণ।
‘দেউল তোলা’ কাব্যে ওড়িয়া কবি শিশুকৃষ্ণ দাস শুনিয়েছেন গুণ্ডিচারানির কৌতূহলের কাহিনি। সেই কাহিনিই জনমানসে স্থায়ী আসন লাভ করেছে।
আরও পড়ুন-এক বছরে ২০ জনের মৃত্যু, কেন্দ্রের অপরিকল্পিত প্রকল্পের জের, ফের অগ্নিবীরের আত্মহত্যা
তদনুসারে, অনন্ত মহারাণা একটা ঘরে দরজা জানালা বন্ধ করে কাজ শুরু করেছিলেন। কথা ছিল, একুশ দিন ধরে একমনে কাজ করবেন । কেউ তাঁকে বিরক্ত করবে না। এদিকে বদ্ধ ঘর থেকে কোনও শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন না রাজার স্ত্রী গুণ্ডিচা। প্রবল কৌতূহলের রানি গুণ্ডিচা নির্ধারিত একুশ দিনের আগে পনেরোতম দিনেই মন্দিরের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লেন সেখানে। সম্মুখে প্রকাশিত হলেন অসম্পূর্ণ জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রার মূর্তি। ভাস্কর অনন্ত মহারাণাকে সেই ঘরে পাওয়া গেল না। গুণ্ডিচা দেখলেন, অসম্পূর্ণ জগন্নাথ মূর্তি।
“দেউলতোলা”তে এই কাহিনি থাকলেও স্কন্দ পুরাণের ‘উৎকল খণ্ড’-এ এই কাহিনি উল্লিখিত হয়নি।
হয়নি, কারণ জগন্নাথের অসম্পূর্ণ মূর্তি কোনও আকস্মিক ঘটনার পরিণতি নয়। নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসরণ করেই এই মূর্তির অসম্পূর্ণতা নিশ্চিত করা হয়েছিল।
কেন জগন্নাথ মহাপ্রভুর শ্রীবিগ্রহ অসম্পূর্ণ? এর কারণ মূলত দুটি।
এক, জগতে সৃষ্টিপ্রবাহ তো এখনও সম্পূর্ণতা অর্জন করেনি। জগৎ তো এখনও অসম্পূর্ণ। নিরন্তর সৃষ্টিপ্রবাহ যেখানে অন্তে পৌঁছায়নি, সেখানে জগতের নাথ সম্পূর্ণ হয়ে পূর্ণতা অর্জন করবেন কী করে? তাঁর রূপই তো সৃষ্টির অবয়ব। সেজন্যই জগৎপতি জগন্নাথ বিরাট, কিন্তু অসম্পূর্ণ। ঠিক যেমন সৃষ্টি বিশাল, কিন্তু অপূর্ণাঙ্গ।
দুই, পুরুষোত্তম যিনি, তিনি তো লিঙ্গ নিরপেক্ষ। তিনি ‘ন স্ত্রী, ন পুমান’, তিনি স্ত্রী কিংবা পুরুষ এমনকী ক্লীবও নন। তাই, তাই-ই, জগন্নাথদেবের শ্রীমূর্তিতে কোনও লিঙ্গ-লক্ষণ নেই। অ্যানথ্রোপোমরফিক (anthropomorphic) বা নরত্ব-আরোপমূলক কোনও মূর্তি লিঙ্গ বাদ দিয়ে নির্মিত হতে পারে না। কিন্তু যিনি পুরুষোত্তম, যাঁকে স্ত্রী-পুরুষের নির্দিষ্ট লক্ষণ দিয়ে সীমায়িত করা যায় না, তাঁর শ্রীমূর্তিতে তো নারী কিংবা পুরুষের কোনও লক্ষণ থাকতে পারে না। এই লিঙ্গ নিরপেক্ষতার কারণেই জগন্নাথদেবকে কৃষ্ণ বাসুদেব বলে যেমন পূজা করা চলে তেমনই তিনি দক্ষিণা কালী রূপেও পূজিত হতে পারেন। আর সেটা যাতে সম্ভবায়িত হয়, সেজন্যই শ্রীমূর্তিকে অসম্পূর্ণ রাখা হয়েছে। অনন্ত মহারাণা বা বৃদ্ধ বার্দ্ধকি তাঁর পূর্ণ শরীর নির্মাণ করেননি। পূর্ণাঙ্গ দেবমূর্তি তৈরি হলেই সেটিতে পুরুষাত্মক শরীরী বৈশিষ্ট্য বা দেবী সুলভ অঙ্গ জুড়তে হত।
আরও পড়ুন-এক বছরে ২০ জনের মৃত্যু, কেন্দ্রের অপরিকল্পিত প্রকল্পের জের, ফের অগ্নিবীরের আত্মহত্যা
এই দুই অনুভবেই জগন্নাথদেবের শ্রীবিগ্রহে অসম্পূর্ণতার আঙ্গিক আরোপিত। কোনও রানির আচমকা আগমনে মূর্তি তৈরি প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হওয়ার কারণে যে এমনটা ঘটেছে, এই লোকবিশ্বাস পুরাণ সমর্থন করে না।
ঋকবেদের দশম মণ্ডলের ৯০ সংখ্যক সূক্ত হল পুরুষ সূক্ত। এই সূক্তে পরম পুরুষ বা পুরুষোত্তমকে পরম সত্তা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই পরম সত্তা অদ্বৈত সত্তা, ব্রহ্মণ্ডের আধ্যাত্মিক একত্ব তাতে বিম্বিত, এমনটাই ঘোষিত হয়েছে। সেই বৈদিক পুরুষই হলেন জগন্নাথ। সুতরাং, পরম পুরুষের প্রতীক হিসেবে একা জগন্নাথই যথেষ্ট, তাঁর সঙ্গে অন্য কোনও বিগ্রহের অবস্থান অনাবশ্যক।
এজন্যই পদ্মশ্রী চন্দ্রশেখর রথের মতো অনেক পণ্ডিতই মনে করেন, পুরীতে প্রথমে জগন্নাথদেবের শ্রীবিগ্রহই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায় তাদের উপাস্যদেবতাকে জগন্নাথের পাশে, রত্নবেদীতে বসিয়েছে। অনুমিত হয়, শৈবরা এনেছেন বলভদ্রকে। কারণ, বলরাম অনন্ত এবং শিবের প্রতিভূ। একইভাবে বৈষ্ণবরা কৃষ্ণ বাসুদেবের বৈমাত্রেয় ভাই বলরামের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে তাঁর বোন সুভদ্রাকে। বজ্রযানী বৌদ্ধদের সৌজন্যে জগন্নাথ তন্ত্রের ভৈরবের মর্যাদা পেয়েছেন আর বলরামের শক্তিস্বরূপা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন সুভদ্রা। সুদর্শনও এভাবেই মন্দিরের বেদিতে জায়গা করে নিয়েছেন। লক্ষণীয়, জগন্নাথ, সুভদ্রা ও সুদর্শন ছাড়াও আরও তিনটি দেবদেবীর মূর্তি ওই বেদিতে পূজা পান। তাঁরা হলেন শ্রীদেবী, ভূদেবী এবং মাধব। এঁরাও নিজ নিজ উপাসক গোষ্ঠীর সৌজন্যে ওখানে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
আসলে এসবের পেছনে আছে উৎকলের রাজবংশের ধর্ম পরিচয়। ভূমাকাররা বৌদ্ধ থেকে বৈষ্ণব হয়েছিলেন। সোমবংশীয় ও গঙ্গাবংশীয় রাজারা ছিলেন শৈব। প্রাচীনকালে এঁদের ধর্মবিশ্বাসের সূত্রেই অদ্বৈত পুরুষোত্তমের সঙ্গে বলভদ্র ও সুভদ্রা তাঁদের লোকবিশ্বাসে জড়িয়ে থাকা পরিচয় নিয়েই পূজা পেতে শুরু করেছেন।
জগন্নাথ নিঃসন্দেহে সাকার হয়েও নিরাকার। রূপ ধারণ সত্ত্বেও রূপাতীত। একেশ্বরবাদের গোঁড়ামি তছনছ করে দিয়ে সেই ‘সদ্বিপ্রা’ ‘বহুধা বদন্তি’। ভারতীয় সংস্কৃতির ‘বহুতে অন্তঃসলিলা এক’-এর বার্তা জগন্নাথের মূর্তিতে প্রতিবিম্বিত।
জয় জগন্নাথ।