‘তরী ডুবছে, আমি কিন্তু সূর্যোদয় দেখব’।
মৃত্যুর আগে লোকমাতা নিবেদিতার এটাই ছিল শেষ উচ্চারণ। ১৯১১ সালের ১৩ অক্টোবর শুক্রবার সকাল সাতটা নাগাদ সিস্টার নিবেদিতা শরীর ত্যাগ করলেন। শোকস্তব্ধ অবলা বসু স্মৃতিচারণ করেছিলেন ‘তাঁর শয্যা পাশে বসে আছি আমি, হৈমবতী উমার যে কাহিনী বলতেন, তা চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠলো।
দার্জিলিংয়ের রায় ভিলা। এখন এই বাড়িটি রামকৃষ্ণ মিশনের অধীনে। সিঁড়ি দিয়ে উঠলাম উপরে। এই সেই ঘর। জানালা দিয়ে দেখছি তাঁর ছবি। আর ভাবছি সেই দিনটার কথা।’ শেষের দিকে তাঁর যেন ছিল মৃত্যুর প্রতীক্ষা, মৃত্যুর প্রস্তুতি। জগদীশচন্দ্র সস্ত্রীক সেইসময় দার্জিলিংয়ে এসেছিলেন। বসু-দম্পতি তাঁকে বলতেন, তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। আর নিবেদিতা বলতেন, আমি জানি আমার শেষ সময় উপস্থিত। আমার এই সময়কে আর দীর্ঘায়িত কোরো না। হঠাৎ একদিন বেলুড় মঠ থেকে নিবেদিতার একান্ত স্নেহভাজন গনেন্দ্রনাথ দার্জিলিংয়ে এসে হাজির। সঙ্গে এনেছিলেন মঠের বাগান থেকে এক ঝুড়ি ফল। মঠের মহারাজরা পাঠিয়েছেন। বড় আনন্দ পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর গুরুর কাছ থেকে যেন বিদায়ের আগে প্রসাদ এসেছে। এই নিবেদিতা এক অসাধারণ চরিত্র। যে আয়ারল্যান্ড দুহিতা নিজেকে নিঃশেষ সঁপে দিয়েছিলেন ভারতভাগ্যবিধাতার কাছে। তাঁর জীবনে তো শুধু দেশত্যাগ করে ভারতকে গ্রহণ করার মতো ঘটনা হয়নি, আসলে ঘটেছিল এক রূপান্তর। রবীন্দ্রনাথ নিবেদিতাকে বলেছিলেন লোকমাতা। ঋষি অরবিন্দ নিবেদিতাকে বলেছিলেন শিখাময়ী। আর নিবেদিতা নিজেকে সকলের কাছে পরিচয় দিতেন, আমি হলাম রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-র নিবেদিতা। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-নিবেদিতা এ যেন শাশ্বত ভারতের আর একটা অবিচ্ছেদ্য তরঙ্গ।
আরও পড়ুন-কাটাকুটির ক্যাকটাস
আসলে নিবেদিতার জীবনে মা কালীকে গ্রহণ, তাঁকে নিয়ে ভাবা, তাঁকে নিয়ে বিশ্লেষণ সবকিছুই সেই সময়কার ভারতে যেন এক নতুন বিপ্লব এনে দিয়েছিল। তাঁর কালী দ্য মাদার (Kali the Mother) গ্রন্থে একের পর এক অধ্যায়ে তিনি দেখিয়েছেন তাঁর কালী সম্পর্কিত ধারণা। তাঁর কালী এক মৃত্যুর রূপ। কালী এক অন্ধকারের রূপ। সেই রূপ ধ্বংসের রূপ। সেই রূপ মৃত্যুর হলেও সেই রূপ বিষাদের রূপ নয়। নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক রূপ।’
‘কালী দ্য মাদার’ ( Kali the Mother) বইটি শুধু আধ্যাত্মিক নয়। এ যেন সেইসময়ের সমাজজীবনের বিপ্লবেরও রূপ। নিবেদিতার এই বইটি সেই সময়ে বিপ্লবীদের কাছে বিশেষভাবে এক মন্ত্রপুস্তক হয়ে ওঠে। অরবিন্দ ঘোষ তখন বাংলার মুখ্য বিপ্লবী নেতা। তিনি বইটির প্রভাবের কথা স্বীকার করেন। তিনি যখন বাংলায় বৈপ্লবিক কাজে লিপ্ত হননি তাঁর মানসিক প্রস্তুতি চলছিল তখনই তাঁর কাছে বইটি পৌঁছে গিয়েছিল। এই বইটি পড়ে তিনি উদ্দীপ্ত হন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘I was very much enamoured at the time of reading her book— Kali the mother’। অরবিন্দর কথায়, এটা শুধু উদ্দীপনাপূর্ণ বই নয়, এটা বিদ্রোহমূলক। এমনকী অহিংসও নয়।
আসলে কালীপুজোর এক উচ্চদার্শনিক এবং কাব্যিক বিশ্লেষণ তিনি করেছিলেন। আর প্রথম অধ্যায়ে দেখা যাচ্ছে তিনি কালী মায়ের বিশ্লেষণ করার আগে সিমবলিজম(symbolism) নিয়ে আলোচনা করছেন। অর্থাৎ এখানে কালী যেন শুধু একটা সাকার দেবী নন, পুরাণের কাহিনি নন, তিনি এক নিরাকার অখণ্ড শক্তিরূপ।
এই প্রতিটি রূপের মাধ্যমে তিনি চেষ্টা করেছিলেন যে রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মধর্ম এবং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বর্ণিত হিন্দুধর্মের মিলন ঘটাতে। নিবেদিতা সেই কাজে হয়তো সম্পূর্ণ সফল হননি। কেননা, কালী মায়ের মূর্তিপূজা, যেটাকে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করলেন, এমনকী কলকাতায় বক্তৃতায় তিনি পশুবলির ক্ষেত্রে হিন্দুধর্মের যৌক্তিকতার ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। অ্যালবার্ট হলের সেই বক্তৃতা শুনে কলকাতার সমাজের বহু বিদগ্ধ ব্রাহ্ম নাগরিক ভয়ঙ্কর সমালোচনায় ফেটে পড়েন। তিনি কিন্তু তাঁর বক্তব্যে অটল ছিলেন। তিনি শেষপর্যন্ত তাঁর যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন যে তিনি কেন এ কথা বলছেন।
তাঁর সিমবলিজম (symbolism)-এর মধ্যে তাঁর প্রতীক বা সংকেতের মধ্যে অনেক ব্যাখ্যা ছিল। কালী দ্য মাদার (Kali the Mother) বইটিতে তিনি বলছেন যেন তিনি নিজেই মা কালী।
(১৭ পাতার পর)
প্রথম বচনে তিনি বলছেন, ‘অভ্রান্ত আমার খেলা’— এ খেলায় যোগ দিয়ে দিনের যাত্রা শুরু করো। ভেবে নাও আমার খুশির জন্য এই পৃথিবীতে তুমি এসেছ। যখন রাত্রি ঘনাবে চরিতার্থ হবে আমার আকাঙ্ক্ষা, তখন তারই খুশির টানে তোমায় ফিরিয়ে নেব আমারই আশ্রয়ে। প্রশ্ন কোরো না, সন্ধান কোরো না, পরিকল্পনা কোরো না। আমার ইচ্ছা প্রবাহিত হোক তোমার মধ্যে— যেমন শঙ্খের মধ্যে দিয়ে বয়ে যায় সমুদ্র।
এখানে মনে রাখতে হবে স্বামী বিবেকানন্দ কাশ্মীরে গিয়ে লিখেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত কবিতা ‘কালী দ্য মাদার’ (Kali the mother)। সেই কবিতাটি নিবেদিতার জীবনে ভীষণভাবে প্রভাব ফেলে। নিবেদিতা ‘স্বামীজীকে যেরূপে দেখিয়াছি’ গ্রন্থে লিখেছেন, এই সময় কাশ্মীরে স্বামীজি যখন ভবানী মন্দিরে যান, যখন ডাল লেকে একটা বোটের ওপর ছিলেন, সেই সময় তাঁর সাংঘাতিক এক উপলব্ধি হয়। ভীষণভাবে মা কালীর বিষয়ে বিশেষ উপলব্ধি তাঁর মধ্যে আসে। স্বামীজি সব কথা হয়তো বলেননি। কিন্তু নিবেদিতা বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর গুরুর এক নতুন উপলব্ধি। যে উপলব্ধি থেকে তিনি বলছেন ধ্বংসের সাধনা। ধ্বংস থেকে সৃষ্টি হবে আর সেই সৃষ্টির জন্যই যেন আমরা যুগ-যুগান্ত ধরে অপেক্ষা করছি।
কাশ্মীরে যখন ছিলেন স্বামীজি ছিলেন, তখন ক্ষীর ভবানী দর্শনের পর নিবেদিতার মনে হয়েছিল যে, এ এক অন্য মানব। ক্ষীর ভবানী থেকে ফিরতেই গুরুর পায়ে মাথা রেখে নিবেদিতা বলেছিলেন, এতদিনে আমার মাকে চিনেছি। এই নিত্যলীলা কালীকে দেখেছেন নিবেদিতা। বিশ্বজুড়ে এই যে একটা অবিরাম শক্তিপ্রবাহ কালী তারই কেন্দ্রীয় প্রতীক। ধীরে ধীরে সেই পরম অনুভব যেখানে মরণের ওপারেই ভাস্বর জীবনের এক মহিমা, সেই মহিমার তীব্র আকর্ষণ।
নিবেদিতার অন্যতম জীবনীকার শ্রীমতী রেমঁ!
নিবেদিতার অন্তরঙ্গ বান্ধবী মিস ম্যাকলাউড-এর অনুপ্রেরণায় শ্রীমতী লিজেল রেমঁ নিবেদিতার জীবনী লেখার কাজে প্রথম হাত দেন। এই বইটিতে শ্রীমতী রেমঁ স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন যে, আয়ারল্যান্ড দুহিতা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত। তিনি তাঁর খ্রিস্টধর্মে এই কালীসত্তা তো দেখেননি! সেখানে স্যামুয়েল মার্গারেটের চতুর্থ সন্তান আমাদের নিবেদিতা সব ছেড়ে দিয়ে বড় বড় নীল চোখ নিয়ে ভারতে চলে এসেছিলেন। তিনি খ্রিস্টধর্মে কল্পিত ঈশ্বর শক্তির আদর্শকেই দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন। দেবতাকে শুধু দীনবন্ধু করুণাময় ভাবা আর প্রলয় লীলার মধ্যে তাঁর রুদ্র রূপকে দেখা— সেটা নিবেদিতা বুঝলেন। সবচেয়ে বড় উপলব্ধি হল কাশ্মীরে এসে। স্বামীজি নিবেদিতাকে উপলব্ধি করালেন, মানুষের অহংয়ের সমস্ত দাবি যেন এই প্রলয় লীলার মধ্যেই শেষ হয়ে যায় । সুতরাং এই সর্বনাশা এক রূপ, সেইরূপ তিনি নিজে দর্শন করলেন। যেন কালী জেগে উঠছেন। তাঁর জীবনীকার শ্রীমতী লিজেল রেমঁ লিখছেন যে, এই উপলব্ধি নিবেদিতাকে এক নতুন পথে পরিচালিত করল। তিনি লিখছেন, এই যে কালী জেগে উঠেছে তাঁর বুকে, তূর্য ধ্বনিতে আহ্বান করছেন জনতাকে। মহাশূন্যে বিদ্যুজ্জবালার মতো তাঁর গতি। লোকে মাকে হৃৎপিণ্ড মালিনী করেনি কেন? মানুষের রাগ দ্বেষ উৎসারিত হয় তাঁর হৃদয় থেকেই। না, তা-ও তো নয়। মাকে সাজানো হয়েছে মরণশয্যায়। তাঁর বক্ষে দলমল রক্ষা করা কপালের মালা। দুষ্কৃতীর আগুনে মা আবৃতা। তাই বুঝি ‘নর-কর-কোটি’? মানুষকে তাঁর নিজের হাত থেকে বাঁচান তিনি। তাঁদের সকল বেদনা সকল ক্ষত তাঁরই বুকে। তাই বুঝি মানুষ তার পূজারি? সমস্ত দ্বন্দ্বে, প্রলয়ের যে আঁধারে মা আমার— সে পূর্ণতার প্রতীক পরকৃষ্ণা, মহামায়া। জীবনীকার লিখছেন নিবেদিতা সহজ দৃষ্টিতে চোখের দিকে চাইলেন। নিজেকে সম্পূর্ণ তুলে ধরলেন তাঁর সামনে। অভিপ্সা যা কিছু বৈদ্যুতিক, তার সংস্কারের যা কিছু মালিন্য, নিবেদিতার মাঝে সবই যেন এক প্রবল শক্তির সংঘাতে অখণ্ড, নিপুণ নাবিকের মতো। এমন করে মাস্তুলের পালটি জড়িয়ে নিলেন যে, যে দিক থেকে বাতাস আসুক না কেন চলবে ঠিক ঘাটের পারে। এই যে জগৎজুড়ে একটা প্রাণের অঙ্কুরোদ্গম সেখানে চিৎ আর জ্বর যেন গাঁটছড়া বাঁধা। নিবেদিতা কাঁদছেন, মা… মা… তোমার প্রাণের মুক্তধারায় আমার তৃষ্ণা মেটাও।
আসলে নিবেদিতার জীবনে মা কালীর প্রভাব সাংঘাতিক। সেই কারণে সেই সময়ে যাঁরা গোঁড়া পণ্ডিত এমনকী বাগবাজারের দুটি বাড়িতে সমাজসেবা শিশুদের লেখাপড়া শেখানো এমনকী মেয়েদের পড়ানো— এসব কিছুই তখন রক্ষণশীল বাঙালি সমাজে অনেকেই মানতে রাজি ছিলেন না। তবু সে-সমস্ত রক্ষণশীলতার বাধাকে তুচ্ছ করে তিনি কিন্তু ভারতবর্ষকে ভালবেসেছিলেন।
স্বামী বিবেকানন্দের জীবন মাত্র ৩৯ বছরের। আর নিবেদিতার জীবন মাত্র ৪৪ বছরের। এক সংক্ষিপ্ত জীবন। যে সংক্ষিপ্ত জীবনে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমার মনে হয় ‘কালী দ্য মাদার’ (Kali the mother) গ্রন্থ রচনা। সেখানে ‘The voice of the mother’ নিবন্ধে আছে, নিবেদিতা মা কালীর মুখ দিয়ে নিজেই বলাচ্ছেন যে, মনে রেখো— যে আমি উচ্চস্বরে ডাকি, সেই আমিই কীভাবে সাড়া দিতে হয় তা-ও দেখিয়ে দিই। দলকে রক্ষা করতেই হোক বা মৃত্যুমুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে হোক সকল কাজে মা এগিয়ে যান। যে নামই দেওয়া হোক না কেন ধর্ম বলতে মৃত্যুকে ভালবাসা বোঝায়। কিন্তু এইবার আমার দেশে ত্যাগের বাতি জ্বলে উঠলে এমন ভাবে মানুষকে অভিভূত করবে যে ভাবাই যায় না। অন্য লোকে যেমন ভোগের জন্য পাগল হয়। আমার লোকেরা সেরকমই আত্মবিসর্জন দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠবে। এই বক্তব্য সেই সময় মুক্তিসংগ্রামে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করেছিল, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আবার নিবেদিতার কালীচিন্তন এদেশের এবং পাশ্চাত্যের উভয়ের বুদ্ধিজীবী মহলে যে আলোড়ন তুলেছিল সেকথা ভুলে গেলে চলবে না। ১৮৯৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতার অ্যালবার্ট হলে তাঁর কালী-বিষয়ক বক্তৃতায় দেশীয় শিক্ষিত সমাজ এক নতুন আলোর সন্ধানও পেয়েছিল। আর ‘কালী দ্য মাদার’ গ্রন্থটি ১৯০০ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। সেটা ইউরোপীয় পাঠকদেরও বিমূঢ় করে দেয়। এই গ্রন্থ রচনার সময় নিবেদিতার মানসিক প্রস্তুতি ছিল সাংঘাতিক। তিনি মিস ম্যাকলাউডকে ১৮৯৯ সালের ৮ অক্টোবর চিঠিতে লিখেছিলেন যে ‘I have finish Kali’। আরও অনেক কাজ করতে হবে রিট্রিটে যাবার বাসনা আমার অনেকদিনের। গুরুদেবই তার প্রধান অন্তরায় ছিলেন। এখন সেন্ট সারা ও তার মধ্যে বোঝাপড়া করতে সক্ষম হয়েছি। সকলের মধ্যে ঘোষণা করা হল যে ১৫ দিনের মধ্যে আমাকে একান্তবাসে যেতে হবে। এই বইটি শেষ করার পর তিনি একান্তবাসে যেতে চাইছেন। তিনি লিখেছেন যে, ‘আজ রাতে কালীসাধকদের ওপর অধ্যায়টি লিখতে গিয়ে একেবারে আটকে গেছি। রামপ্রসাদ পর্যন্ত লিখেছি। আর সেটা শেষ করতে গিয়ে রামকৃষ্ণে প্রবেশ করব কিন্তু পারছি না। কয়েক পৃষ্ঠা আগডুম বাগডুম লিখলাম আর সেটা ছিঁড়ে ফেললাম। শেষে হতাশ হয়ে গিয়ে গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় কপি করছি। ভয় হয় তুমি আসবে। আমি আমার চিন্তা-ভাবনাগুলো এখনো গুছিয়ে উঠতে পারছি না । but I hope difficult is only temporary’। এই চিঠিটা লিখতে গিয়ে তিনি অন্য কাজগুলোও করছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গল্পের তিনি প্রথম অনুবাদিকা। একটা জিনিস কিন্তু বোঝা যাচ্ছে যে তিনি সবকিছুর মধ্যে শক্তির সাধনা করতে চাইছেন। আর তাঁর কাছে সেই শক্তি সবথেকে বড় এক মানবিক রূপ।
প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণার প্রামাণ্য জীবনী ভগিনী নিবেদিতা থেকে জানা যায় যে, কালীর নানা রূপ সেগুলোকেও কিন্তু সিস্টার মেলাতে চেয়েছিলেন তাঁর দর্শনের মধ্যে। দেবী কালীকা বড় আপনজন। কালীর যে নানান রূপ, সেগুলোকে তিনি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। যেখানে লোলজিহ্বাধারী তাঁর বন্দনা আছে, আবার যখন দেবী শান্ত সমাহিত সেইরূপকেও নিবেদিতা পুজো করছেন। কালীকা পুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, বরাহ পুরাণ— এসবে দেবী কালীকা কাহিনি পাওয়া যায়।
সেই ১০/২-এর বাড়িতে যেখানে তিনি মা সারদা দেবীকে দর্শন করেন, সেও তো ছিল এক ঐতিহাসিক বাড়ি! গ্রামবাংলার রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারের প্রায় নিরক্ষর এক মহিলা তাঁর অসীম মাতৃস্নেহে বিদেশিনিদের আপন করে নিচ্ছেন। স্বামীজিও সেই ঘটনায় নিশ্চিন্ত হন। বোসপাড়া লেনের ঘরে বসে যখন বিভিন্ন আর্ত মানুষের সেবা করছেন নিবেদিতা, সেই সময় তাঁর চোখের সামনে এক বালিকার মৃত্যু হচ্ছে রোগভোগের কারণে। আর তার মা সেই ঘরে হাউমাউ করে কাঁদছে। নিবেদিতা বলছেন, মা তুমি কেঁদো না। এই মৃত্যু শাশ্বত সনাতন সত্য। তুমি তো এক দেবীর রূপ। তোমার মেয়ে সে তো এক দেবীর রূপ। কোলে মৃতদেহটি রেখে নিবেদিতা তাঁর কালীদর্শন করছেন সেই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
আরও পড়ুন-দিল্লির ‘দাদাগিরি’ চলবে না : মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
এইভাবে নানান ঘটনার মধ্যে দিয়ে আমরা জানতে পারছি যে, নিবেদিতা এবং মা কালীর সম্পর্ক এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এই সম্পর্ক— তার বিভিন্ন স্তর, বিভিন্ন ব্যঞ্জনা এবং তা বোঝা এত সোজা নয়। তবুও দর্জির ফিতে দিয়ে সমুদ্র মাপার এক অসম্ভব চেষ্টা করে চলেছি আমরা। স্বামীজির কবিতাতেও কালীধংসের রূপ, নিকষ কালো রূপ দেখেছি, কিন্তু সে-ও ছিল এক সৌন্দর্যের রূপ!
গ্রন্থঋণ
(১) নিবেদিতা
শ্রীমতী লিজেল রেমঁ
(অনুবাদিকা : নারায়ণী দেবী)
(২) নিবেদিতা লোকমাতা
প্রসাদ বসু শঙ্করী
(৩) নিবেদিতা–এক পবিত্র মন
দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত
(৪) ভারতপ্রাণা নিবেদিতা
পূর্বা সেনগুপ্ত
(৫) ভগিনী নিবেদিতা
প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণা