আবার প্রমাণিত হল এই দেশ সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষেই। সদ্য পেরনো সারা দেশের লোকসভা নির্বাচনে নিজেদের কোলে ঝোল টানার সাত দফার যে ঘুঁটি নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে বিজেপি সরকার সাজিয়েছিল, তার যে এইভাবে দফা রফা হয়ে যাবে তা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি। ফলে দম্ভের উঁচু মিনারে বসে তারা অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, চিন্তাও করতে পারেনি তাদের পায়ের নিচ থেকে কীভাবে মাটি সরে যাচ্ছে। এই দম্ভই বর্তমান ভারতের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিজেপি-এনডিএ জোটের শরিকদের নিয়ে ৪০০-র দোরগোড়ায় তো পৌঁছলই না বরং ৩০০ সংখ্যাটিও টপকাতে পারল না। এই রামধাক্কার জের যখন সারা দেশের সব রাজ্যেই পড়েছে, তখন আমাদের রাজ্যেও যে তার আঁচ লাগবে তা বলাই বাহুল্য। এখানে বিজেপি সম্পূর্ণরূপেই পর্যুদস্ত হল রাজ্যের তৃণমুল কংগ্রেসের (Trinamool Congress) কাছে। নির্বাচনের আগে এই রাজ্যে বিজেপি যেরকম দাঁত-নখ বার করে নির্বাচনী প্রচারে উন্মত্ততার শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল, সেইখান থেকে এইভাবে তাদের স্বপ্নভঙ্গ হবে এটা তাদের কল্পনাতীত। ফলে ফলপ্রকাশের পরেই তারা মুখ লুকিয়ে ফেলল।
এইবারে নির্বাচনের প্রথম দফা থেকেই একটি দৃশ্য নজরে আসছিল। অনেক জায়গায় কম পার্সেন্টেজ ভোট পড়লেও রাজ্যে রাজ্যে মহিলা ভোটারদের সংখ্যা কিন্তু বেশি ছিল পশ্চিমবঙ্গও তার বাইরে ছিল না। সাতটি দফা জুড়ে ভোটকেন্দ্রগুলোতে উপচে পড়া মহিলা ভোটারদের ভিড় দেখেই আন্দাজ করা গিয়েছিল হাওয়া কোনদিকে বইতে চলেছে। যদিও কিছু মিডিয়া এবং আগাম সমীক্ষা বলছিল দেশে বিজেপি বিপুল সংখ্যায় আসছে, আর পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি তৃণমূলের (Trinamool Congress) থেকে সংখ্যায় এগিয়ে থাকবে। এই দুটো সম্ভাবনাকেই পশ্চিমবঙ্গবাসী তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল। আর রাজ্যের এই দারুণ ফলের পিছনে থাকল এই রাজ্যের মহিলাদের বিপুল অবদান।
স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের পরে যে সাংবাদিক সম্মেলন করলেন, তাতে তিনি প্রথমেই রাজ্যবাসী বিশেষত মহিলাদের অভিনন্দন জানালেন। মুখ্যমন্ত্রী সারা রাজ্য জুড়ে যেভাবে নিঃশঙ্কচিত্তে, নিরলসভাবে ভোট প্রচার করেছিলেন, ওই তীব্র গরমকে উপেক্ষা করে যারা মিটিং ভরিয়েছিলেন তাঁরা আর কেউ নন— এই রাজ্যের অতি সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মহিলা, গৃহবধূ, বাড়ির মা-মেয়ে-বোন-তরুণী, চাকরিজীবী, শিক্ষিকা কে না! এদের বুক ফাটলেও মুখ ফাটেনি।
এই যে দিনের পর দিন নির্বাচনী প্রচারের নাম করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে যে ধরনের ঘৃণার বাক্য বিরোধীরা বলেছেন, তাতে যে কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনেই ত্রাসের সঞ্চার হবে। তাঁরা ভোটদানে অনেক সচেতন হবেন। আর তাইই হয়েছে, বাংলার মায়েরা জেনে-বুঝে আগুনে হাত তো দেনইনি— না, বরং প্রতিটি ঘৃণা বাক্যের জবাব দিয়েছেন ব্যালট বাক্সে।
এবারের বাংলার ভোটে মহিলাদের দিদিকে ঢেলে ভোট দেওয়ার কারণ হিসাবে দেখানো হচ্ছে এই রাজ্যের সর্বশেষ প্রকল্প লক্ষ্মীর ভাণ্ডারকে। তৃণমূল সরকারের এই প্রকল্প যে সুপার হিট তা যে কোনও ঘরের মা-বোনদের জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারা যাবে।
আরও পড়ুন- জয়ের জন্য লাল-হলুদের শুভেচ্ছা মুখ্যমন্ত্রীকে
এটির অঙ্ক সরাসরি উপভোক্তার নামে তার নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পড়ে যায়। এই প্রকল্পটি সম্পূর্ণ এই রাজ্য সরকারের নিজস্ব প্রকল্প। বর্তমানে এই রাজ্যের প্রায় ২.১৮ কোটি মহিলা এই প্রকল্পটি থেকে সুফল পাচ্ছেন। রাজ্য বাজেটে ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ। এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কতখানি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন তা ভোটের ফলেই যেমন প্রমাণিত তেমন এই ধরনের প্রকল্পগুলিকে তিনি ভোটের মুখ চেয়েই করেননি। বিধানসভা ভোটে জিতে তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতিমতো এই প্রকল্পটি চালু করেছিলেন। এই প্রকল্পটির মতো কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, নানান ধরনের মহিলাকেন্দ্রিক প্রকল্পগুলো থেকে সমাজের সর্বস্তরের জাতি, ধর্ম নির্বশেষে উপভোক্তারা উপকৃত। এঁরাই যে ভোটে দিদিকে ফিরিয়ে আনবেন এ বলাইবাহুল্য।
গত তিনটি টার্মে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই নির্বাচিত করেছেন এখানকার নাগরিকরা তার কারণও এইসব জনমুখী প্রকল্প। এই রাজ্যের মহিলাদের মধ্যেও তা দেখা গেছে। পশ্চিমবঙ্গে এখন মহিলারাও রাজনীতি সচেতন হয়েছে, হচ্ছেও। আগে সাধারণ বাড়ির মেয়েদের রাজনীতির ব্যাপারে কোনও আগ্রহই ছিল না। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস (Trinamool Congress) রাজ্যে ক্ষমতা লাভের পর থেকেই দেখা যাচ্ছে রাজনীতির বিভিন্ন স্তরে যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে মহিলারাই। এরা এতদিন সংসারে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে থাকতেন, এখন ব্লক কমিটি থেকে মন্ত্রিসভা— সর্বত্রই মহিলাদের অনায়াস যাতায়াত। নিজেরা কোনও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করে না। নিজেদের এই মতদানের শক্তিই দিদির হাত যথেষ্টই শক্তিশালী করেছে। বাংলায় মেয়েদের এই ফোর্সই দিদিকে টেনে তুলে নিয়ে গেছে বিজয়ের শিখরে।
কিছুদিন আগেই আমাদের এক সাসংদ মহুয়া মৈত্রকে কোনও প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে যেভাবে অগণতান্ত্রিক উপায়ে লোকসভা থেকে বহিষ্কার করা হয়, এই ভোটে তার সরাসরি জবাব বিজেপি পেয়েছে— যেমন বঙ্গ-বিরোধীদের জবাব দিল সন্দেশখালির মা- বোনেরা। এবারে আমাদের বঙ্গের লক্ষ্মীবাহিনী যেভাবে পুরো ভোট সামাল দিল, তার থেকে এটাই প্রমাণিত হল ৪২টি আসনের মধ্যে ১১ জন লক্ষ্মীবাহিনীর নারী সাংসদদের সংসদে পাওয়া। সম্ভবত তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া একই দল থেকে এতজন মহিলা সাংসদ আর কোনও দল থেকে যাচ্ছে না। নতুন, পুরনো মিলিয়ে এই সাংসদদের রাজ্যের মহিলারা দিল্লি পাঠালেন গণতন্ত্রকে রক্ষা করার আশায়। এসবই সম্ভব হল লক্ষ্মীবাহিনীর লক্ষ্মী, আমাদের দিদি, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্যই।