প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব ছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ। সৎ, নির্ভীক সাংবাদিক হিসেবে ছিল বিশেষ পরিচিতি। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকের মত প্রকাশের অধিকার প্রসঙ্গে ছিলেন আপসহীন সংগ্রামী। কথাসাহিত্যেও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ছিল অনুসন্ধানী চোখ, সত্যসন্ধানী মন। জন্ম ১৯২৩-এর ২০ জুন, শিলাইদহের হাটগোপালপুরে মাতুলালয়ে। পিত্রালয় যশোর জেলার মথুরাপুর গ্রামে। পরে চলে আসেন এই বাংলায়। তিনি ছিলেন স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক গিরিজাভূষণের পুত্র। দারিদ্র ছিল পরিবারের নিত্যসঙ্গী। আঠারো বছর বয়সে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। কারণ, পিতার দ্বিতীয় বিবাহ।
আরও পড়ুন-দুর্গাপুর ইস্পাতের সঙ্গে দাবি নিয়ে বৈঠক সাংসদ মন্ত্রী, তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের রাজ্য সভাপতির
গৌরকিশোরের মা সাধনা দেবী ছিলেন অবস্থাপন্ন দেওয়ান বাড়ির মেয়ে। তবে কখনও বিত্তশালী পিত্রালয়ের সাহায্য নেননি। প্রবল আত্মসম্মানবোধ এবং লড়াইয়ের দুর্দমনীয় ক্ষমতা গৌরকিশোর সম্ভবত পেয়েছিলেন মায়ের কাছ থেকেই।গৌরকিশোরের সহধর্মিণী শীলা। জানা যায়, তাঁদের বিয়ে কলকাতায় সেইসময় একটা উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। শীলা ছিলেন সফল ব্যবসায়ী ধীরেন্দ্রকৃষ্ণের কন্যা। দুটি পরিবারের আর্থিক এবং সামাজিক অবস্থানে সমুদ্র-ফারাক। তাই সম্মত হননি ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ। বাধ্য হয়ে সকলকে প্রণাম জানিয়ে গৃহত্যাগ।কীরকম ছিল বিয়ের অনুষ্ঠান? গৌরকিশোরের সামর্থ্য ছিল না। তাই ঠিক হল টিকিট বিক্রি করা হবে। বউভাত হবে বন্ধু অরুণকুমার সরকারের বাড়িতে। টিকিটের দাম আড়াই টাকা। কিনতে হবে অরুণকুমার ও গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যর কাছ থেকে। আমন্ত্রণকর্তাও তাঁরাই। যাঁরা আসবেন, টিকিট কাটবেন এবং খাবেন। রাজশেখর বসু দশ টাকা পাঠিয়েছিলেন টিকিটের মূল্য হিসেবে। গিরিজাভূষণ নিজের এবং পরিবারের জন্য টিকিট কেটেছিলেন। মোটের ওপর বন্ধুদের উৎসাহে এবং সক্রিয়তায় একটা যুগান্তকারী বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। শীলা সব অর্থেই ছিলেন গৌরকিশোরের উপযুক্ত সহধর্মিণী। রূপদর্শী ছিল গৌরকিশোরের ছদ্মনাম। তাঁর লেখাগুলো মূলত নকশা। রীতিমতো ঘাড় ধরে নাড়িয়েছিল বাঙালি সমাজকে। ভারতীয় রাজনীতির দিশা পরিবর্তনের আভাসের পাশাপাশি ভণ্ডামি, গুন্ডামি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে গৌরকিশোরের কলম। লেখাগুলো থেকে আদ্যন্ত জীবনরসিকের সন্ধান পাওয়া যায়। জীবনে জীবন যোগ করা ছিল তাঁর স্বভাব। তিনিই গৌড়ানন্দ কবি। মসির দ্বারা অসি চালিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে। রূপদর্শীর রচনায় কৌতুকের সঙ্গে যে সহানুভূতির ও মর্মবেদনার স্পর্শ পাওয়া যেত, সেটা গৌড়ানন্দ কবির রচনায় মেলে না। তার বদলে পাওয়া যায় শাণিত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। পাহাড়ের হাতছানি উপেক্ষা করতে পারতেন না। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বেড়িয়ে পড়তেন। মুখোমুখি হয়েছেন রোমহর্ষক পরিস্থিতির। ফিরে এসে লিখেছেন। সেগুলো কোনও সাধারণ রিপোর্টাজ ছিল না। তিনি এমন এক সম্পাদক, যিনি ঠিক সময়ে যুগ বদলের সুলুক সন্ধান করতে পেরেছিলেন, ধরতে পেরেছিলেন তার দিকচিহ্নগুলো। এককথায়, গৌড়ানন্দ কবি ছিলেন পুরোদস্তুর স্বপ্নদ্রষ্টা, সাহসী, নিজের বিশ্বাসে অনড় এক অবিশ্বাস্য পুরুষ। বহু গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। ‘এই দাহ’, ‘এক ধরনের বিপন্নতা’, ‘কমলা কেমন আছে’, ‘মনের বাঘ’, ‘গড়িয়াহাট ব্রিজের উপর থেকে, দুজনে’, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লাভ করেছে পাঠকপ্রিয়তা। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ব্রজদা আখ্যান। তাঁর অন্যস্বাদের গল্প। গল্প-উপন্যাসগুলো পড়তে পড়তে মনে হয়েছে সাংবাদিক গৌরকিশোরের আড়ালে রয়ে গেছেন লেখক গৌরকিশোর। ট্রিলজি লিখেছেন। ট্রিলজিতে বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের পূর্বাপর ইতিবৃত্ত তুলে ধরতে চেয়েছেন। তাঁর লেখা ‘সাগিনা মাহাতো’ চলচ্চিত্রে রূপদান করেছেন তপন সিংহ। অভিনয় করেছেন দিলীপ কুমার। মহানায়ক উত্তম কুমার অভিনীত ‘ব্রজবুলি’ তৈরি হয়েছে তাঁর কাহিনি অবলম্বনে। পেয়েছেন রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার। ২০০০ সালের ১৫ ডিসেম্বর না-ফেরার দেশে চলে গেছেন গৌরকিশোর ঘোষ। তিনি নেই। আছে তাঁর নানা বিষয়ের বই। আছেন তাঁর হাতে গড়া বহু সাংবাদিক, সাহিত্যিক। এইভাবে তিনি থেকে যাবেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম।