ধর্ষকের ফাঁসি চাই। দাবি উঠেছিল কলকাতার রাজপথে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলাতেও। আরজি কর-কাণ্ডে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও মৃত্যুর ধটনা সামনে আসার পর। সেই দাবিকে মান্যতা দিয়ে ৩ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় পাশ হল অপরাজিতা মহিলা ও শিশু (পশ্চিমবঙ্গ ফৌজদারি আইন সংশোধন) বিল, ২০২৪।
এই বিলে বলা হয়েছে, নির্যাতিতার প্রাণহানি কিংবা চিরপঙ্গুত্বের ঘটনায় দোষী ধর্ষকের চূড়ান্ত শাস্তি হল মৃত্যুদণ্ড। এই বিল বা অধ্যাদেশে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ২০২৩, ভারতীয় ন্যায় সুরক্ষা সংহিতা ২০২৩ এবং পকসো (যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে শিশুদের সুরক্ষা) আইন ২০২১-এর বিভিন্ন ধারায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে।
এরকম আইন রাজ্যস্তরে যে ইতিপূর্বে আসেনি, তেমনটা নয় মোটেই। নারীনির্যাতন যেহেতু কোনও নির্দিষ্ট রাজ্যের নয়, সারা দেশের সমস্যা, সেহেতু মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং অরুণাচল প্রদেশে ধর্ষণকারীর মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করে এর আগেই বিল বা আইন পাশ হয়েছে। তাও কেন শরদ পাওয়ারের মতো অভিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বঙ্গ আইনকে অনুসরণ করার কথা বলছেন?
পশ্চিমবঙ্গে অপরাজিতা বিলের শুরুতেই ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৪(খ) ধারায় যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা হয়েছে তার সঙ্গে আজীবন সশ্রম কারাদণ্ডের শাস্তিকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। বদল আনা হয়েছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪ নং ধারায়। ওই ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা হয়েছিল। সেটা বদলে, অপরাজিতা বিলে ‘মৃত্যুদণ্ড’ কথাটিকে তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
বদল আনা হয়েছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৬ নং ধারাতেও। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৬ নং ধারায় বলা ছিল, ধর্ষণের কারণে নির্যাতিতার মৃত্যু হলে কিংবা সে একেবারে চলৎশক্তিরহিত দশায় আমৃত্যু চলে গেলে নির্যাতনকারীর ন্যূনতম সাজা হবে ২০ বছরের জন্য কারাদণ্ড। এর পরিবর্তে সে মৃত্যুদণ্ডেও দণ্ডিত হতে পারে। অপরাজিতা বিল বাকি সম্ভাবনাগুলোকে নস্যাৎ করে দিয়ে ধর্ষণের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডকেই বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। এখানেই এই অধ্যাদেশের বিশেষত্ব।
ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৭০ নং ধারায় গণধর্ষণের সাজা আলোচিত হয়েছে। ৭০(২) নং ধারা মোতাবেক, নির্যাতিতার বয়স অনূর্ধ্ব ১৮ হলে দোষীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু ৭০(১) নং ধারা মোতাবেক, নির্যাতিতার বয়স ১৮ বছরের বেশি হলে অপরাধীরা বড়জোর যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। ৭০(১) ধারার এই ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করে দিয়ে অপরাজিতা বিল নির্যাতিতার বয়স নির্বিশেষে ধর্ষণকারীদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার কথা বলেছে।
ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৭১ নং ধারায় বারবার ধর্ষণে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা ছিল। অপরাজিতা বিল সেক্ষেত্রে সশ্রম কারাদণ্ডের প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৭২ ও ৭৩ নং ধারায় নির্যাতিতার নাম, পরিচয়-সহ অন্যান্য তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশের দায়ে দোষীর যে ক’দিন কারাদণ্ড বিধানের ব্যবস্থা ছিল, অপরাজিতা বিল সেই কারাদণ্ডের মেয়াদ বৃদ্ধির কথা বলেছে।
ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১২৪ নং ধারায় অ্যাসিড হামলার ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তিকে যে শাস্তির কথা বলা হয়েছিল তাতে শাস্তির মেয়াদ যাবজ্জীবনের চেয়ে কম, সঙ্গে জরিমানার ব্যবস্থাও ছিল। অপরাজিতা বিল সেসব বদলে এরকম ক্ষেত্রে কেবল সশ্রম যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান দিয়েছে।
পসকো আইনে ধর্ষণের মতো যৌনহেনস্থার সর্বোচ্চ শাস্তি বর্তমানে ৪ নং ধারা অনুসারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। অপরাজিতা আইন সেটা বদলে এক্ষেত্রেও মৃত্যুদণ্ডের নিদান দিয়েছে।
ভারতীয় ন্যায় সুরক্ষা সংহিতার ২৯ গ নং ধারার অধীনে নারী নির্যাতন সংক্রান্ত অপরাধের তদন্তের জন্য যে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠনের ব্যবস্থা ছিল অপরাজিতা তাতেও বদল এনেছে। এই বিলে অভিযোগ পাওয়ামাত্র তদন্ত শুরুর স্বার্থে জেলায় জেলায় বিশেষ অপরাজিতা টাস্ক ফোর্স গঠনের কথা বলা হয়েছে। সরকারি আধিকারিকরাও এই বিশেষ তদন্তকারী দলকে সম্পূর্ণ সহায়তা করবেন। কোনওরকম গাফিলতি হলে তাঁদেরও ছ’মাসের জন্য জেলে যেতে হতে পারে।
আরও পড়ুন- ডাক্তারদের ধরনামঞ্চে বিজেপি নেত্রী শর্বরী ও মাদককাণ্ডের পামেলা
ভারতীয় ন্যায় সুরক্ষা সংহিতায় ১৯৩ নং ধারায় দু’মাসের মধ্যে তদন্ত শেষের বিধান ছিল। সেটা বদলে অপরাজিতা বিল ২১ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করার কথা বলেছে। তবে প্রয়োজনে আরও ১৫ দিন অতিরিক্ত সময় তদন্তের জন্য দেওয়া যেতে পারে, এমন কথাও ওই বিলে বলা হয়েছে।
ভারতীয় ন্যায় সুরক্ষা সংহিতার ২৯-এর ‘ক’ এবং ‘খ’ নং ধারায় মহিলা নির্যাতন সংক্রান্ত অপরাধের বিচার ও শাস্তিবিধানের জন্য যে বিশেষ আদালত গঠনের কথা বলা ছিল তার পরিসর বাড়িয়ে অপরাজিতা বিল প্রত্যেক জেলায় ওইরকম আদালত গঠনের কথা বলেছে। সেই সঙ্গে এরকম মামলার জন্য বিশেষ সরকারি আইনজীবী নিয়োগের কথাও জানিয়েছে।
ভারতীয় ন্যায় সুরক্ষা সংহিতায় বলা হয়েছে চার্জশিট গঠনের দু’মাসের মধ্যে মামলা শেষ করে রায় দিতে হবে। অপরাজিতা বিল সেই সময়সীমা কমিয়ে ৩০ দিন করেছে।
২০১৯-এর নভেম্বরে হায়দরাবাদের শামশাবাদে মাত্র ২০ বছর বয়সি এক পশু-চিকিৎসক গণধর্ষণের শিকার হয়ে মারা যাওয়ার পর চারজন অভিযুক্ত সে বছরই ৬ ডিসেম্বর পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। এরপর অন্ধ্র সরকারও নারীনির্যাতনকারীদের আইনি পথে চরম শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য সেখানকার বিধানসভায় দিশা বিল নিয়ে আসে। দিশা অধ্যাদেশেও ১৬ বছরের অনূর্ধ বালিকাকে ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও একাধিকবার ধর্ষণের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার মতো ঘটনায় ফাঁসির কথা বলা হয়, অপরাজিতা বিলের মতো সেখানেও প্রতিটি জেলায় সিট ও বিশেষ আদালত গঠনের কথা বলা হয়েছিল। পাশাপাশি নারীও শিশুদের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধে অপরাধীদের বিস্তারিত বিবরণ সমেত রেজিস্টার জেলায় জেলায় প্রস্তুত করার কথা বলা হয়েছিল।
এর আগে ২০১৭ ও ২০১৮-তে যথাক্রমে মধ্যপ্রদেশ ও অরুণাচল প্রদেশ বিধানসভাতেও ধর্ষকের ফাঁসির বিধান দিয়ে বিল পাশ হয়। তবে ওই দুটি বিলে ভারতীয় দণ্ড সংহিতা ১৯৬০-এর ৩৭৬ ক ক এবং ৩৭৬ ঘ ক ধারা অনুসারে কেবল ১২ বছরের অনূর্ধ্ব নাবলিকার নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে এরকম চরম বিধান ছিল।
২০২০-তে মহারাষ্ট্র বিধানসভায় পাশ হয় শক্তি বিল। সেখানেও ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় এবং নারীনির্যাতন সংক্রান্ত তদন্ত ও মামলার সময় কমানোর কথা বলা হয়। এরকম ঘটনায় কেউ, সেই অপরাধী ব্যক্তি হোন বা কোনও সমাজমাধ্যম সংস্থা, তদন্তকারী আধিকারিকদের আবেদন সত্ত্বেও ঘটনা সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রদানে ঢিলেমি করলে তার একমাসের জন্য কারাবাস সুনিশ্চিত করা হয়েছিল। অ্যাসিড হামলার ক্ষেত্রে যথাযোগ্য নথি ও তথ্য প্রমাণ থাকলে হামলাকারীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার কথা বলা হয়। পসকো আইনের ৪নং ধারায় অভিযুক্তদের যেমন ফাঁসি দেওয়ার কথা বলেছে অপরাজিতা বিল, শক্তি বিলেও তেমন ব্যবস্থাই ছিল।
কিন্তু ধর্ষণকারীর ফাঁসির নিদান চেয়ে রাজ্য বিধানসভায় পাশ হওয়া কোনও বিলই শেষমেশ আইনে পরিণত হয়নি। দিশা বিল আর শক্তি বিলের মতোই অপেক্ষমাণ অপরাজিতা বিলও। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের অপেক্ষায়। তাই, সত্যি যদি কেউ মনে করেন ধর্ষকের ফাঁসিতেই মিলবে কাঙ্ক্ষিত ন্যায়বিচার, তবে স্রেফ আন্দোলনে উৎসাহ জোগাতে স্লোগান তোলা আর নয়, স্লোগান উঠুক এবার সঠিক লক্ষ্যে, প্রতিবিধানের নিশ্চিত উদ্দেশ্যে। ভুলভাল সরষের স্তূপে খুঁজলে সঠিক ভূতের খোঁজ মিলবে না কোনও দিনই।