সাধক বামাক্ষ্যাপা
বাংলার শক্তিসাধনার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ও বর্ণময় চরিত্র হলেন সাধক বামাক্ষ্যাপা। তারাপীঠের কাছে আটলা গ্রামের পরিবার পরিজন ছেড়ে জগৎ-সংসার ভুলে শ্বাপদসঙ্কুল ও দ্বারকা তীরবর্তী পুণ্যভূমিতে তিনি শুরু করেন তাঁর মহাসাধনা। সাধারণ নিয়ম-নীতি মেনে গুরুমন্ত্র উচ্চারণে ঈশ্বরের আবাহন নয়। ঘোর তমসাচ্ছন্ন অমানিশাকে তিনি বেছে নিতেন তাঁর সাধনার ক্ষণ হিসাবে।
তারাপীঠের মহাশ্মশানে কখনও তিনি জ্বলন্ত চিতার সামনে বসে থাকতেন কখনও বা বাতাসের সঙ্গে কথা বলতেন। এমন ব্যতিক্রমী ছিল তাঁর ধরন।
এক ভাদ্রপদ মাসে শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথি মঙ্গলবারের ব্রাহ্মমুহূর্তের মহেন্দ্রক্ষণে বামাক্ষ্যাপা মা তারার দর্শন পেয়েছিলেন। এক হাতে অস্ত্র, আরেক হাতে মাথার খুলি, এক হাতে নীলপদ্ম অন্য হাতে খড়্গ।
বিশেষ রূপে মা তারার দর্শন পেলেন তিনি।
এর কিছুদিন পর ভগবতী তারা সেখানকার রানির কাছে স্বপ্নে আবির্ভূতা হন এবং তাঁকে নির্দেশ দেন শ্মশানে মা তারার একটি মন্দির তৈরি করার। এবং বামাক্ষ্যাপাকে সেখানে পুরোহিত করার।
খুব সহজে সে-কাজ হয়নি। কারণ মন্দিরের অন্য পুরোহিতরা মাকে নিয়ে বামাক্ষ্যাপার ক্ষ্যাপামো পছন্দ করতেন না। কখনও তিনি সারাদিন পুজো করতেন। আসলে মায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল সন্তানের মতন।
কঠোর তপস্যায় সাধক বামাক্ষ্যাপা হয়ে উঠে ছিলেন তিনি। বামাক্ষ্যাপার নানান অলৌকিক কাহিনি আজও কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে।
আরও পড়ুন-কালী কলকাত্তাওয়ালি
তারাপীঠের সেই সময়ে নগেন পান্ডার খ্যাতি খুব ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁরই খুব পরিচিত স্থানীয় এক জমিদার, নাম পূর্ণচন্দ্র সরকার, হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অনেক ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়ে কোনও ফল হল না। তখন নগেন পান্ডা এসে বামাক্ষ্যাপার পায়ে ধরলেন। বললেন বামাক্ষ্যাপা যেন মুখে রোগীকে উঠে বসতে বলেন তাহলেই রোগী ভাল হয়ে যাবে। কারণ বামাক্ষ্যাপা ছিলেন বাক্সিদ্ধ মহাপুরুষ।
শিশুর সারল্যে বামদেব বললেন, ‘‘তুই যা বলতে বলেছিস আমি তাই বলব কিন্তু যদি ভুলে যাই মনে করিয়ে দিস।’’ কিন্তু অবাক ব্যাপার! রোগীর কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতেই উনি বলে উঠলেন,‘‘ওরে এ তো নগেন কাকা, এ কার কাছে আনলি রে? এ তো এখনই ফট।’ অর্থাৎ আর কোনও আশা নেই একথা বলে বামদেব আর সেখানে দাঁড়ালেন না তিনি পালকিতে গিয়ে বসলেন। ততক্ষণে ওদিকে রোগীও শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।
বর্ষায় তিনি মাকে হারিয়েছিলেন। পারলৌকিক কাজের ঠিক দু’দিন আগে ভাই রামচরণ এসে দাদাকে ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে উপস্থিত থাকার জন্য বলল। আপন ভোলা বামা তখন বলে উঠলেন, ‘‘দু-চারখানা গ্রামের মানুষকে নেমন্তন্ন করে তৃপ্তি সহকারে খাওয়াবি কিন্তু।’’
ভাই রামচরণ তো ভয় পেয়ে গেল। নিজেদের জন্য দু’মুঠো অন্ন জোগাড় করতে যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের দু’-চারখানা গ্রামের মানুষকে নেমতন্ন করা কি মুখের কথা!
তবু দাদার আদেশ মানতেই হবে। কিন্তু কী করেই বা তা সম্ভব হবে। এদিকে চিন্তান্বিত ভাইকে দেখে বামদেব অলক্ষ্যে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন।
এরপর এল সেই শ্রাদ্ধের দিন।
আর সেদিনই ঘটে গেল এক বিস্ময়কর কাণ্ড। সকাল থেকেই দলে দলে লোক আসছে, কারও মাথায় চালের ধামা, কারও বা ফলের ঝুড়ি, কারও হাতে মিষ্টি, শাড়ি আবার কারও হাতে শাকসবজি। জিনিসপত্র যা জমা হল তাতে অনায়াসে তিন থেকে চার হাজার লোক পেট ভরে খেতে পারবে। কিছুক্ষণ পরেই বামদেব এসে হাজির হলেন। বললেন, সব ঠিক আছে তো ভাই? রামচরণের বুঝতে বাকি রইল না এ-সমস্ত সিদ্ধপুরুষ তাঁর দাদার কীর্তি।
তারাপীঠ সাধনপীঠ হয়ে উঠেছে এই মহান সাধকের জন্য।
আরও পড়ুন-এল ক্লাসিকোয় আজ ভিনি বনাম রাফিনহা
সাধক কমলাকান্ত
বাংলার শক্তিসাধকদের অন্যতম সাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। শাক্ত পদাবলীর রচয়িতা, কবি, সাহিত্যিক, সুরকার— বহু গুণে গুণবান ছিলেন কমলাকান্ত। কমলাকান্তকে ঘিরে রয়েছে অজস্র অলৌকিক ঘটনা। এই মন্দিরের সাধক কমলাকান্তের কালীবাড়ি নামে জনসাধারণের কাছে এক ডাকে পরিচিত।
এই মন্দিরেই প্রতিমার পায়ে বেলকাঁটা লাগায় বেরিয়ে এসেছিল টাটকা রক্ত। সবাই অবাক হয়ে দেখেছিলেন সাধক কমলাকান্তের সাধনলীলা।
আরও এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন কমলাকান্ত।
এক অমাবস্যার দিনে বর্ধমানের মহারাজাকে দেখিয়েছিলেন পূর্ণিমার চাঁদ। মৃত্যুর সময় বেশিরভাগ, কি সাধারণ মানুষ, কি সাধক, সবাই পুণ্যসলিলা গঙ্গার স্পর্শ পেতে চান। আশ্চর্যের বিষয়, কমলাকান্ত মন্দির ছেড়ে গঙ্গায় যেতে চাননি। অথচ গঙ্গার স্পর্শ চেয়েছিলেন।
সাধক কমলাকান্তের মৃতদেহের পাশে হঠাৎ করে মাটি ফুঁড়ে জল এসেছিল। ভক্তদের বিশ্বাস, ওটা ছিল গঙ্গারই জল। সাধক কমলাকান্ত মন্দির ছেড়ে যেতে চাননি তো কী হয়েছে! অলৌকিক কৃপায় সেই পুণ্যাত্মাকে স্পর্শ করেছিল স্বয়ং মা গঙ্গা। সেই স্থান কুয়োর মতো বাঁধিয়ে রাখা আছে। আজও গঙ্গাজল হিসেবে কাজে লাগানো হয় সেই জল। ব্যবহার করা হয় পুজোর ভোগ রান্নায়। এতটাই বিশ্বাস ভক্তদের।
অমাবস্যায় নিজের হাতে মাটির কালীমূর্তি করে পুজো করতেন সাধক কমলাকান্ত। প্রতিদিনের ভোগে দিতেন মাগুর মাছ রান্না করে।
সাধক কমলাকান্তর কালীসাধনার কথা জানতে পেরে তাঁকে বর্ধমান নিয়ে আসেন তৎকালীন মহারাজ তেজচন্দ্র মহাতাব। এবং ওঁকে কালীপুজোপাঠের দায়িত্ব দেন। শুধু মন্দিরের দায়িত্বই নয়, তাঁর সাধনভজন ও পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে তেজচাঁদ কমলাকান্তকে সভাকবি নিযুক্ত করেন।
তাঁর মৃত্যুর পর মন্দিরেই সমাধিস্থ করা হয় কমলাকান্তকে। তাঁর সমাধির ওপরে মায়ের বেদি। কষ্টিপাথরের প্রতিমার পুজো হয় সারা বছরই। কালীপুজোয় তিনদিন ধরে উৎসব চলে এখানে।
বঙ্গদেশে শ্যামাসংগীত রচনায় জোয়ার এনেছিলেন দুই কালীসাধক। রামপ্রসাদ সেন আর কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। আজও আগমনি ও বিজয়ার পদকর্তা হিসেবে কমলাকান্তই সর্বশ্রেষ্ঠ।
আরও পড়ুন-মণিপুরের সংকট, ত্রাতা হতে পারে কেবল সংবিধান
সাধক রামপ্রসাদ
সময়কাল সপ্তদশ শতক।
এই সময়ে বাংলায় কালী মানে ছিল এক শ্মশানবাসিনী দেবী। একটা সময় পর্যন্ত কেবলমাত্র তান্ত্রিকেরাই শ্মশানে বা জনপদের বাইরে মা কালীর আরাধনা করতেন। সেই শ্মশানবাসিনী নিরাভরণ শাক্ত তান্ত্রিকদের কালীভক্ত রামপ্রসাদ সেনের সুবাদে হয়ে উঠছিলেন বাঙালির ঘরের মেয়ে। তাঁর রচিত গানে তিনি কালীকে কখনও মা বলে ডাকেন কখনও মেয়ে। যে সময় তান্ত্রিক-কাপালিকদের তন্ত্রসাধনার থেকে শত হাত দূরে থাকত তৎকালীন বঙ্গসমাজ। সেই সময়ে রামপ্রসাদ সেনের প্রসাদী গান বঙ্গদেশে ভক্তিভাবের জোয়ার আনল।
প্রথম জীবনে বেশ কিছুদিন কলকাতায় দুর্গাচরণ মিত্রের কাছারিতে হিসাবরক্ষকের কাজ করতেন।
কাজ করতে গিয়ে খাতায় একের পর এক লিখে ফেলতেন শ্যামাসঙ্গীত। কাছারির অন্য সদস্যরা অভিযোগ জানালে দুর্গাচরণ মিত্র দেখলেন খাতায় লেখা— ‘দে মা আমায় তবিলদারি আমি নিমকহারাম নই শঙ্করী’।
পড়ে মুগ্ধ হলেন দুর্গাচরণ মিত্র। খাতা লেখার কাজ থেকে মুক্তি তো দিলেনই, বাড়িয়ে দিলেন মাসিক ভাতা।
তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে সভাকবি করতে চাইলেও রাজার সভায় বিশেষ আগ্রহ ছিল না। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রামপ্রসাদকে একান্ন বিঘা নিষ্কর জমি দান করেন। রামপ্রসাদ এই দান ফেরালেন তাঁর ‘বিদ্যাসুন্দর কাব্য’ উৎসর্গ করে নদিয়ার মহারাজকে। কথিত আছে, বাংলা বিহার ওড়িশার নবাব সিরাজদৌল্লার দরবারেও শ্যামাসঙ্গীত শুনিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন রামপ্রসাদ।
তাঁর লেখা প্রসাদী গান ছাড়া আজও বাংলার কালীপূজা অসম্পূর্ণ। সাধকের সাধনায় তৃপ্ত হয়ে মা অনেকবার দেখা দিয়েছিলেন তাঁকে। এই নিয়ে রয়েছে নানা কাহিনি।
একদিন রামপ্রসাদ বাড়ির সামনে বেড়া বাঁধছিলেন। আর তাঁর ছোট মেয়ে হাতে দড়ি ধরিয়ে দিচ্ছিল। একসময় বালিকা উঠে চলে যায় কিন্তু প্রসাদ ঠিক হাতে দড়ি পেতে থাকেন। বেড়া বাঁধা চলতে থাকে। অনেক পরে মেয়ে ফিরে এসে বলে— ‘‘বাবা কে দড়ি ধরিয়ে দিল?’’
তখন প্রসাদের হুঁশ ফেরে যে, এতক্ষণ মেয়ে তাঁর কাছ থেকে ছিল না। বালিকারূপে তাঁর কাজে সাহায্য করেছেন স্বয়ং মহামায়া। এমন আরও বহু ঘটনা রয়েছে। প্রসাদের জীবনের শেষবেলায়। প্রতিবারের মতো সেবারেও কালীপুজোর আয়োজন করেছিলেন। পুজো শেষে মায়ের মূর্তি মাথায় নিয়ে বিসর্জন দিতে যান। ডুব দিতেই আচমকাই অন্যরকম হয়ে যান। প্রসাদ গলাজলে দাঁড়িয়ে পরপর চারটি গান করেন। শেষ গানটি গাইতে গাইতে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ভক্তদের মতে, মা গঙ্গাই তাঁকে টেনে নিয়েছিলেন। আজও রামপ্রসাদের ভিটেতে তাঁর পঞ্চবটীর আসন রয়েছে হালিসহরে। সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের জমিদারি ছিল। লোকমুখে রামপ্রসাদের কালীসাধনা ও জনপ্রিয়তার কথা জানতে পেরে সাবর্ণ বংশীয় জমিদাররাই কৃষিযোগ্য বাস্তবভিটা দান করেন এই সাধক কবিকে। শুধু তাই নয়, ‘কবিরঞ্জন’ উপাধিতেও ভূষিত করেন। ক্রমে ক্রমে এই ভিটেই রামপ্রসাদের ভিটে নামে পরিচিতি লাভ করে।
আরও পড়ুন-কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে দিল্লিতে আছেন হাসিনা
পরম ভক্ত শ্রীরামকৃষ্ণদেব
তরুণ পুরোহিত প্রথম যেদিন দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের বিগ্রহের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন, তখনও কিন্তু তিনি সাধক হয়ে ওঠেননি। তবে হৃদয়ের গভীর বিশ্বাস থেকে তিনি মা কালীকে মা বলে ডাকতেন। অবুঝ শিশুর কাছে জগতে তার সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, যাঁর কাছে সব কথা খুলে বলা যায়, যা খুশি আবদার করা যায়, আনন্দ দুঃখ ক্ষোভ অভিমান প্রকাশ করা যায় গদাধর-এর ‘মা’ ডাকের মধ্যে এই সবকিছুর সমন্বয় ছিল।
দেবীর পুজোয় শ্রীরামকৃষ্ণের কোনও পরিমিতিবোধ ছিল না। সময়-শৃঙ্খলার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত উদাসীন। প্রায়ই তিনি উচিত-অনুচিত সীমা পার করে ফেলতেন। বড় বিচিত্র ছিল তাঁর পুজোপদ্ধতি। কোনও সময় ফুল দিয়ে সাজাতেই পার করে ফেলতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কখনও আবার মা ফুল গ্রহণ করেছেন এই ভেবে ঘণ্টা তিনেক ধ্যানস্থ হয়ে থাকতেন। পুজোর মাঝখানে কখনও-বা পুজোর শুরুতে বা পুজোর শেষে একের পর এক গান গাইতেন হাতে তালি দিয়ে। প্রার্থনা করতে করতে চোখের জলে বুক ভাসাতেন তিনি। এই পুজোর রীতিনীতি নিয়ে অন্য পুরোহিতদের কাছে তিনি ছিলেন বিদ্রুপভাজন।
শ্রীরামকৃষ্ণ জগন্মাতার অস্তিত্ব অনুভব করছিলেন। উন্মত্তের মতো দিনের পর দিন গাছতলায় বসে ধ্যান করতেন। ব্যাকুল হয়ে মাকে ডাকতেন, আকুল হয়ে কাঁদতেন। কোনও কোনও সময় জ্ঞানও হারাতেন তিনি। সাধারণ পুজোর রীতিনীতি তিনি কোনওদিনই মানেননি। পুজোয় বসে ভক্তির প্রাবল্যে এমন অনেক আচরণ করেছেন যা হয়তো স্বাভাবিক দৃষ্টিতে উন্মাদনা। কিন্তু দৈবদৃষ্টি বা সেই ভক্তিভাব ছাড়া শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্যোন্মাদ অবস্থার অনুধাবন করা সাধারণ মানুষের সাধ্যাতীত।
ভক্তের আকুল আহ্বানে জগন্মাতাও তাঁকে নানাভাবে দর্শন দিয়েছিলেন। বালিকা রূপে, কখনও বারাঙ্গনা বেশে, কখনও আলো রূপে তো কখনও চৈতন্যরূপে।