বাংলার কালীতীর্থ

কালীঘাট, তারাপীঠ, দক্ষিণেশ্বর— সবার জানা। এর বাইরেও বিভিন্ন জেলায় আছে বেশকিছু কালীমন্দির। আজ কালীপুজোর দিন টুক করে ঘুরে আসতে পারেন। কলকাতা-সংলগ্ন কয়েকটি প্রাচীন কালীমন্দিরের সন্ধান দিলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

কৃষ্ণানন্দের কালী
বৈষ্ণব ভাবের পাশাপাশি শাক্ত ভাবেরও উদয় হয়েছিল প্রাচীন নদীয়ায়। নবদ্বীপের কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ প্রচলন করেন কালীপুজোর। প্রায় ৩৭৮ বছর আগে। নদিয়ার নবদ্বীপে আনুমানিক ১৬০০ সালে জন্মান কৃষ্ণানন্দ। পরে তন্ত্রশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তির জন্য ‘আগমবাগীশ’ উপাধি পান। তন্ত্রসাধনার আকর গ্রন্থ ‘বৃহৎ তন্ত্রসার’ তাঁরই সৃষ্টি। পরবর্তী সময়ে কৃষ্ণানন্দের বংশধরদের সঙ্গে পুজোও চলে আসে নদিয়ারই শান্তিপুরে। আজও চিরাচরিত প্রথা মেনে চলে আসছে সেই পুজো। এই দক্ষিণাকালীর পুজো হয় দীপান্বিতা অমাবস্যায়। কার্তিক মাসের পঞ্চমীতে। চিরাচরিত প্রথা মেনে আজও শান্তিপুরে কৃষ্ণানন্দের বংশধররা নিজহাতে তৈরি করেন মূর্তি। কোজাগরী পূর্ণিমার পর পঞ্চমী থেকে একাদশী পর্যন্ত ওই মূর্তিতেই করা হয় পুজো। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। পুজোর দিনে বহু ভক্তের সমাগম হয়। শান্তিপুর রেল স্টেশনে নেমে যাওয়া যায় এই মন্দিরে। যেতে পারেন টানা গাড়িতেও।
কঙ্কালেশ্বরী কালীমন্দির
পূর্ব বর্ধমান জেলার বর্ধমান শহরের কাছে কাঞ্চননগরে অবস্থিত বিখ্যাত নবরত্ন কালীমন্দির এই কঙ্কালেশ্বরী কালীমন্দির। দু-হাজার বছরের বেশি পুরোনো। ১৯১৩ সালে দামোদর নদের বন্যার সময় বর্ধমান শহরের পশ্চিমে নদীগর্ভ থেকে কালীর মূর্তিটি পাওয়া যায়। তিন ফুট চওড়া, পাঁচ ফুট লম্বা বিগ্রহ। মূর্তিটির সঠিক বয়স আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। দু-দিকে চারটি করে মোট আটটি হাত। মূর্তিটি অখণ্ড পাথরে খোদিত এবং মানবকঙ্কালের মতো দেখতে। বিগ্রহটি অষ্টভুজা, গলায় নরমুণ্ডমালা, পদতলে শিব ও তাঁর দুপাশে দুজন সহচরী দণ্ডায়মান। আটটি হাতে রয়েছে নরমুণ্ড, শঙ্খ, চক্র, ধনু, খড়্গ, পাশ ইত্যাদি। প্রতিমার দেহের শিরা-উপশিরার নিখুঁত ভাস্কর্য বর্তমান। শ্যামাকালী পুজোর দিন প্রচুর লোকসমাগম হয়। যাওয়া যায় বর্ধমান শহর থেকে। টানা গাড়িতেও যেতে পারেন।

আরও পড়ুন-দেওয়ালি-ছটপুজো, দুশ্চিন্তার ছায়া যমুনার জলে

হাজার হাত কালী
হাওড়ার শিবপুর অঞ্চলে অবস্থিত হাজার হাত কালীমন্দির। ১৮৮০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন তান্ত্রিক ভক্ত আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। জানা যায়, চণ্ডীর এই হাজার হাতের রূপ আসলে স্বপ্নাদেশে পাওয়া। চণ্ডীর ২২তম অধ্যায়ে দেবীর এই রূপের উল্লেখ রয়েছে। অসুর নিধনের সময় দেবী দুর্গা বহুরূপ ধারণ করেছিলেন। তার মধ্যেই অন্যতম হল হাজার হাতের রূপ। শোনা যায়, মন্দির তৈরির ইচ্ছা থাকলেও সেই সামর্থ্য ছিল না তান্ত্রিক আশুতোষের। কয়েকজন সহৃদয় ব্যক্তির সহযোগিতা পান। বর্তমানে সবকিছু দেখাশোনা করেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। নেই বলিদান প্রথা। শ্যামাকালী পুজোর দিন বিশাল ধুমধাম করে পুজো হয়। এছাড়াও প্রতিদিন হয় নিত্যপুজো। সারা বছর বহু মানুষ ভিড় জমান। কালীপুজোর রাতে ভিড় উপচে পড়ে। কলকাতার খুব কাছেই। ট্রেনে রামরাজাতলা এবং বাসে মন্দিরতলায় নেমে এই মন্দিরে যাওয়া যায়।
ব্রহ্মময়ী কালীমন্দির
উত্তর চব্বিশ পরগনার মূলাজোড় গ্রামে অবস্থিত প্রাচীন ব্রহ্মময়ী কালীমন্দির। কথিত আছে, কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার গোপীমোহন ঠাকুরের কন্যা ব্রহ্মময়ী বিবাহের দিন গঙ্গাস্নানের সময় ডুবে যান। তাঁর স্মৃতিতে গোপীমোহন এই নবরত্ন মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দির প্রাঙ্গণে বারোটি শিবমন্দির আছে। প্রতি অমাবস্যায়, রটন্তী-চতুর্দশীতে কালীপুজো এবং গোটা পৌষমাস ব্যাপী এখানে উৎসব হয়। শ্যামাকালী পুজোর দিন হয় বিশেষ পুজো। মন্দিরটি অবস্থিত একটি বাগানের মধ্যে। কালীবাড়িতে আনন্দশঙ্কর, গোপীশঙ্কর ও হরশঙ্কর নামে তিনটি বৃহৎ শিবলিঙ্গ রয়েছে। মন্দিরের পিছনে পৃথক দেবালয়ে রয়েছে গোপীনাথ জীউ বা শ্রীকৃষ্ণের একটি বিগ্রহ। ট্রেনে শ্যামনগর স্টেশনে নেমে যাওয়া যায়। হালিসহর খুব দূরে নয়। ঘুরে আসা যায় রামপ্রসাদের স্মৃতি বিজড়িত কালীমন্দির থেকেও।

আরও পড়ুন-কালীপূজার থিম ‘মায়ের ওই রাঙা চরণ’ মণ্ডপ জুড়ে অসমের ‘মূলি’ বাঁশের কারুকাজ

হংসেশ্বরী কালীমন্দির
হুগলির বাঁশবেড়িয়ায় অবস্থিত হংসেশ্বরী কালীমন্দির। রাজা নৃসিংহদেব ১৭৯৯ সালে এই মন্দির নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ১৮১৪ সালে তাঁর বিধবা স্ত্রী রানিশঙ্করী মন্দির নির্মাণ শেষ করেন। মন্দিরের গর্ভগৃহের উচ্চতা ৭০ ফুট। গোলাকার বেদির উপর পাথরে নির্মিত শায়িত শিবমূর্তির নাভি থেকে উদ্গত প্রস্ফুটিত পদ্মের উপর দেবী হংসেশ্বরীর মূর্তি নির্মিত। দেবীমূর্তি নীলবর্ণা। ত্রিনয়নী, চতুর্ভুজা, খড়্গধারিণী, নরমুণ্ডধারিণী। এই মন্দিরে নিত্য পুজোপাঠের ব্যবস্থা আছে। ভক্তজন প্রতিদিন ভোগ নিবেদন করতে পারেন। দ্বিপ্রহরে মন্দিরের গর্ভগৃহ বন্ধ থাকে। বেলা আড়াইটায় আবার খুলে দেওয়া হয়। শ্যামা কালীপুজোর দিন অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ পুজো। ভিড় জমে ভালই। বাঁশবেড়িয়া স্টেশনে নেমে যেতে হয়।
ধন্বন্তরী কালী
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার মজিলপুর শহরে অবস্থিত একটি বিখ্যাত কালীমন্দির ধন্বন্তরী মন্দির। সপ্তদশ শতাব্দীতে তন্ত্রসাধক ভৈরবানন্দ ধন্বন্তরী কালীবিগ্রহ খুঁজে পান এবং কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের গর্ভগৃহে কাঠের তৈরি সালঙ্কারা ত্রিনয়নী কালো কষ্টিপাথরে নির্মিত দক্ষিণাকালী বিগ্রহ অবস্থিত। কারুকার্যময় রথসিংহাসনে পদ্মে শায়িত শিববিগ্রহের বুকের উপর তিনি দণ্ডায়মানা। সারা বছর বহু মানুষের ভিড় হয়। শ্যামাকালী পুজোর দিন উপচে পড়ে ভিড়। জয়নগর মজিলপুর স্টেশনে নেমে যেতে হয়।

Latest article