লেখকদের লেখক কমলকুমার

দুরূহতম লেখকদের একজন কমলকুমার মজুমদার। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। দুরূহতার মধ্যেও ছিলেন যথার্থ আধুনিকমনস্ক, সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা একজন অসাধারণ কথাকার। আগামিকাল জন্মদিন। স্মরণ করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

জনপ্রিয় লেখক বলতে যা বোঝায়, তা ছিলেন না কমলকুমার মজুমদার। লিখেছেন নিজের মতো করে। অগণিত পাঠকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার বাসনা তাঁর কোনওকালেই ছিল না। মাস নয়, বিশ্বাসী ছিলেন ক্লাসে। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি চুটিয়ে করেছেন শিল্পচর্চা।
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান ঔপন্যাসিক তিনি। আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।
জন্ম ১৯১৪-র ১৭ নভেম্বর। উত্তর ২৪ পরগনার টাকি শহরে। বাবা প্রফুল্লকুমার মজুমদার। মা রেণুকাময়ী। বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার। মা ছিলেন বাড়ির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের এক নিবেদিত প্রাণ। কমলকুমারের ছোটবেলাটা সেই সাংস্কৃতিক পারিবারিক আবহাওয়াতেই কেটেছে। কলকাতার রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে তাঁদের একটা ভাড়াবাড়ি ছিল।

আরও পড়ুন-বন্ধ রেলের বন্দে ভারত রেস্তোরাঁ

ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। সেইসঙ্গে ছিলেন দুষ্টু। তিনি এবং তাঁর ভাই বাবার স্বাক্ষর নকল করে রোজ রোজ ছুটি নিতেন। পরে এই দুষ্টুমির কারণেই তাঁদের দুই ভাইকে ভর্তি করা হয়েছিল সংস্কৃত টোলে। সেখানে সংস্কৃত শেখার চেয়ে তাঁদের উৎসাহ ছিল নানারকম মজার কাণ্ডে। টোলে ভর্তি হয়েই মাথা ন্যাড়া করে টিকি রাখেন। মা জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন, টোলে পড়লে অমনি টিকি রেখেই পড়তে হবে। না হলে সংস্কৃত শেখা যাবে না। ফ্রেঞ্চ শিখতে গিয়েও নানা কাণ্ডকারখানা ঘটিয়েছিলেন।
যৌবনের সূচনায় জড়িয়েছিলেন জাহাজের আমদানি-রফতানি, মাছের ভেড়ি প্রভৃতি ব্যবসায়। হাতে এসেছিল কাঁচা টাকা। চলাফেরা, পোশাক-আশাকে হয়ে উঠেছিলেন রীতিমতো সাহেব। সিনেমা নিয়েও ছিলেন তুমুলভাবে আগ্রহী। গত শতকের চারের দশকে কফিহাউসে কলকাতার চলচ্চিত্র আন্দোলনকর্মীদের আড্ডার পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। তাঁর পাশাপাশি সত্যজিৎ রায়, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, পরিতোষ সেন, চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়রা আড্ডা দিতেন। এখান থেকেই গঠিত হয়েছিল ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’ । সোসাইটির উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসটি চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। কমলকুমারকে দায়িত্ব দেওয়া হয় শিল্প নির্দেশনার। সত্যজিতের দায়িত্ব ছিল চিত্রনাট্য রচনার। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘অভাগীর স্বর্গ’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’ চলচ্চিত্রের জন্য দুই হাজারের বেশি স্কেচ করেছিলেন কমলকুমার। যদিও এর কোনওটিই সেই সময় শেষ পর্যন্ত আর নির্মিত হয়নি।
পাঁচের দশকে নির্মিত হয়েছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে ‘পথের পাঁচালী’। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায়। এই ছবির ডিটেলের কাজগুলো করেছিলেন কমলকুমারের। তবে ‘পথের পাঁচালী’ পরবর্তী সময়ে বিশ্বজয় করলে, সেটা তাঁর একেবারেই পছন্দ হয়নি। ছবিটি সম্পর্কে উচ্চারণ করেননি প্রশংসাসূচক বাক্য। পুরো ছবিতে অপু-দুর্গার চিনিময়রার পেছনে ছোটার দৃশ্যটুকুই নাকি তাঁর ভাল লেগেছিল। পরে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ছবি বানিয়ে কমলবাবুকে তৃপ্ত করার মতো ক্ষমতা আমার নেই।
পরনিন্দা, পরচর্চা এবং অন্যদের চরিত্রহরণকে কমলকুমার নিয়ে গিয়েছিলেন শিল্পের পর্যায়ে। অতীত এবং সমকালীন কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে ঠাট্টা রসিকতা করতে ছাড়তেন না। কিন্তু আড়ালে যাঁকে নিয়ে ঠাট্টা রসিকতা করতেন, দেখা যেত কাজের ক্ষেত্রে তাঁকেই সম্মান করছেন বেশি। তিনি নিজেই অন্যের নিন্দা-মন্দ করতেন বটে, কিন্তু অপরের মুখে সেই ব্যক্তির নিন্দা সহ্য করতে পারতেন না।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

সব সময় পরতেন পাঞ্জাবি। নতুন পাঞ্জাবি কেনার পর প্রথমেই তাতে পানের পিক লাগিয়ে ময়লা করে তারপর পরতেন। পকেটে কখনও টাকা রাখতেন না। তাঁর হাতে সব সময় থাকত একটি চটের থলে। টাকা-পয়সা রাখতেন সেই থলের ভেতরে রাখা কোনও দুর্লভ বইয়ের মধ্যে। ট্রামের ভাড়া চাওয়ার পর স্বভাবতই টাকা খুঁজে বের করতে সময় লাগত। এই নিয়ে কন্ডাক্টরের সঙ্গে তাঁর ঝগড়া লেগে যেত। একবার কন্ডাক্টরকে নাক বরাবর ঘুসি বসিয়ে দিয়েছিলেন। বিষয়টি গড়িয়েছিল পুলিশ পর্যন্ত।
দুরূহতম লেখকদের একজন কমলকুমার। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁকে বলা হত ‘লেখকদের লেখক’। ১৯৬৯ সালে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘অন্তর্জলি যাত্রা’ প্রকাশিত হয়। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘নিম অন্নপূর্ণা’। পরবর্তী গ্রন্থাবলি ‘গল্পসংগ্রহ’, ‘পিঞ্জরে বসিয়া শুক’, ‘গোলাপ সুন্দরী’, ‘অনিলা স্মরণে’, ‘শ্যাম-নৌকা’, ‘সুহাসিনীর পমেটম’ প্রভৃতি। দীক্ষিত পাঠকের কাছে অবশ্যপাঠ্য লেখক হিসেবে সমাদৃত হলেও, এখনও পর্যন্ত সাধারণের মধ্যে পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেননি।
তাঁর বেশকিছু উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পরিচালনা করেছিলেন ‘নিম অন্নপূর্ণা’। গৌতম ঘোষ নির্মাণ করেন ‘অন্তর্জলি যাত্রা’। অপর্ণা সেনের ‘সতী’ এবং বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘তাহাদের কথা’র মতো ছবিগুলো কমলকুমারের লেখা উপন্যাস ও গল্পের উপর ভিত্তি করে তৈরি। গৌতম ঘোষ তাঁর উপন্যাস ‘অন্তর্জলি যাত্রা’ অবলম্বনে ‘মহাযাত্রা’ নামে একটি হিন্দি ছবি তৈরি করেন।
১৯৭৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হন কমলকুমার মজুমদার। লেখক হিসেবে যেমন বড় ছিলেন, তেমনই ভেতরে ভেতরে ছিলেন শিশুর মতো সরল। দূর থেকে নয়, তাঁকে জানতে হলে ডুব দিতে হবে তাঁর সৃষ্টি-সাগরে। তবেই বোঝা যাবে, দুরূহতার মধ্যেও তিনি ছিলেন যথার্থ আধুনিকমনস্ক, সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা একজন অসাধারণ কথাকার।

Latest article