কঠোরে কমলে

দাপিয়ে অভিনয় করেছেন উত্তমকুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, পাহাড়ি সান্ন্যালের মতো তাবড় অভিনেতাদের সঙ্গে। ছিল দৃপ্ত চেহারা আর অননুকরণীয় বাচনভঙ্গি। দাপুটে বাবা তাঁর মতো আর কেউ নেই। তিনি কিংবদন্তী অভিনেতা কমল মিত্র। আগামী ৯ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন। সেই দিনকে স্মরণে রেখে লিখলেন শঙ্কর ঘোষ

Must read

কঠিন রাশভারী বাবা
এলাহাবাদের বিখ্যাত শিল্পপতি বি কে রায়ের পুত্র প্রশান্ত। বাবার ব্যবসা পুত্রকে আকর্ষণ করে না। এদিকে সুইস ফার্মের ২ লক্ষ টাকার লোকসান যখন পিতাকে দিতে হয়, সেই দিন পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছয়। পুত্রের মুখে গানের রেকর্ডিং-এর কথা শুনে পিতা স্পষ্ট উচ্চারণ করেন, ‘‘তোমাকে আমার ছেলে বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করছে’’— Irresponsible, Worthless এইসব বিশেষণ জোটে প্রশান্তের কপালে। পিতা লোহালক্কড়ের কারবার করার জন্য গানকে মর্যাদা দেন না। তাই পুত্রও ছাড়বার পত্র নন। পরিণতিতে পিতাকে প্রশান্ত বলেন, ‘‘তাহলে আপনি বলতে চান যে গান গাইলে আপনার শেল্টারে থাকা চলবে না?’’ পিতার দম্ভোক্তি, ‘‘বলতে চান নয়, বলছি।’’ এতক্ষণে পাঠকেরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন কোন ছবির দ্বন্দ্বের কথা আপনাদের সামনে আমি তুলে ধরলাম। ঠিকই ধরেছেন সেটি হল সর্বকালের জনপ্রিয় রোম্যান্টিক কমেডি ছবি ‘দেয়ানেয়া’। সেখানে পিতা বি কে রায়ের ভূমিকাতে কমল মিত্র আর তাঁর পুত্র প্রশান্তর চরিত্রে মহানায়ক উত্তমকুমার। কমল মিত্র ওই চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন পর্দায়, দর্শকেরা তা দেখেছেন। বাবা মানেই রাশভারী এবং কঠোর অথচ অন্তরে স্নেহ তার অপার এমন এক অভিব্যক্তি নিয়ে যদি কাউকে ভাবা যায় তবে তিনি হলেন অভিনেতা কমল মিত্র।
বাংলা ছায়াছবির সেই স্বর্ণযুগে ‘বাবা’ নামক চরিত্রটিতে অভিনয় করে যাঁরা দর্শকদের মনে স্থায়ী দাগ কাটতে পেরেছিলেন তাঁদের মধ্যে অভিনেতা কমল মিত্র অন্যতম। ‘দেয়ানেয়া’কে বাদে যে চরিত্রটিতে তাঁর অভিনয়-জীবনে স্মরণীয়।

আরও পড়ুন-ঝাঁটা হাতে রাস্তায় নামলেন সপারিষদ পুরপ্রধান সুনীল

ফ্ল্যাশব্যাক
কমল মিত্রের জন্ম ১৯১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বর্ধমানে। পিতামহ ডাক্তার জগদ্বন্ধু মিত্র ছিলেন নামকরা চিকিৎসক। বাবার নাম নরেশচন্দ্র মিত্র ছিলেন বর্ধমানের প্রখ্যাত আইনজীবী ও বর্ধমান মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান। মায়ের নাম সুহাসিনী দেবী। বর্ধমান রাজ কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। বর্ধমান রাজ কলেজিয়েট কলেজেও কিছুদিন পড়াশোনা করেছিলেন। বাবা বর্ধমান শহরের নাম করা আইনজীবী ছিলেন। ম্যাট্রিক পাশ করে সেই কলেজেই ভর্তি হলেন কমল মিত্র। স্কুলে পড়াকালীন একবার ‘মহারাষ্ট্র গৌরব’ নাটকে শিবাজির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। বর্ধমান সিনেমা হাউসে ‘আলমগীর’ নাটকে রাজসিংহের ভূমিকায় কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তারপরে বর্ধমানের ‘বিমল মেমোরিয়াল ক্লাব’ থেকেও অভিনয় করেন। তাঁর বাবা এসব পছন্দ করতেন না। ছেলের অভিনয়ের ব্যাপারে তাঁর বাবার তীব্র আপত্তি ছিল। এ সময় অবশ্য কমল মিত্রের চাকরি জীবন। সেই সময় বাবা চক্ষুরোগে দৃষ্টিশক্তিহীন হয়ে পড়লে সংসারের দায়-দায়িত্বের কথা ভেবে কমল মিত্র মিলিটারিতে নাম লেখান। পরে বাবা বর্ধমান মহারাজকে ধরে কমল মিত্রকে ফিরিয়ে আনেন এবং সরাসরি সরকারি কালেক্টারি অফিসে চাকরি করিয়ে দেন। শুরুর দিকে চেয়ার টেবিল না থাকায় অফিসের বারান্দায় মাদুর পেতে কাজ করেছেন। এতসবের মাঝেও অভিনয় ছাড়েননি। অভিনয় শিক্ষার কোনও প্রথাগত পাঠ তাঁর ছিল না। তিনি নিজেই তাঁর স্মৃতিকথায় এমনই একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন, “এক ছুটির দিন বৈঠকখানা ঘরে বসে ‘জনা’ নাটকের প্রবীরের অংশ ‘দাও মাগো সন্তানে বিদায়, চলে যাই লোকালয় ত্যাজি’ এই অংশটি বেশ জোরেই পড়ছিলাম। আমি যখন পড়ছিলাম, বর্ধমানের একমাত্র নাট্যশিক্ষক স্বর্গীয় প্রমোদীলাল ধৌন সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার নাটক পড়া শুনে আমাদের বৈঠকখানায় ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী পড়ছিস রে?’ আমার কাছে সব কথা শুনে বললেন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে, মায়ের সঙ্গে অভিমান করে কীভাবে কথা বলতে হয় জানো না? মাকে মারতে যাচ্ছিস নাকি?’ কিন্তু তিনি অত কথা বললে কী হবে? আমার তো সে সময় বীররস ছাড়া অন্য কোনও রসে যে নাটক অভিনীত হতে পারে, সে ধারণাই ছিল না। এই প্রমোদবাবুই আমার সর্বপ্রথম নাট্যশিক্ষক।’’ তাঁর জীবনে এসছেন দু’জন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ— শিশিরকুমার ভাদুড়ী এবং দেবকীকুমার বসু। কমল মিত্র তখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, চাকরি ছেড়ে অভিনয়ই করবেন তিনি। বারণ করলেন দেবকীকুমার। এখনই এমন সিদ্ধান্ত নিলে বড়ই মুশকিল…। এত সহজে হেরে যাওয়ার পাত্র তো কমল মিত্র ছিলেন না। অভিনয় করতে গেলে কেবল সিনেমা নয়, থিয়েটারও করতে হবে। নিজের সঙ্গেই চলছে লড়াই। তখনও বর্ধমানে আছেন তিনি। সময় সুযোগ পেলেই চলে যেতেন দামোদরের তীরে। এক পাড়ে দাঁড়িয়ে শুরু হত সংলাপ বলা; আস্তে আস্তে নয়, রীতিমতো চিৎকার করে। অভিব্যক্তি এতটুকুও কম হলে চলবে না, আবার গলার আওয়াজও তৈরি করতে হবে। মঞ্চে উঠলে যেন রোয়ের শেষ মানুষটিও তাঁর গলা শুনতে পায়। যতদিন না সেই আওয়াজ দামোদরের ওপার থেকে একইভাবে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসত, ততদিন চলত এই কাজ। সেই দেবকীকুমার বসুই তাঁকে সুযোগ দেন হিন্দি ছবি ‘রামানুজ’-এ। দেবকীবাবু সুযোগ দেন হিন্দি ছবি ‘সরগ সে সুন্দর দেশ হামারা’ ছবিতে। মাত্র ২০০ টাকায় চুক্তি হল। ছবিটি শেষ পর্যন্ত অবশ্য মুক্তি পায়নি। তাঁর অভিনয় পছন্দ হয়েছিল দেবকী বসুর। তবুও পারিশ্রমিকটুকু হাতে তুলে দিয়ে তাঁকে শুনিয়েছিলেন সাবধানবাণী, ‘‘আপনি কখনও নায়ক করবেন না। আপনি চরিত্রাভিনয় করবেন।’’ সারাজীবন এই গুরুবাক্যে মেনেই চলেছেন তিনি।

আরও পড়ুন-বার কাউন্সিল ভোটে মহিলাদের জন্য ৩০% আসন সংরক্ষণ

অভিনয়ের নির্যাস
১৯৪৪ সালে কমল মিত্র চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। নাট্যাভিনয়ের প্রতি কমল মিত্র আকৃষ্ট ছিলেন বরাবর। ইতিমধ্যে শৌখিন নাট্যাভিনয়ে তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি হয়। এই সুবাদে আসানসোলের এসডিও তাঁকে কলকাতায় পেশাদারি রঙ্গালয় যোগ দিতে পরামর্শ দেন। কারণ তখন পেশাদারি রঙ্গমঞ্চগুলি (স্টার, মিনার্ভা, বিশ্বরূপা, রংমহল) রমরমিয়ে চলছে। প্রখ্যাত অভিনেতা। বিপিন গুপ্ত স্টার থিয়েটারের মহেন্দ্র গুপ্তর সঙ্গে কমল মিত্রর পরিচয় করিয়ে দেন। ওই থিয়েটারের ‘টিপু সুলতান’ নাটকে ব্রেকওয়েট চরিত্রের মাধ্যমে তাঁর পেশাদারি রঙ্গালয়ে প্রথম অবতারণা এবং সেইখানে ওই রূঢ় কঠিন চরিত্রটিকে তিনি অত্যন্ত বাস্তবায়িত করে তুলতে পেরেছিলেন। ঘটনাচক্রে তিনি পরিচিত হন সেই সময়ের স্বনামধন্য পরিচালক গুণময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সুযোগ পান ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয়ের। ছবির নাম ‘নীলাঙ্গুরীয়’।
চরিত্রায়ণের ধারাবাহিকতা
বারংবার বড়পর্দায় তাঁকে যে সব চরিত্রের জন্য ডাকা হয়েছে তার মূলে অবশ্যই ছিল তাঁর দীর্ঘ দেহ, বজ্রকঠিন কঠোর কণ্ঠস্বর; যা ওইসব চরিত্রের সঙ্গে সর্বদাই মানানসই ছিল। পাশাপাশি আরেক ধরনের চরিত্রে কমল মিত্রের ডাক পড়েছে বারংবার, সেটি হল নায়ক বা নায়িকার বাবার চরিত্রে, যে-বাবা উচ্চবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি, যিনি টাকার অঙ্কে সবকিছুর মূল্যায়ন করেন। যিনি নায়িকার বাবা হওয়ার সময় দরিদ্র নায়ককে অপমান করেন আবার নায়কের বাবা হওয়ার সময় গরিব নায়িকাকে অপমান করেন। তাঁর অভিনয়-গুণে এইসব চরিত্র বাস্তবসম্মত মনে হত। ধরা যাক অগ্রগামী পরিচালিত ‘শিল্পী’ ছবির কথা। নায়িকা অঞ্জনা (সুচিত্রা সেন) গরিব নায়ক ধীমানকে (উত্তমকুমার) মন দিয়ে বসে আছেন। এইসব কথা জানার পর দাম্ভিক ধনাঢ্য পিতা দরিদ্র নায়ককে বাড়ি থেকে বার করে দেন। অগ্রদূত পরিচালিত ‘চিরদিনের’ ছবিতে ইন্দ্রাণী (সুপ্রিয়া দেবী) দরিদ্র তাপসকে (উত্তমকুমার) মন দিয়ে বসেন। এটি জেনে নায়ককে অপমানিত করে ঘর ছাড়তে বাধ্য করেন পিতা। হীরেন নাগ পরিচালিত ‘সাবরমতী’ ছবিতে যশোমতীর (সুপ্রিয়া দেবী) বাবা হিসেবে বিরাট শিল্পপতি চূড়ান্ত অপমান করেন দরিদ্র শঙ্করকে (উত্তমকুমার)। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ‘পিতা পুত্র’ ছবিতে স্বরূপ দত্তের বাবা হিসেবে। একই ব্যাপারগুলি ঘটেছে শিল্পপতি চন্দ্রমাধব সেনরূপে ‘থানা থেকে আসছি’ ছবিতে তিনি নায়িকা অঞ্জনা ভৌমিকের বাবা হিসেবে, ‘কাল তুমি আলেয়া’ ছবিতে অজয় গঙ্গোপাধ্যায়ের বাবা হিসেবে, ‘জীবন রহস্য’ ছবিতে নায়িকা মাধবী মুখোপাধ্যায়ের বাবা হিসেবে, ‘খেলার পুতুল’ ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাবা হিসেবে। ‘সাগরিকা’ ছবিতে তিনি মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল হওয়ার সুবাদে নায়ক উত্তমকুমারের বিদেশযাত্রা পথ থেকেই বাতিল করে দেন।
পৌরাণিক ছবিতেও বিকল্পহীন
ধর্মমূলক ছবিগুলিতে কমল মিত্রের বিকল্প কেউ ছিলেন না। বিশেষ করে নির্মম নিষ্ঠুর পৌরাণিক চরিত্রগুলির রূপায়ণের ক্ষেত্রে। যেমন ‘কংস’ ছবিতে তিনি কংস। কংসকে পর্দার বুকে জীবন্ত করে তুললেন কমল মিত্র। ‘সতীর দেহত্যাগ’ ছবিতে তিনি দক্ষরাজ জামাই শিবকে দু’চোখে দেখতে পারেন না। তাই বদ্ধপরিকর হন শিবহীন যজ্ঞ করার জন্য। ভুলেও তিনি দেখলেন না যে এতে তাঁর কন্যা সতী (দীপ্তি রায়) কতখানি বেদনাহত হতে পারেন। সেই কঠিন দক্ষরাজকে জীবন্ত করে তুললেন কমল মিত্র। তিনি ‘মহিষাসুর বধ’ ছবিতে মহিষাসুর। ‘তরণীসেন বধ’ ছবিতে তিনি রাবণ। বিভীষণ-পুত্র তরণীসেন রাবণের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। একদিকে তরণীসেনের প্রতি প্রবল বাৎসল্য এবং অপরদিকে রাবণের অনমনীয় তেজ। এই দুটি রূপ শিল্পীর অভিনয়-গুণে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আবার তিনি দক্ষরাজের ভূমিকাতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ‘দক্ষযজ্ঞ’ ছবিতে। সেখানে সতীর ভূমিকায় ছিলেন মহুয়া রায়চৌধুরী। জীবনীমূলক ছবিতে তাঁকে এইরকম কঠিন কঠোর রূপেই দেখেছি। বিজয় বসু পরিচালিত ‘রাজা রামমোহন’ ছবিতে তিনি রামমোহনের পিতা। বিধর্মী পুত্রকে (বসন্ত চৌধুরী) তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ক্ষমা করতে পারেননি।

আরও পড়ুন-চরম বিশৃঙ্খলা, যাত্রী- হয়রানি, বেলাগাম টিকিটমূল্য: মনিটরিং কোথায় কেন্দ্রের?

অনন্য প্রতিভায়
কমল মিত্রের অসাধারণ অভিনয় গুণ দর্শকের স্মৃতি পটে ভাস্কর হয়ে থাকবে জরাসন্ধের ‘লৌহ কপাট’ ছবির জন্য। উপন্যাসের কুখ্যাত ডাকাত সরদার বদরুদ্দিন মুন্সি এক স্মরণীয় চরিত্র। তপন সিংহ পরিচালিত ‘লৌহ কপাট’ ছবিতে ওই চরিত্রের অসাধারণ অভিনয় দর্শকরা ভুলতে পারবেন না। বদরুদ্দিন গ্রেফতার হয়েছেন। সঙ্গীদের নাম অবশ্য পুলিশকে জানাননি। কিন্তু জেলখানার মধ্যে আত্মহত্যা করেন। নীরেন লাহিড়ী তাঁকে সুযোগ দেন ‘বনফুল’ ছবিতে। তারপর যে ছবি তাঁকে খ্যাতি এনে দেয় তার নাম ‘৭ নম্বর বাড়ি’। পাশাপাশি স্টার থিয়েটারে অভিনয় চলতে থাকে। অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘সংগ্রাম’ ছবিতে দাদুর চরিত্রে সুযোগ এনে দেন সেই ছবিতে অভিনয় করে সুনাম অর্জন করেছিলেন তিনি। আবার অগ্রদূত পরিচালিত তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি নিয়ে তৈরি ‘বিপাশা’ ছবিতেই তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যে যেভাবে এক শিখ বৃদ্ধের চরিত্রে অভিনয় করেন তা মনে রাখার মতো।
স্মরণীয় চরিত্রায়ণ
বেশ কিছু ছবিতে তিনি তাঁর অভিনয় গুণে দর্শকদের মনে ঠাঁই করে নিয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছে সমাপিকা, সংকল্প, জিঘাংসা, দুর্গেশনন্দিনী, প্রফুল্ল, শাপমোচন, একটি রাত, সাগরিকা, ত্রিযামা, বৌদি, চৌরঙ্গী, সূর্যতোরণ, যৌতুক, হসপিটাল, আশায় বাঁধিনু ঘর, শেষচিহ্ন, রক্তপলাশ, হাইহিল, তাপসী, মণিহার, সুশান্ত শা, রাজদ্রোহী, জীবনমৃত্যু, তিন ভুবনের পারে, বন্ধু, যদি জানতেম, দিন আমাদের প্রভৃতি ছবিতে। চলচ্চিত্রে কমল মিত্রের শেষ অভিনয় তরুণ মজুমদার পরিচালিত ‘খেলার পুতুল’ ছবিতে (১৯৮৩)। ‘দর্পচূর্ণ’ ছবিতে তিনি কানন দেবীর স্বামী হয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি তাঁর স্ত্রী হিসেবে অধিকাংশ ছবিতে ছায়া দেবীকে পেয়েছেন। কখনও কখনও পেয়েছেন মলিনা দেবীকে। সুচিত্রা সেনের স্বামী হয়েছিলেন ‘একটি রাত’ ছবিতে।

আরও পড়ুন-এবার SIR-এর কাজের চাপে জগৎবল্লভপুরে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি বিএলও

মঞ্চাভিনয়
বিপিন গুপ্তের সহায়তায় ১৯৪৪ সালে স্টার থিয়েটারে মাসিক ৫০ টাকায় তিনি যুক্ত হয়েছিলেন। এরপর মিনার্ভা থিয়েটার সঙ্গে যুক্ত হন। ষাট এর দশকে যাত্রা যে একটু একটু করে সর্বশ্রেণির মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিল, কমল মিত্র বেশ কিছুদিন যাত্রার আসরেও অভিনয় করেছিলেন।
অবশ্যই মনে রাখার মতো তাঁর থিয়েটারগুলির কথা। স্টার থিয়েটারের ‘কেদার রায়’ নাটকে তিনি মুকুট রায়, শ্রীরামকৃষ্ণ নাটকে মথুরবাবু, কঙ্কাবতীর ঘাটে নন্দুয়া, শেষাগ্নি নাটকে ভুবন, কারাগার নাটকে কংস, তাপসী নাটকে ভবেন্দ্রনাথ, শ্রেয়সী নাটকে কমল বিশ্বাস। মিনার্ভা থিয়েটারের গৈরিক পতাকা নাটকের শিবাজি চরিত্র অভিনয় করেন। তারপর তপোভঙ্গ ছবিতে অভিনয় করেন। সীতারামের নাম ভূমিকায়, কর্ণার্জুন নাটকে দুর্যোধন। শিক্ষা, অভিজাত্য, রুচি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হলেও তাঁর অভিনয়ের ক্ষমতা ছিল সবার উপরে। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীর ডাকে শ্রীরঙ্গম মঞ্চে রিজিয়া, আলমগির, সীতা প্রভৃতি নাটকে বিশিষ্ট চরিত্রগুলিতে তিনি অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। অভিনয় করেছেন বেতার নাটকেও। রংমহলে দুই পুরুষ নাটকে জমিদার শিবনারায়ণ। রঙ্গনা থিয়েটারের চন্দ্রনাথ নাটকে মণিশঙ্কর চরিত্রে তাঁর স্মরণীয় অভিনয়। তাঁর শেষ অভিনয় নেতাজি সুভাষ ইনস্টিটিউটে ‘সোনার খোঁজে’ নাটকে এক ডিটেকটিভ অফিসারের ভূমিকায় (১৯৮৩)।
তাঁর এলগিন রোডের বাড়িতে যিনি গেছেন তিনি জানেন তাঁর বইয়ের সংগ্রহের কথা। নিজের সংগ্রহের যাবতীয় বই তিনি দান করে গেছেন নন্দনকে। প্রায় চল্লিশ বছরের অভিনয় জীবনের কথা লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছেন ‘ফ্ল্যাশব্যাক’ গ্রন্থে। ১৯৯৩ সালের ২ অগাস্ট কমল মিত্রের দেহাবসান হয়। দৃপ্ত চেহারা আর অননুকরণীয় বাচনভঙ্গির সাহায্যে চলচ্চিত্র ও মঞ্চ উভয় ক্ষেত্রে তিনি নিজের প্রতিভার পরিচয় অভিনেতা হিসেবে রেখে গেছেন। এই প্রজন্মের দর্শকরা বিভিন্ন চ্যানেলে তাঁর অভিনীত ছবিগুলি দেখে এখনও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েন। সেখানেই রয়েছে শিল্পীজীবনের চরম সার্থকতা।

Latest article