কণাদ দাশগুপ্ত : নির্বাচনে ৭৪-এ আটকে (৭৭ মাইনাস মুকুল রায়, নিশীথ প্রামানিক, জগন্নাথ সরকার = ৭৪)
বঙ্গ-বিজেপি’র একাংশ তেড়েফুঁড়ে নেমেছে বাংলায় ৩৫৬ ধারা লাগু করার বা রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবিতে৷ কলকাতায় বসে এসব বলা কছুটা ঝুঁকির বলে, হয় জেলায় গিয়ে বা দিল্লিতে পা রেখে এই আওয়াজ তোলা হচ্ছে৷
একে তো ভোটের সময় শ’য়ে শ’য়ে হিন্দিভাষী নেতাকে রাজার পার্ট দিয়ে এ রাজ্যে বিজেপি নিজেদের গায়ে ‘বাঙালি-বিরোধী’ তকমা সাঁটিয়েছে৷ ভোটে হেরে এবার ৩৫৬-র দাবি তুলে বাকিটা নিশ্চিহ্ন করার হারাকিরি-তেও মেতেছে গেরুয়া শিবিরের একাংশ৷
বিজেপির যে অংশ এখন ৩৫৬-র ধুয়ো তুলছেন, তাঁরা কি জানেন কীভাবে, কোন পরিস্থিতিতে কোনও রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয় ? শিক্ষার অভাব থাকতেই পারে, তা পড়াশুনো করলে দূর হবে৷ কিন্তু যারা সব কিছু জেনে শুনে নিজেদের দলের নেতা-কর্মীদের এই সব বলে তাতাচ্ছেন, তাঁদের অপরাধ হাজার গুণ বেশি৷ এরা বিপদে ফেলছেন নেতা-কর্মীদের৷
আরও পড়ুন-নিশীথ প্রামাণিক কি বাংলাদেশি? নিপুনের চিঠি উদ্ধৃত করে বিস্ফোরক টুইট ব্রাত্য বসুর
এই সব উল্লাস বা আর্তনাদ অর্থহীন, দেশে ৩৫৬ প্রয়োগ এখন অত সহজ নয়। ২১৩ আসন পেয়ে রাজ্যে ক্ষমতায় আসা একটি সরকারকে ফেলে দিয়ে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা অত মসৃন না’কি ?
দেশের যে কোনও রাজ্যে নির্বাচিত সরকার বিপাকে পড়লে এবং/অথবা বিরোধী দল ক্ষমতাশালী হয়ে উঠলে আর পাঁচটা দাবির মতো সে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার দাবি এখন মোটামুটি জলভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসলে এ সব দাবি যে রাজনীতিবিদরা বলেন, হয় তাঁরা সরকারকে চাপে রাখার জন্য বলেন, নয়তো এই রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার আইনি প্রেক্ষাপট না জেনেই বলে দেন। নির্বাচিত সরকার ফেলে দেওয়া এখন এত সহজ কোনও বিষয় নয় যে দাবি তুললাম আর সংবিধানের ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে রাষ্ট্রপতি সেই রাজ্যের শাসনভার নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। তবে যে কোনও বিরোধী রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে এই দাবি ব্যবহৃত হচ্ছে, এমন নজির অজস্র আছে। সেই দাবি তোলা বা সেই দাবির ভিত্তিতে আন্দোলন করা একেবারেই অন্যায় হয়তো নয়, কিন্তু একদমই অবাস্তব৷
পশ্চিমবঙ্গে এ পর্যন্ত মোট ৫ বার জারি হয়েছে রাষ্ট্রপতি শাসন। তবে তা শেষবার হয়েছে ৪০ বছর আগে। গত চারদশকে রাষ্ট্রপতি শাসন কাকে বলে তা বাংলার মানুষ জানেনা।
◾প্রথমবার বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয় তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের প্রয়াণের পর, ১ জুলাই ১৯৬২ তারিখে। ওই বছরেরই ৮ জুলাই মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার বসেন প্রফুল্লচন্দ্র সেন। শেষ হয় রাষ্ট্রপতি শাসন।
◾ফের ১৯৬৮-র ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলায় জারি হয় রাষ্ট্রপতি শাসন। মোট ১ বছর ৫ দিন চলার পর তা শেষ হয় ১৯৬৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি।
◾এরপর ১৯ মার্চ ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১ বছর ১৪ দিন রাষ্ট্রপতি শাসন চলে বাংলায়।
◾চতুর্থবার বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৮ জুন। চলেছিল ১৯ মার্চ ১৯৭২ সাল পর্যন্ত, মোট ২৬৫ দিন। এরপরে নির্বাচনে জিতে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়।
◾শেষবার ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে ২০ জুন পর্যন্ত বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন চলেছিল ৫১ দিন ধরে। পরে ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসে বামফ্রন্ট সরকার, মুখ্যমন্ত্রী হন জ্যোতি বসু৷ ১৯৭৭-এর ২০ জুনের পর আজ পর্যন্ত বহু দলের বহু চেষ্টা সত্ত্বেও এ রাজ্যে জারি হয়নি রাষ্ট্রপতি শাসন৷
আরও পড়ুন-তামিলনাড়ুতে ২১ জুলাইয়ের আগে ‘’মমতা আম্মা’’-র নামে দেওয়াল লিখন
লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশের পর এ রাজ্যে নতুন শক্তি হিসাবে বিজেপি উঠে এসেছে। একুশের বিধানসভা ভোটের আগে বিজেপি নেতারা তাই মহানন্দে ছিলেন বাংলার ক্ষমতায় এবার তাঁরাই আসছেন৷ দিল্লি থেকে উড়োজাহাজ বোঝাই করে ডেইলি- প্যাসেঞ্জারি করেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি৷ মোদি-শাহের যাবতীয় বক্তৃতা, তথাকথিত কিছু প্রতিশ্রুতি জলে গিয়েছে৷ লজ্জাজনক পরাজয়ের পর বিজেপি নেতাদের একাংশ ইদানিং ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার দাবি তুলছেন। এদের আশা ধনকড়কে সামনে রেখে তাঁরাই রাজ্য চালাবেন৷
অনেকের খেয়াল আছে, ১৯৯৮ সালে এ রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তখনকার প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ নিয়ে একটি জাতীয়স্তরের সম্মেলন ডাকতে অনুরোধ করেছিলেন৷ কিন্তু, শেষপর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি৷ অতীতে এ দেশে যখনই কোনও রাজ্যে অশান্তির বাতাবরণ গড়ে উঠত, তখনই সেই রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক শিবির দাবি তুলত, রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হোক৷ রাজ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে হাইলাইট করে ১৯৯৪ সালের আগে পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির ঘটনাও ঘটেছে অসংখ্যবার৷ এই বাংলায় নানা কারণে মোট ৪ বার জারি হয়েছে রাষ্ট্রপতি শাসন। তবে তা শেষবার হয়েছে ৪০ বছর আগে। গত চারদশকে রাষ্ট্রপতি শাসন কাকে বলে তা বাংলার মানুষ জানেনা।
এরপরই ১৯৯৪ সালে এসআর বোম্বাই বনাম ভারত সরকার মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ঐতিহাসিক এক রায় ঘোষণা করে জানায়, অব্যর্থ কারণ ছাড়া রাজ্যে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা যাবেনা। বোম্বাই-মামলা হয়েছিলো, কর্ণাটকে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা নিয়ে৷ সেই সময় ভেঙ্কটরমন ছিলেন দেশের রাষ্ট্রপতি৷ কর্ণাটকের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রীকে সরিয়ে সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির বিরুদ্ধে মামলার রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট সেদিন বলেছিলো,
◾ রাষ্ট্রপতি শাসন জারির সিদ্ধান্তে লোকসভা ও রাজ্যসভা সবুজ সংকেত দেওয়ার আগেও সুপ্রিম কোর্ট সেই রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের উপর স্থগিতাদেশ জারি করতে পারে৷
◾ কেন্দ্র কোনও রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির সিদ্ধান্ত নিলে, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহনের সব নথি সংবিধান অনুসারেই খতিয়ে দেখার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের রয়েছে।
◾ রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হওয়ার পরও সুপ্রিম কোর্ট সেই সিদ্ধান্ত খারিজ করে দিতে পারে, যদি সেই বিল সংবিধান বিরোধী হয়৷
◾ কেন্দ্রীয় সরকারকেই প্রমাণ করতে হবে যে সংশ্লিষ্ট রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার সিদ্ধান্তের পিছনে যথেষ্ট কারণ ও ভিত্তি রয়েছে।
◾ রাষ্ট্রপতি শাসনের ঘোষণা যদি অসাংবিধানিক হয়, তা হলে বাতিল হওয়া রাজ্য সরকারকে পুনর্বহাল করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের রয়েছে৷
অবশ্য এই রায় ঘোষণার সময় সুপ্রিম কোর্ট পাশাপাশি এটাও বলেছিলো যে,কোনও রাজ্য সরকার যদি রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতায় আঘাত হানে, বিনা দ্বিধায় কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে পারবে৷
বোম্বাই-মামলায় দেশের শীর্ষ আদালত এই রায় ঘোষণার পর আইনগত দিক থেকে এটা পরিষ্কার যে বিশেষ ক্ষেত্র বা উপযুক্ত কারন ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধানের ৩৫৬ ধারা কোনও রাজ্যের উপর প্রয়োগ করে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে পারবে না৷ রাজনৈতিক স্বার্থে এই ৩৫৬ ধারার প্রয়োগ কার্যত নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
এই মুহূর্তে রাজ্য রাজনীতিতে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার একটা সুপ্ত বাসনা কেন্দ্রীয় সরকার, বিজেপি এবং রাজ্যে নব্য বিজেপির একাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে ৷ এই বাসনা’র বাস্তবায়ন কতখানি সম্ভব ?
এক কথায় এর উত্তর, অসম্ভব। ২০২১ -এ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফের ক্ষমতায় আসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে তুলে ধরে বরখাস্ত করা অসম্ভব।
আরও পড়ুন-চিতার ধোঁয়াকে সন্ধ্যারতি ভেবেই ডুবেছে বিজেপি
রাজ্যের বিরোধীপক্ষ কিছু ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বাংলায় সংবিধানের ৩৫৬ অনুচ্ছেদের প্রয়োগের নিয়ে তর্ক করেই চলেছে৷ শীর্ষ আদালতের হস্তক্ষেপের পর তুচ্ছ কারনে সংবিধানের ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের আগে কেন্দ্রকে দশবার ভাবতে হবে ৷ ভবিষ্যতে কখনও রাজ্যে ৩৫৬ অনুচ্ছেদ প্রয়োগের দাবি তোলার আগে রাজনৈতিক দলগুলির উচিত, ওই অনুচ্ছেদের সারমর্ম ও সুপ্রিম কোর্টের রায়ে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া৷ ৩৫৬ ধারার প্রয়োগের হুমকি দিয়ে বিজেপি এ রাজ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতেই পারে। বঙ্গ- বিজেপিও এই ধারা প্রয়োগের ক্রমাগত হুমকি দিতেই পারে।
কিন্তু ওই হুমকি পর্যন্তই, বাস্তবে এই ধারা প্রয়োগ কতখানি সম্ভব, বিজেপির শিক্ষিত-লবি আর একবার বরং ভাবতে বসুক ৷