বৃষ্টি থামার শেষে
তরুণের হাত ধরে হাঁটছে তরুণী। দুজনেরই এক বিশ্ববিদ্যালয়। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। তরুণ নীল পাঞ্জাবি। তরুণী সবুজ শাড়ি, পালক-শরীর। তরুণ কবিতা লেখে। তেমন ছাপাটাপা হয় না। এমনিই লেখে। তরুণী কবিতা বলে। বলতে ভাল লাগে, তাই। নন্দন চত্বরে রবীন্দ্র-মূর্তির পাশ দিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ায় তারা। প্রণাম করে কবিগুরুকে। অনেকের নজরে পড়ে দৃশ্যটি। প্রণাম সেরে অস্ফুটে তরুণ বলে, ‘কবিতা উৎসবে (kavita utsav) এসেছি। তা-ও পঁচিশে বৈশাখের মুখে। রবীন্দ্রনাথকে প্রণাম না জানালে হয়!’ তরুণীর ঠোঁটে নরম হাসি। মৃদু সমর্থন।
দুজন উৎসবে (kavita utsav) এসেছে কবিতা শুনতে, শিখতে। কেউ তাদের চেনে না, জানে না। কবিতা ছুঁয়ে তারা আরও নিবিড় করতে চায় সম্পর্ক। পা বাড়াল একতারা মুক্তমঞ্চের দিকে। কিছুক্ষণ আগে থেমেছে বৃষ্টি। শুরু হবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। তরুণ-তরুণী দর্শকাসনে। ওদের পাশে অসংখ্য মুখ। দেখে আশ্বস্ত হলাম। যে যাই বলুক, নতুন প্রজন্ম আছে বাংলা কবিতার সঙ্গে।
উচ্চারণে সুকুমার
‘কবিতার জন্য একটি আকাদেমি। তা-ও আবার সরকারি ব্যবস্থাপনায়। দেশের আর কোনো রাজ্যে আছে?’ চায়ে চুমুক দিতে দিতে পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোক ছুঁড়ে দিলেন প্রশ্ন। সঙ্গী বললেন, ‘না। শুনিনি। একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই আছে। ২০১৬-য় দ্বিতীয় বার শপথ নেওয়ার পর মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গঠন করেছেন কবিতার এই আকাদেমি।’
দুজনেই লিটল ম্যাগাজিন-সম্পাদক। এসেছেন কবিতা উৎসবে (kavita utsav)। তাঁদের মতে, এই রাজ্যের মতো কবিতা নিয়ে উন্মাদনা দেশের আর কোথাও দেখা যায় না। বছর বছর বেরোয় অসংখ্য কবিতার বই, কবিতা বিষয়ক পত্রিকা। প্রাপ্তির আশায় কেউ কবিতা লিখতে বা বলতে আসেন না। আসেন ভালবেসে।
হঠাৎ ছেদ পড়ল তাঁদের আলোচনায়। শুরু হয়েছে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সুকুমার রায়ের কবিতার উচ্চারণে নতুন প্রজন্মের একঝাঁক শিল্পী। ৩ মে। সন্ধে নামার ঠিক আগে।
চাঁদের হাট
একতারা মুক্তমঞ্চে তখন চাঁদের হাট। আলো ছড়িয়ে বসেছেন বিশিষ্টরা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমি আয়োজিত ‘কবিতা উৎসব ২০২৩’-এর (kavita utsav) উদ্বোধন করলেন রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। দুই পাশে মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন, মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমির সভাপতি সুবোধ সরকার, বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারী, কৌশিক বসাক, বিজয়লক্ষ্মী বর্মণ, প্রণতি ঠাকুর, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। আলো ঝলমলে সুসজ্জিত বৃষ্টিধোয়া উৎসব প্রাঙ্গণ। কবিতা-গন্ধে ম-ম করছে। সূচনা মুহূর্তের সাক্ষী থাকলেন অসংখ্য মানুষ। যাঁরা কবিতা অপছন্দ করেন, এই দৃশ্য দেখলে তাঁরা মুখ লুকনোর জায়গা পেতেন না।
সম্মানিত কবি-শিল্পী
সম্মাননা প্রদান কবিতা উৎসবের অন্যতম অঙ্গ। কুমুদরঞ্জন মল্লিকের পৌত্র সুধেন্দু মল্লিক। বর্ষীয়ান এই কবি পেলেন জীবনানন্দ দাশ সম্মাননা। তিনি অসুস্থ। তাঁর হয়ে সম্মাননা নিলেন ভাইপো। কাজী সব্যসাচী সম্মাননা পেলেন প্রবীণ আবৃত্তিশিল্পী মুরারিমোহন চক্রবর্তী। পুরুলিয়ার নির্মল হালদার। ‘অস্ত্রের নীরবতা’র কবি। পেলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্মাননা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্মাননা পেলেন পায়েল সেনগুপ্ত। সাম্য কার্ফা পেলেন নীলাদ্রিশেখর বসু সম্মাননা। দক্ষিণ দিনাজপুরের সোহেল ইসলাম। নবীন এই কবি পেলেন বিনয় মজুমদার সম্মাননা। আবুল কাশেম রহিমউদ্দীন সম্মাননা পেলেন সুদীপ্তা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মঞ্চ আট জমজমাট
৩-৬ মে। চারদিন কলকাতার আটটি মঞ্চে আয়োজিত হয়েছে অনুষ্ঠান। রবীন্দ্র সদন, শিশির মঞ্চ, বাংলা আকাদেমি সভাঘর, জীবনানন্দ সভাঘর, অবনীন্দ্র সভাঘর, নন্দন-৩, চারুকলা পর্ষদ সংলগ্ন মুক্তমঞ্চ এবং একতারা মুক্তমঞ্চ। কবিতাপাঠ করেন নবীন-প্রবীণ কবিরা, আবৃত্তি পরিবেশন করেন নানা বয়সি আবৃত্তি শিল্পীরা। তাঁদের একক এবং সম্মেলক নিবেদনে ছিল বিভিন্ন সময়ের কবিদের কবিতা। ছিলেন কয়েকজন আলোচক। সবমিলিয়ে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছশো। উৎসব প্রাঙ্গণে দেখা গেছে কবিতাপ্রেমীদের তুমুল উন্মাদনা। উঠেছে প্রচুর সেলফি। ঘুরে ঘুরে বাংলা কবিতা শুনেছেন অন্য ভাষার কিছু মানুষও।
আলাপনী বক্তৃতা
এবারের কবিতা উৎসবে চমৎকার দুটি বক্তৃতা রেখেছেন মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। সুবক্তা তিনি। কথা বলাও যে একটা শিল্প বোঝা যায় তাঁর বক্তৃতা শুনে। প্রথম বক্তৃতাটি রেখেছেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। বলেন রাষ্ট্রের দুটো সমান্তরাল রেখার কথা। একটা পেশিবহুল শক্তিমান দিক। যেখানে কবিতা, আবৃত্তির ছায়া কম পড়ে। আরেকটা নরম দিক। যেদিকে রয়েছে কবিতা, সংস্কৃতি ইত্যাদি। দ্বিতীয় দিনে তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘কবিতা ও জনজীবন’। কয়েকটি কবিতা ধরে তিনি করেন মনোজ্ঞ আলোচনা। এবারের কবিতা উৎসবে তাঁর দুটি বক্তৃতা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
আরও পড়ুন-জীবনে প্রতিক্ষণে রবীন্দ্রনাথ
অন্যান্য আলোচনা
আরও কয়েকটি আলোচনা ছিল। নন্দন-৩-এ। বিভিন্ন ভাষার কবিরা অংশ নিয়েছেন ‘কবিতা এক আকাশ, বহুভাষা’ শীর্ষক আলোচনায়। আরেকটি আলোচনা হয়েছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদ কবিতা নিয়ে। শতবর্ষ চলছে কবি নরেশ গুহর। স্মরণ করা হয়েছে তাঁকে। ছিল আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা : ‘কেন আমি কবিতা লিখি না’। প্রতিটি আলোচনাই হয়েছে মনোগ্রাহী। বাংলা আকাদেমি সভাঘরেও অনুষ্ঠিত হয়েছে আলোচনাসভা। শিরোনাম ‘এখন কেন কবিতায় কোনো আন্দোলন নেই’, ‘কাল যদি ফেসবুক উঠে যায়?’, ‘লিটল ম্যাগাজিনে কেন লিখি?’ জমে উঠেছিল প্রতিটি আসর।
বই নিয়ে হইচই
উৎসব প্রাঙ্গণে ছিল দুটি বইয়ের স্টল। একটি স্টলে ছিল পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, শিশু কিশোর আকাদেমি-সহ রাজ্য সরকারের বিভিন্ন আকাদেমি প্রকাশিত বই। আরেকটি স্টল ছিল পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের। কবিতার পাশাপাশি বিক্রি হয়েছে অন্যান্য বইও।
দেখাসাক্ষাৎ, আড্ডা
শুধুই কি কবিতা-বলা বা শোনার জন্য আসা? একেবারেই না। উৎসবে হয় পরস্পরের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ। আলাপ-পরিচয়। জমে ওঠে আড্ডা। মহানগরের পাশাপাশি ছিল জেলার অংশগ্রহণ। দার্জিলিংয়ের কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ির রিমি দে, কোচবিহারের সুবীর সরকার, সঞ্জয় সাহা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সৌমিত বসু, রফিক উল ইসলাম, নাগসেন, পুরুলিয়ার দেবাশিস মণ্ডল, পূর্ব বর্ধমানের কমলেশ কুমার, বাঁকুড়ার স্বরূপ চন্দ, উত্তর চব্বিশ পরগনার বিভাস রায়চৌধুরী, সমরেশ মুখোপাধ্যায়, হুগলির রামকিশোর ভট্টাচার্য, তারেক কাজী, হাওড়ার ব্রত চক্রবর্তী, সুদীপ্ত মাজি প্রমুখ বিশিষ্ট কবির সঙ্গে কথা হল। প্রত্যেকেই মুগ্ধ এবারের আয়োজনে। একবাক্যে স্বীকার করলেন, বাংলা ভাষার বৃহত্তম এই কবিতা পার্বণ বৃহত্তর জন পরিসরে কবিতাকে প্রতিষ্ঠিত করবে।
নতুনদের জন্য
আকাদেমির সদস্য-সদস্যারা এবার কবিতা পড়েননি। জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন নতুনদের। প্রথমবার সুযোগ পেয়ে রেখাপাত করেছেন নবীন কবি ও আবৃত্তিশিল্পীরা। সভাপতি জানিয়েছেন, আগামীদিনে নতুনরা আরও সুযোগ পাবেন।
একটি বছরের প্রতীক্ষা
সবমিলিয়ে জমজমাট ছিল সপ্তম বছরের কবিতা উৎসব। শনিবার শেষ হল রূপমের কবিতায়-গানে। প্রাণে উঠল খুশির তুফান। এখন একটি বছরের প্রতীক্ষা। কবিতাপ্রেমীরা মনে করেন, ২০২৪-এ অষ্টম বর্ষের আয়োজন আরও বর্ণময় হবে। ফলে কবিতার ছুটি নেই। এগিয়ে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের হাত ধরে। অগণিতের নিত্য যাপনে।