‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’
ফুটবলের সঙ্গে বাঙালির আত্মিক যোগ। বাঙালির আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই খেলায় মেতে উঠতেন আমাদের চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi nazrul Islam)। গতির প্রতি তাঁর ছিল সীমাহীন আসক্তি। আয়নুন হক খাঁ-এর স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়— ‘‘কবি বলতেন, ট্রাম টিকির-টিকির করে থেমে- থেমে চলে, এটা আমার অসহ্য লাগে। ট্যাক্সি যখন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলে তখন আমার মনও যেন এক অজানা দেশে পাড়ি দেয়, আমি তখন সংসারের অভাব-অনটনের কথা একদম ভুলে যাই।” অর্থাৎ সেই ‘গতি’। গতির প্রতি ভালোবাসা থেকেই সম্ভবত নজরুল ফুটবলপ্রেমী হয়ে উঠেছিলেন।
নজরুল এবং তাঁর বন্ধু প্রেমেন্দ্র মিত্র উভয়েরই ফুটবল খেলা দেখার নেশা ছিল। খেলার মরশুমে তাঁরা ট্যাক্সি করে ময়দানে খেলা দেখতে যেতেন, আবার খেলা দেখে ট্যাক্সি করেই বাড়ি ফিরতেন। ‘সওগাত’ অফিস থেকে টাকা পেলে, অর্ধেকের বেশি টাকা এভাবেই কবি খরচ করতেন ট্যাক্সিতে যাতায়াত করে এবং খেলা দেখে। দারিদ্র্যর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা কবির কাছে এ ছিল এক মুক্তির আনন্দ। নজরুলের ফুটবল-প্রীতি সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করেছেন তাঁর পুত্র কাজী সব্যসাচী—
‘‘বাবা সময় পেলেই ফুটবল খেলা দেখতে দৌড়তেন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে। যেদিন বাড়ি থেকে সোজা খেলা দেখতে যেতেন, তখন দু-ভাই সঙ্গে যেতাম। বাবার সঙ্গে শেষ খেলা দেখেছিলাম আইএফএ শিল্ডের মহামেডান স্পোর্টিং বনাম কেওসিবি-র খেলা।” খেলা প্রসঙ্গে হরি ঘোষ স্ট্রিটের বাড়ির দিনগুলির কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। তিন তলা বাড়ির সামনে খেলার মাঠে চলত ফুটবল খেলা। প্রতিবেশীদের ভর্ৎসনা উপেক্ষা করেও ছেলেদের ফুটবল খেলায় উৎসাহ দিতেন নজরুল (Kazi nazrul Islam)।
মাহবুবুল হকের লেখা নজরুল তারিখ অভিধান থেকে জানা যায় আরও একটি ঘটনার কথা, যেখানে নজরুলের আবেগ, বন্ধু-প্রীতি, ফুটবলপ্রেম সব যেন একাকার হয়ে যায়— ‘২০ জুন, ১৯২৮ সালে কলকাতার মাঠে কোন এক সাহেব টিমকে মোহনবাগান, ঢাকা থেকে আগত রবি বোস নামক এক খেলোয়াড়ের গুনে ৬ গোল দিয়ে আলোড়ন ঘটায়। ঢাকার লোকের এই নৈপুণ্যে অতি উৎসাহে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় ও দীনেশরঞ্জন দাশ-সহ কল্লোল গোষ্ঠীর ৪-৫ জনকে নিয়ে নজরুল আকস্মিকভাবে ঢাকায় আসেন। তিনি কাজী মোতাহার হোসেনের বর্ধমান হাউসের বাসায় ওঠেন। হঠাৎ করে এলেও নজরুল বেশ কিছুদিন ঢাকায় থেকে যান।”
১৯৩৪ সালে মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় ক্রীড়াপ্রেমী কাজী নজরুল ইসলাম ‘মোবারকবাদ’ কবিতাটি রচনা করেন। এ কবিতা শুধুমাত্র তাঁর ফুটবল-প্রীতির বহিঃপ্রকাশ নয়, তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তরুণ সমাজকে নবমন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন নজরুল। তিনি লিখলেন—
এই ভারতের অবনত শিরে তোমরা পরালে তাজ, সুযোগ পাইলে শক্তিতে মোরা অজেয়, দেখালে আজ!
এ কি অভিনব কীর্তি রাখিলে নিরাশাবাদীর দেশে, আঁধার গগনে আশার ঈদের চাঁদ উঠিল যে হেসে!
সওগাত সম্পাদক নাসিরুদ্দীন সাহেব মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সব খেলোয়াড়দের ফটো তুলে, খেলার বিবরণ ও ছবি সহযোগে সওগাতের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করলেন। তৎকালীন সময়ে মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের খেলোয়াড়রা কতটা জনপ্রিয় ছিলেন, তা জানা যায় তাঁর স্মৃতিকথায়—‘‘বড় সাইজের আর্ট পেপারে সকল খেলোয়াড়ের ছবি ছাপালাম দেয়ালে রাখবার মত করে এবং তা দশ হাজার ছেপে বাজারে ছাড়লাম। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সব বিক্রি হয়ে গেল। পুনরায় মুদ্রণ করলাম। হাজার হাজার লোকের গৃহসজ্জা হলো মহামেডান দলের এই দেয়াল ছবি। কিছুকাল পরে দেখলাম, আমার উক্ত ছবি হুবহু নকল করে রুমালের ওপর ছাপা হয়ে কলকাতায় এসেছে জাপান থেকে। জাপানে ছাপা এই রুমালগুলিও অসংখ্য পরিমাণে বিক্রি হয়েছিল।” টানা বেশ কয়েক বছর এই দলের বিজয়ী হওয়ার ঘটনা মুসলমান সমাজে নবপ্রাণের সঞ্চার করল।
নজরুল রচিত ‘শেষ সওগাত’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা ‘জোর জমিয়াছে খেলা’— তাঁর এক অনবদ্য সৃষ্টি।
জোর জমিয়াছে খেলা
ক্যালকাটা মাঠে সহসা বিকাল বেলা।
এই জনগণ-অরণ্যে যেন বহিত না প্রাণ বায়ু,
শিথিল হইয়া ছিল যেন সব স্নায়ু!
সহসা মৌন অরণ্যে আজ উঠেছে প্রবল ঝড়,
ভীড় করে পাখি নীড় ছেড়ে করে কোলাহল-মর্মর।
ফুটবল খেলাকে উপজীব্য করে এ এক সমাজ-পরিবর্তনের কবিতা। স্বাধীনতাকামী, সাম্যবাদী কবির কলমে তাই উঠে এসেছে—
ময়দানে জোর ভিড় জমিয়াছে বড় ছোট মাঝারির,
স্বদেশী বিদেশী লোভী নির্লোভ হেটো মেঠো বাজারীর!
এই দিকে ‘রাজী’ ও-দিকে ‘নারাজী’ দল,
সেন্টারে পড়ে আছে ভারতের ‘স্বাধীনতা ফুটবল’!
খেলা মানেই হার-জিত। শেষ পর্যন্ত কোন্ দল জয়ী হল, সেই প্রশ্ন কবি ছুঁড়ে দিয়েছেন পাঠকদের উদ্দেশ্যে—
খেলা দেখ, দেখ খেলা,
‘রাজী’ কি ‘নারাজী’ জয়ী হল, বলো তোমরাই সাঁঝ-বেলা!
কবুতরগুলি ফেরে নাই ঘরে, ঘুরিছে মাথার পর,
কাহারা জিতিল, দেশে দেশে গিয়া শুনাবে খোশখবর!
ফুটবল খেলার প্রতিটি পারিভাষিক শব্দ চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছেন কবি এই কবিতায়।
রমেন দাস ‘নজরুলের খেয়ালখুশি’ শীর্ষক লেখায় লিখেছেন— ‘‘শুধুমাত্র বিদ্রোহী কবি, একনিষ্ঠ সাংবাদিক বা নির্ভীক দেশপ্রেমিক হিসাবে নয়, একজন বিশিষ্ট ক্রীড়ামোদী হিসাবেও তিনি ছিলেন বিশেষ পরিচিত। খেলাধুলোর নামে ছিলেন পাগল। প্রতিদিনই অফিসের কাজ শেষ করে কবি বিকেলে বেরিয়ে পড়তেন খেলার মাঠে। সঙ্গে থাকতেন সাহিত্যিক বন্ধুরা। প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্যোপাধ্যায়, দীনেশরঞ্জন দাশ, অরিন্দম বসু প্রভৃতি তাঁদের মধ্যে অন্যতম।”
আমাদের সামনে এভাবেই ধরা দেন ফুটবলপ্রেমী নজরুল (Kazi nazrul Islam)।
আরও পড়ুন-চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই হাতির হানায় মৃতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ